ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৮ মে ২০২৫, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

শত কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে মেয়েদের মুখ দেখেন আনোয়ার, গুড়-মুড়ি খেয়ে চলে জীবন

নাজমুল হাসান, কনট্রিবিউটিং রিপোর্টার, নাটোর

প্রকাশিত: ০৯:২৮, ২৬ মে ২০২৫; আপডেট: ০৯:২৯, ২৬ মে ২০২৫

শত কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে মেয়েদের মুখ দেখেন আনোয়ার, গুড়-মুড়ি খেয়ে চলে জীবন

নাটোরের সিংড়া উপজেলার ধুলাউড়ি গ্রামের ১১৬ বছর বয়সী খন্দকার আনোয়ার হোসেন বয়সকে যেন হার মানিয়ে দিয়েছেন। জীবনের এই পরিণত বয়সেও তিনি স্বনির্ভর, পরিশ্রমী এবং জীবনযাত্রায় অতিশয় সচল। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র বা বয়সের নির্দিষ্ট সরকারি নথি আপাতত না থাকলেও পরিবারের সদস্যদের দাবি অনুযায়ী তিনি ১১৬ বছরে পা দিয়েছেন। চুল ও দাঁড়িতে পাক ধরলেও তাঁর চলাফেরায় ক্লান্তির কোনো চিহ্ন নেই। চোখের দৃষ্টিও একেবারে টনটনে। 

জানা যায়, খন্দকার আনোয়ার হোসেনের জীবনযাত্রা অত্যন্ত সরল ও শৃঙ্খলাবদ্ধ। বেশিরভাগ দিন চলে যায় গুড় ও মুড়ি খেয়ে। কোনো অসুস্থতা বা ওষুধ নির্ভরতা নেই বললেই চলে। চিকিৎসকের কাছে কবে গিয়েছিলেন, তা তিনি নিজেও মনে করতে পারেন না। তাঁর মতে, “বিশ্রাম নিয়ে আবার চলা শুরু করেন—এই ভাবনাতেই জীবনের দূরত্ব ফিকে হয়ে যায়।”

সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হলো, তিনি এখনো নিয়মিত সাইকেল চালান এবং তা-ও শত কিলোমিটারের বেশি। জয়পুরহাটের পাঁচবিবি কিংবা বগুড়ার মোকামতলায় মেয়েদের বাড়িতে যেতে এখনো সাইকেলই তাঁর ভরসা। সম্প্রতি গত প্রায় এক সপ্তাহ পূর্বে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি ও বগুড়ার মোকামতলায় দুই মেয়ের বাড়িতে সাইকেলের প্যাডেল চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। জীবনের শেষ যাত্রায় তিনি মেয়েদের কাছ থেকে কাফনের কাপড় চেয়েছেন। মৃত্যুর পরে যেন মেয়েদের দেওয়ার কাফনের কাপড় দিয়ে তাকে দাফন করা হয়। এছাড়াও মৃত্যুর আগের প্রস্তুতিও তিনি নিজ হাতে করে রেখেছেন—তিনি চান, মৃত্যুর পর যেন তাঁকে তাঁর নিজ হাতে বানানো কাঠের খাটিয়ায় কবরস্থ করা হয়। 

আনোয়ার হোসেনের জীবনের শুরু হয়েছিল পাকিস্তানের করাচিতে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের চাকরিজীবী ছিলেন। দেশভাগের সময় তাঁরা বাংলাদেশে চলে আসেন। আনোয়ার হোসেন নৌবাহিনীতে ট্রাক চালিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন, পরবর্তীতে বাস ও ট্রাক চালক হিসেবেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। বর্তমানে তাঁর পরিচিতি ‘আনোয়ার ড্রাইভার’ নামে।

আনোয়ার হোসেনের ছেলে লিটন জানান,“আমরা বলি বাসে যান, কিন্তু উনি সাইকেল ছাড়া যান না। সাইকেলই তাঁর স্বাধীনতা।” এমনকি একবার তাকে সাইকেল চালাতে না দেওয়ায় তিনি চুপিচুপি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান এবং ২৩ দিন নিখোঁজ থাকার পর মাইকিং আর পোস্টারের মাধ্যমে খুঁজে আনা হয়। এ কারণে বাবাকে আর কিছু বলিনা। মৃত্যু অবধি তার স্বাধীনতা নিয়েই চলাফেরা করুক।”

ধুলাউড়ির ৫৬ বছর বয়সী প্রতিবেশী আলী রেজা বলেন, “আনোয়ার ভাই এখনো পাড়ার যেকোনো প্রয়োজনে সাইকেল নিয়ে ছুটে যান। তাঁর মতো আত্মনির্ভর, কর্মঠ মানুষ এই বয়সেও খুঁজে পাওয়া যায় না। উনি আমাদের দেখিয়ে দেন, বয়স আসলে একটা সংখ্যা মাত্র। সাহস, ইচ্ছাশক্তি আর চলার মানসিকতা থাকলেই জীবন থেমে থাকে না।”

খন্দকার আনোয়ার হোসেন বলেন,"জীবন থেমে থাকবার জিনিস না। আমি তো ১১৬ বছর পেরিয়ে এসেছি—কিন্তু এখনো রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হয়, আজও কিছু একটা করার আছে। কেউ দেখে বোঝে না, এই বুড়োটা সাইকেল চড়ে একশ কিলোমিটার দূরের মেয়ের বাড়ি যায়। কিন্তু আমি যাই। কারণ, আমার কাছে চলা মানেই বাঁচা। সাইকেলটা শুধু বাহন না, এটা আমার স্বাধীনতা। আগে গাড়ি চালাতাম—নৌবাহিনীতে, পরে রাস্তায় রাস্তায়। গাড়ি নেই এখন, কিন্তু চলা থেমে থাকেনি। বিশ্রাম নিই, আবার রওনা দিই। একাই যাই—নন্দিগ্রাম, মোকামতলা, জয়পুরহাট, সব পথ আমার চেনা। আমি নিজের কাজ নিজেই করি। রান্না খুব একটা করি না, গুড়-মুড়ি খেয়ে চলে যায়। ডাক্তারের কাছে কবে গিয়েছিলাম, মনে নাই। আমার সাইকেলটাও নিজে মেরামত করি। এমনকি মৃত্যুর সময় কেমন শুইব, তাও ঠিক করে রেখেছি—নিজের বানানো খাটিয়াতে যেন কবর দেওয়া হয়।"

নোভা

×