ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

নির্মূল কমিটির সম্মেলনে আলোচনা

সরকারে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি কিন্তু মৌলবাদীদের হাতে সমাজ

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৪৪, ১৮ মে ২০২৪

সরকারে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি কিন্তু মৌলবাদীদের হাতে সমাজ

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অষ্টম জাতীয় সম্মেলন

দেশে অভাবনীয় উন্নয়ন হলেও চিন্তা চেতনা মননে আমরা দরিদ্র হয়ে যাচ্ছি। এই দারিদ্র্য দূর করতে হবে। একইভাবে বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকলেও সমাজ মৌলবাদীদের হাতে চলে গেছে। সাম্প্রদায়িক অপশক্তি সব অর্জন গ্রাস করতে চাইছে।

এ অবস্থায় সরকারকে আপসের পথ পরিহার করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামে থাকা বিশিষ্টজনরা। সামাজিক শক্তিগুলোকেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। 
শনিবার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির অষ্টম জাতীয় সম্মেলনে অংশ নিয়ে নিজেদের এসব উদ্বেগ, হতাশা এবং সম্ভাবনার কথা বলেন তারা। একইসঙ্গে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের নিরাপত্তার কথা ভেবে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ তুলে ধরেন। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে দিনব্যাপী এই সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

এতে সারাদেশ থেকে অসংখ্য প্রতিনিধি যোগ দেন। সম্মেলন উপলক্ষে পুরো প্রাঙ্গণটি বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড ফেস্টুন ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়। প্ল্যাকার্ড ফেস্টুনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, এর সঙ্গে মিলিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের চাওয়া এবং দাবি দাওয়ার কথা তুলে ধরা হয়।

প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘৭১-এর  গণহত্যাকারীদের যাবতীয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে শহীদ পরিবার ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে ব্যয় করুন’, ‘জামায়াতে ইসলামী ও পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অবিলম্বে করতে হবে’। ‘মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলুন’।

মিলনায়তনের প্রবেশমুখে নিমুূল কমিটির প্রয়াত সংগঠক ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি সংবলিত একটি স্মারক বোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। বিশাল  বোর্ডে ৬১ জন প্রিয় মানুষের মুখ। বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে যাওয়া মুখগুলোর মধ্যে কবি সুফিয়া কামাল শহীদ জননী জাহানারা ইমাম কবির চৌধুরী আব্দুর রজ্জাক কলিম শরাফী যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন অপেক্ষাকৃত তরুণ যোদ্ধা আবৃত্তিশিল্পী হাসান আরিফ। 
সকালে জাতীয় পতাকা ও সংগঠনের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে মূল কর্মসূচির সূচনা করা হয়। পতাকা উত্তোলনে অংশ নেন সংগঠনের সভাপতি শাহরিয়ার কবির এবং ৮ শহীদ পরিবারের উত্তরসূরিরা।

উত্তরসূরিদের মধ্যে থাকবেন ভাষাসংগ্রামী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পৌত্রী আরমা দত্ত, পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমদের পুত্র লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার কন্যা ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর পুত্র আসিফ মুনীর, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্র তানভীর হায়দার চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সারের কন্যা অভিনয় শিল্পী শমী কায়সার, ডা. আলিম চৌধুরীর কন্যা ডা. নুজহাত চৌধুরী ও আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ। 
দিনের প্রথম অধিবেশন বিশেষভাবে আলোকিত করেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন নির্মূল কমিটির সাবেক এই উপদেষ্টা। সম্মেলন উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্পিকার শিরিন শারমীন চৌধুরী এবং প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। প্রথম অধিবেশনের শুরুতে বাণী তিনটি পড়ে শোনান নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। অধিবেশন শেষে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। মিলনায়তনের সামনের রাস্তা থেকে দোয়েল চত্বর হয়ে পুনরায় সম্মেলন কেন্দ্রে এসে শেষ হয় শোভাযাত্রা। 
দুপুরে দ্বিতীয় অধিবেশনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হকসহ বিভিন্ন অঙ্গণের বিশিষ্টজনরা বক্তব্য রাখেন। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার এবং গোলাম কুদ্দুছ। এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী। 
আলোচনায় অংশ নিয়ে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, দেশে এখন মোল্লাতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে। রাজনৈতিক মোল্লারা ধর্মকে সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এই মোল্লাতন্ত্রের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বিএনপি। মৌলবাদি যত পাখি সব এসে বিএনপির ডালে আশ্রয় নিয়েছে। বাসা বেধেছে। সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, এই সব পাখিদের খুদ কুড়া দিয়ে কাছে ডেকে লাভ হবে না। মৌলবাদীদের পোষ মানা আওয়ামী পাখি হবে না।  
তিনি বলেন, বিএনপি এবং মোল্লাতন্ত্র এমনকি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের সংবিধান ইত্যাদি মীমাংসিত বিষয় অস্বীকার করছে। যারা গণতন্ত্র বা নির্বাচন নিয়ে কথা বলছেন তারা মীীমাংসিত এসব বিষয়ে  ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোনো কথা বলছেন না। এসব বিষয়ে একমত না হতে পারলে যুদ্ধাবস্থা চলতে থাকবে। যুদ্ধাবস্থায় নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের আলোচনা ফলপ্রসু হবে না।  
মৌলবাদী অপশক্তির সঙ্গে সরকার আপোস করছে বলে অভিযোগ করেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননও। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও রাষ্ট্র পতিষ্ঠার যে লড়াই আমরা শুরু করেছিলাম তা থেকে বহুদূরে চলে গেছি। ক্রমাগত আত্মসমর্পণ করছি আমরা। এ প্রসঙ্গে মৌলবাদীদের হুমকির মুখে পাঠ্যপুস্তক থেকে তৃতীয় লিঙ্গ বিষয়ক একটি রচনা সরিয়ে নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন তিনি।

বলেন, পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রখ্যাত কবি লেখকদের লেখাও সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো দেখব স্কুলের পাঠ্যবইয়ে কী যাবে না যাবে তা ঠিক করার জন্য এনসিটিবিতে হেফাজতে ইসলামের সদস্য রাখা হবে। 
লালনের গানের কথা প্রচার করায় সম্প্রতি এক ভক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গটিও তুলে ধরেন রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, ওই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে আমরা জানি না।

আরও কিছু ঘটনা তুলে ধরে এই বাম নেতা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শের কথা বলি আমরা, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আচরণে তা পাচ্ছি না। 
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার সমাজ পর্যবেক্ষণ এবং বাস্তব উপলব্ধির জায়গা থেকে পরামর্শমূলক বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, যদিও সরকারে আছে মুক্তিযুদ্ধের শক্তি, সমাজটা কিন্তু বেদখল হয়ে গেছে। মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির হাতে চলে গেছে সমাজ, আপনারা তা জানেন।

কিন্তু করণীয় কী? আমি মনে করি শিক্ষা সংস্কৃতি গণমাধ্যম- এই তিন ইস্যুতে অনেক কাজ করার আছে আমাদের। শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা যদি একেবারে পাঠ্যসূচি থেকে শুরু করে ছেলে মেয়েদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা না বলতে পারি তা হলে সামনে এগিয়ে যেতে পারব না। একই উদ্দেশ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বাড়াতে হবে। তৃণমূল পর্যন্ত সাংস্কৃতিক কর্মকা- বাড়ানোর ওপরও জোর দেন তিনি। হতাশার সুরে বলেন, আমরা আগে যেভাবে সংস্কৃতিকর্মীদের জড়ো করতে পারতাম এখন পারি না।
স্থূল প্রচার সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, গণমাধ্যমে সারাদিন ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বা ‘বঙ্গবন্ধু’ ‘বঙ্গবন্ধ’ু করলে কাজ হবে না। পরিমিতি বোধটা বুঝতে হবে। নতুন প্রজন্ম যেন আকৃষ্ট হয় সেভাবে অনুষ্ঠানগুলো পরিকল্পনা করতে হবে।

‘প্রশাসনিক সাম্প্রদায়িততা’ নিয়েও কথা বলেন রামেন্দু মজুমদার। তিনি জানতে চান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চিন্তা আপনি কাদের দিয়ে বাস্তবায়ন করবেন? সরকারের প্রশাসনে এখনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তি আছে। পাকিস্তানী ভূত বিরাজ করছে। এসব দূর করার দাবি জানান তিনি। সেই সঙ্গে সামাজিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ারও আহ্বান জানান। 
সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, একটা জটিল পরিস্থিতি চলছে এখন। ঐক্যবদ্ধভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ না করলে রাষ্ট্র অসাম্প্রদায়িক হবে না। আমরা সংস্কৃতিকর্মীরা মনে করি, দেশে যে উন্নয়ন হয়েছে তা অভাবনীয়। কিন্তু চিন্তা চেতনা মননে আমরা দরিদ্র হয়ে যাচ্ছি। দারিদ্র্য দূর করতে হবে। এ জন্য গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত সাংস্কৃতিক জাগরণ প্রত্যাশা করেন তিনি। বলেন, রাজনীতি সাম্প্রদায়িক হলে এর প্রভাব সংস্কৃতির ওপরও পড়বে। তাই রাজনীতিকে আগে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত হতে হবে। 
সবশেষে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক। পূর্ববর্তি বক্তাদের কড়া সমালোচনা সহজভাবেই গ্রহণ করেন তিনি। অনেক অভিযোগও স্বীকার করে নেন। বলেন, অতীতে যতটুকু সাম্প্রদায়িকতা ছিল এখন তার থেকে বেশি। সরকারের আপস করার বিষয়টি অস্বীকার না করে তিনি বলেন, সরকারকে অনেক কিছু করতে হয়। কিন্তু একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সব সময় সক্রিয়।

ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারে যেই থাকুক না কেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে চলবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ গড়ার জন্য সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে কাজ করার আহ্বান জানান মন্ত্রী। বর্ণাঢ্য সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় অধিবেশন সমাপ্ত হয়। 

তৃতীয় অধিবেশনে সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও বিভাগীয় নেতাদের রিপোর্ট পেশ করেন। সমাপনী অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন কেন্দ্র ও বিভিন্ন জেলার প্রতিনিধিরা। এর পর অষ্টম জাতীয় সম্মেলনের প্রস্তাব, আগামী ৩ বছরের কর্মসূচি ঘোষণা এবং নতুন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী ও উপদেষ্টা পরিষদের নাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটে।

×