
নিষেধাজ্ঞা শেষে আবারও প্রাণ ফিরেছে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার মৎস্যঘাটগুলোতে। নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গভীর সমুদ্রে ছুটে গেছেন হাজার হাজার জেলে। তাদের জালে উঠতে শুরু করেছে রুপালি ইলিশ। আর সেই ইলিশ এখন বাজারে এসে ছড়িয়ে দিচ্ছে স্বস্তির সুবাস। ইলিশ আসার খবরে খুশি জেলে, ব্যবসায়ী, এমনকি সাধারণ ক্রেতারাও।
হাতিয়ার চেয়ারম্যানঘাট, পাশ^বর্তী আলেকজান্ডার ঘাট, তমরুদ্দিন ঘাট, জনতা বাজার, ওচখালি, টাংকিরঘাট এবং সোনাদিয়া মাছঘাট এখন জমজমাট। গত দু’মাস ধরে যে ঘাটগুলো ছিল একপ্রকার নীরব—নিস্তব্ধ, সেখানে এখন শুধু ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও ট্রলারের গর্জন আর জেলেদের ব্যস্ত পদচারণা।
৫৮ দিন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ইলিশের প্রধান প্রজনন সময় বিবেচনায় সমুদ্র ও নদীতে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই সময়টিতে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকাগুলোয় জেলেদের মৎস্য আহরণে বিরত থাকতে হয়। মূলত ইলিশের প্রজনন ও মাছের অবাধ বৃদ্ধি নিশ্চিত করতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সরকার নিবন্ধিত জেলেদের জন্য খাদ্য সহায়তা প্রদান করে। তবে বাস্তবতা হলো, অনেকেই সময়মতো এই সহায়তা পান না, ফলে তাদের জীবনে দুর্দশা নেমে আসে।
বুধবার রাতে নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতিয়ার মৎস্যজীবীরা নৌকা ও ট্রলার নিয়ে রওনা দেন গভীর সাগরের দিকে। কারও হাতে ছিল জাল, কারও হাতে নৌকার রশি। মেঘনা আর বঙ্গোপসাগরের মোহনায় এক অসাধারণ দৃশ্য—মাঠের মতো সমুদ্র, আর তাতে ছুটছে শত শত ট্রলার।
অভাবী জেলেরা বলেন, প্রায় দুই মাস ধরে বসে বসে কষ্ট করতেছিলাম। ঘরে খাবার ছিল না। সরকারের চাল পাইছি, কিন্তু সেটা দিয়ে সংসার চলে না। এখন আবার ইলিশ ধরতে পারতেছি, আল্লাহর রহমতে খুব ভালো সাইজের মাছ ধরা পড়তেছে।
একই কথা জানালেন জেলে ফারুক মিয়া। তিনি বলেন, মাত্র এক রাতে প্রায় ৩৫ হাজার টাকার ইলিশ বিক্রি করছি। এমন চলতে থাকলে সহজে পূর্বের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
হাতিয়া সদরের জনতা বাজারে ঘুরে দেখা যায়, বাজারজুড়ে এখন শুধু ইলিশ আর ইলিশ। কেউ এক কেজির উপরের মাছ বিক্রি করছেন, কেউ ৬০০—৭০০ গ্রামের। দাম তুলনামূলক একটু বেশি হলেও ক্রেতারা সন্তুষ্ট।
১ কেজি ওজনের ইলিশ ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা, মাঝারি আকারের ইলিশ ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে ক্রেতারা জানান।
ক্রেতারা অনেকেই বলেন, অনেকদিন পর তাজা ইলিশ খাওয়ার সুযোগ হলো। দাম একটু বেশি হলেও, কিন্তু মাছের মান ভালো।
হাতিয়ার ইলিশ বিক্রেতা সমিতির সদস্যরা জানান, নিষেধাজ্ঞার সময় পুরো বাজারে মন্দা ছিল। এখন মাছ আসতে শুরু করেছে, ফলে আমদানি—রপ্তানির গতি ফিরবে। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় এই মাছ পাঠানো হচ্ছে। আমরা আশা করছি এ বছর ইলিশ উৎপাদন ভালো হবে।
বড় বড় ট্রলারের মালিকরাও আশান্বিত। অনেকে বলেন, শুধু ইলিশ ধরার ওপরই আমাদের বছরের ৭০ শতাংশ আয় নির্ভর করে। যদি আবহাওয়া ভালো থাকে, জেলেরা সাগরে যেতে পারেন—তাহলে আগামী তিন মাস হবে সোনালি সময়।
তবে সবখানে সুখবর নেই। অনেক জেলে অভিযোগ করছেন, সরকার যেভাবে খাদ্য সহায়তা দেয়ার কথা বলেছে, বাস্তবে তেমনটা হয়নি। অনেকে পেয়েছেন দেরিতে, আবার অনেকে নাকি তালিকাভুক্ত হয়েও বঞ্চিত হয়েছেন।
জেলে সমিতির নেতৃবৃন্দ বলেন, আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করছি যেন বাস্তবভিত্তিক তালিকা তৈরি করা হয়। প্রতিবার অনেক প্রকৃত জেলে বাদ পড়ে যায়। আবার অনেকে যারা মাছ ধরে না, তারাও সুবিধা পায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রে জেলেদের জাল পাতার পাশাপাশি পরিবেশের পরিবর্তনকেও বিবেচনায় নিতে হবে। সাগরে প্লাস্টিক বর্জ্য, তেল নির্গমন, জাল ফেলার ধরন—সব কিছুই ইলিশের প্রজনন ও প্রবাহকে প্রভাবিত করে। তাই শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, জেলেদের প্রশিক্ষণ, সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান দরকার।
নোবিপ্রবি’র মেরিন বায়োলজির অধ্যাপক ড. শওকত আলী বলেন, ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। এর উৎপাদন শুধু অর্থনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক গুরুত্বও বহন করে। তাই আমরা যদি পরিবেশবান্ধব ও পরিকল্পিত মৎস্যনীতি অনুসরণ করি, তাহলে ইলিশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।
নিষেধাজ্ঞা শেষে হাতিয়াতে আবার ইলিশ ধরা ও বাজারে আসার মাধ্যমে নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছেন হাজারো জেলে ও ব্যবসায়ী। এই ইলিশ শুধু তাদের অর্থনৈতিক উপার্জনের মাধ্যম নয়, বরং একটি নতুন আশার প্রতীক। সরকার ও সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি থাকলে এই সম্ভাবনাকে আরও সুসংহত করা সম্ভব হবে।
শিহাব