ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

খুলনায় চানরাতেও জমবে বিকিকিনি

প্রবীর বিশ্বাস

প্রকাশিত: ০১:১৮, ৫ এপ্রিল ২০২৪

খুলনায় চানরাতেও জমবে বিকিকিনি

পরিবারের জন্য ফুটপাতে পছন্দের জামাকাপড় কিনছেন মধ্যবিত্ত ক্রেতার

দিন চুক্তিতে শ্রম দেন খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা গ্রামের লিটন শেখ। সাত বছরের ছেলে, চার বছরের মেয়ে ও স্ত্রীকে সঙ্গে করে নিয়ে বাজারে এসেছেন ঈদের কেনাকাটা করতে। বাড়িতে আছেন বৃদ্ধা মা ও বিবাহযোগ্যা ছোট বোন। সবার জন্যই কিনতে হবে নতুন পোশাক। অল্প মূল্যে দোকান থেকে কেনাকাটাও প্রায় শেষ। ছোটখাটো দুই একটা বাকি; তবে নিজের জন্য এখনো কেনা হয়নি কোনো কিছুই।

পকেটের টাকাও প্রায় শেষ। একটা লুঙ্গি কিনতে হবে। কেননা বাড়ির যে দুটি লুঙ্গি পরে প্রতিদিন কাজে যান তার একটি সেলাই করার আর জায়গা নেই। তাই লুঙ্গি কিনলে ঈদে নতুন কিছু হবে সঙ্গে সারা বছরই কাজে লাগবে। এছাড়া অনেক দিনের শখ একটা নতুন পাঞ্জাবির। দুই গ্রাম দূরে শ্বশুরবাড়িতে যেতে হবে ঈদের সময়। জামাই বলে কথা, একটা নতুন পাঞ্জাবি না হলে আত্মীয়দের সামনে সম্মানহানি হবে। তাইতো পছন্দ আর সাধ্যের মধ্যে কিনতেই দোকানে ঘোরাঘুরি। খুলনায় চানরাতেও জমবে বিকিকিনি।
লিটন শেখের সঙ্গে দেখা হয় খুলনা নগরীর নিক্সন মার্কেটে। শত শত মানুষের ভিড় সঙ্গে মাঝ চৈত্রের ভ্যাপসা গরম। নিজের কাঁধে ছেলে মনির শেখ আর স্ত্রীর কোলে মেয়ে আরিফা খাতুন। এক দোকান থেকে যাচ্ছেন আরেক দোকানে। ঘোরাঘুরি করে ভীষণ ক্লান্ত। এসব কথা নিজেই বলছিলেন। দোকানে দোকানে ঘোরা বিষয়ে বলেন, যেটা পছন্দ হয় সেটার টাকা আমার কাছে নেই। একটা পছন্দ হয়েছিল, দামও ঠিক হয়ে যায় কিন্তু সাইজে মেলেনি। তাইতো আরও দুইটা দোকান দেখবো।

এক পর্যায়ে ছেলে মেয়ে স্ত্রীকে একটু ফাঁকা জায়গায় রেখে একাই বের হলেন। পিছু নিলাম তার। একটু দূরে থেকেই অবলোকন করতে থাকলাম। দুটির পরিবর্তে চারটি দোকান দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু তার পাঞ্জাবি কেনা হয়নি। এক সময় নিজেই বিরক্ত হয়ে দুঃখের সঙ্গে বললেন আজ আর কিনব না। বাড়িতে টিনের একটা কৌটায় জমানো কিছু টাকা আছে। সময় পেলে সেই টাকা সঙ্গে নিয়ে এসে একটা পাঞ্জাবি কেনার চেষ্টা করব। আল্লাহ্ সহায় থাকলে অবশ্যই নতুন লুঙ্গি পাঞ্জাবি পরেই ঈদের নামাজ পড়বো।

বাজারে ঘুরলে ঠিকই চোখে পড়বে এমন হাজারো মানুষের জীবন যুদ্ধের বাস্তবরূপ। দ্রব্যমূল্যের প্রতাপ আর সংগ্রামের সংসারে তারপরও অনেকে হাসিমুখে থাকতে চান সারাক্ষণ। তাইতো উৎসবে সন্তানে খুশির কথা সর্বাগ্যে; অন্য প্রিয়জনতো রয়েছে। এজন্যই কেনাকাটায় ব্যস্ত সব শ্রেণির মানুষ। সামর্থ্য অনুযায়ী যাচ্ছেন বিভিন্ন বাজারে। আগেই কিনতে হবে। কেননা বাড়ির পাশের অনেকেই কেনাকাটা করে ফেলেছেন। যা দেখে ছেলে মেয়ের মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। 
এ বছর মাঝ চৈত্রেই প্রতিদিন তাপমাত্রার পারদ ওঠানামা করছে। ইতোমধ্যে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মাঝারি তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে। তার ওপর বাজরের সরু ও ঘিঞ্জি গলি। মানুষের শরীর আর নিঃশ্বাসের গরমতো আছেই। মানুষের নিঃসরিত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হওয়ার জায়গা না থাকা আর দোকানে দোকানে বাতির ঝলকানির গরমও রয়েছে। সব মিলিয়ে এক অসহনীয় পরিবেশ। কিন্তু করার কিছুই নেই। বছরের সবচেয়ে বড় উৎসব বলে কথা। কেনাকাটা প্রতিবারই করতে হয়। এবারও কিছুটা সমাপ্ত হয়েছে। বাকিটা কিনতে আরও দুই দিন লাগবে। কেননা পেশাগত কাজ শেষ করে ইফতার সেরে তারপর আসতে হয়। এসব কথা বলছিলেন ব্যাংক কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন। 
সব মিলিয়ে খুলনার ঈদের বাজারগুলোতে মানুষের ভিড় রীতিমতো চোখে পড়ার মতো। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নি¤œমধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে দরিদ্র কিংবা হতদরিদ্র সব শ্রেণির মানুষ ভিড় করছেন নগরীর বিভিন্ন মার্কেটে। সরেজমিনে দেখা যায়, বিত্তবানরা ছুটছেন নগরীর নিউমার্কেট, খুলনা শপিং কমপ্লেক্স, জলিল সুপার মার্কেট কিংবা বিভিন্ন স্থানে থাকা নানা ব্রান্ডের দামি কোম্পানিগুলোর আউটলেটে। আর পরের শ্রেণির মানুষ যাচ্ছেন মশিউর রহমান মার্কেট, রব সুপার মার্কেট, ডাকবাংলো সুপার মার্কেট, এশা চেম্বার, হাজি মালেক চেম্বারসহ বিভিন্ন মার্কেটে।

এরপরের শ্রেণির মানুষের ভিড় রয়েছে নিক্সন মার্কেট, জব্বার মার্কেট, খাজা খান জাহান আলী মার্কেটসহ বড় বাজার সংলগ্ন বিভিন্ন দোকানে। তবে ফুটপাতের পোষাকের পশরা সাজিয়ে থাকা দোকানী কিংবা ভ্যানের ওপর ভ্রাম্যমান দোকান থেকেও স্বল্প আয়ের মানুষ সাধ ও সামর্থের সাথে সমন্বয় করে পরিবার পরিজনের জন্য নতুন পোষাক কিনছেন। শুধু পোষাকই নয় সাথে প্রয়োজনীয় অন্য জিনিসিও কিনতে দেখা যায় অনেককে।
তবে একটি মজার বিষয় হচ্ছে বাজারে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও এসেছেন নতুন পোষাক কিনতে। এমন একজন ক্রেতা বিজন বালার সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, ছোট দুটো ছেলে মেয়ে আছে। তাদের জন্য নতুন পোষাক কিনতে এসেছি। কেননা আশপাশের শিশুরা নতুন পোশাক পরিধান করবে, দেখে আমাদের ছেলেমেয়ের মনে প্রভাব পড়বে। তাই ওদের জন্য কিনতে এসেছি। আর মলতি ম-ল বললেন, আমার স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। অন্যদের সঙ্গে সে ঈদের সময় বোনাস পায়। সেটি পেয়েছে, সে কারণে সংসারের জন্য কিছু কেনাকাটা করতে এসেছি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায় নগরীর খালিশপুর, দৌলপুরসহ আশপাশের দোকানগুলোতেও ভিড় রয়েছে। এছাড়া উপজেলা বজার এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের হাটবাজারের পোষাকের দোকনগুলোতেও স্থানীয়রা সগৌরবে কেনাকাটা সারছেন।
শিক্ষক মফিজুর রহমান জানালেন, বাজারে এসেছি ছোট দুই নাতির জন্য কিছু কিনতে। এর আগে পরিকল্পনা মতো বাকি কেনাকাটা শেষ করেছি। তবে দর্জির কাছে দেওয়া আছে অনেক কিছু। তাকে দেখে বোঝাই গেলা রেডিমেড নয় কাপড় কিনে জামাপ্যান্ট বানিয়ে পরতে পছন্দ করেন তিনি। শুধু নিজের জন্যই নয়, ছেলেমেয়ের পোশাকের ক্ষেত্রেও সাধারণত এই পদ্ধতিই অবলম্বন করেন বলে জানালেন মফিজুর রহমান।
মশিউর রহমান মার্কেটের দর্জি ঋষিকেশ সাহা বলেন, ১৫ রোজার পরে আমরা নতুন করে আর কোন অর্ডার নিইনি। কেননা ঈদের পূর্ব দিন পর্যন্ত পণ্য ডেলিভারি দিতেই গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে। কেউ যদি দুইটা শার্ট কিংবা প্যার্ন্ট বানাতে দিয়েছেন তাকে বলেছি ঈদের আগে এক সেট আর পরে অন্যসেট দিব। এভাবে কেউ অর্ডার দিয়েছেন। এখন আমরা কোনোভাবেই নতুন অর্ডার নিচ্ছি না। ঘুরে দেখা গেল এমন অবস্থা দর্জি পাড়ার প্রায় সকল ঘরের।
এতো কিছুর মধ্যে হালিমা খাতুন জানালেন ভিন্ন কথা। তিনে বলেন, আংশিক কিনেছি। আর ঘুরে ঘুরে দেখছি নতুন নতুন কী কী কালেকসন এসেছে। তিনি আরও বলেন, চাঁদ রাত পর্যন্ত কেনাকাটা করব। কেননা শেষ দিকে এসে দোকানিরা বেশি ছাড়ে পণ্য বিক্রি করেন। তখন হয়ত একটু কম দামে পাব। তারপরও অন্যদের জন্য পছন্দ হলেই কিনে নিচ্ছি।
আরফাজ আলী জানালেন গ্রীষ্মকালের কথা মাথায় নিয়ে কেনাকাটর তালিকায় হালকা সুতি কাপড়ের পোশাক রেখেছি। এ বছর বসন্তকালেই যে গরম পড়েছে আর গ্রীষ্মকাল এলে কি হবে বুঝতে পারছি না। তাই পাতলা কাপড়ের পোশাক নিচ্ছি সকলের জন্য।
ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে বাহারী রং আর ডিজাইনের পোশাক দিয়ে দোকান সাজিয়েছি।

ঈদ উপলক্ষে নতুন পণ্যও এসেছে। দুই একদিন পর পর আসছে নতুন নতুন কালেকশন। এমন তথ্য দিলেন নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন কেনাবেচা ভালোই হচ্ছে। তবে ছোট ছোট মার্কেটগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় বেশি।
রাবেয়া বেগম বলেন, রোজার শেষ তিন দিনে সবচেয়ে বেশি ভিড় হবে তাই আগে থেকেই কেনাকাটা করছি। অনেক দাম, তারপরও সবাইকে কিছু কিছু দিতে হবে। তাই কিছু পণ্যের জন্য ছোট ছোট মার্কেটে যাচ্ছি। আর কিছু কেনাকাটায় ছাটখাট করছি।  
প্রবীর বিশ্বাস, খুলনা

×