ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের নেত্রী কুমুদিনী হাজং আর নেই

নিজস্ব সংবাদদাতা, নেত্রকোনা

প্রকাশিত: ০০:০১, ২৪ মার্চ ২০২৪

ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের নেত্রী কুমুদিনী হাজং আর নেই

কুমুদিনী হাজং

ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের নেত্রী কিংবদন্তি কুমুদিনী হাজং (৯২) আর নেই। শনিবার দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে দুর্গাপুর উপজেলার বহেরাতলি গ্রামের পাহাড়ি টিলায় নিজ বাড়িতে পরলোকগমন করেন এই ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী। কুমুদিনী হাজং দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। 
ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদাররা ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের ওপর ‘টংক প্রথা’ নামে খাজনা আদায়ের এক কালো প্রথা চালু করেছিল।

আর সেই খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন কৃষক সমাজ। তাই মণি সিংহের নেতৃত্বে ১৯৪৬-৫০ সালে গারো পাহাড় অঞ্চলের আদিবাসীরা সুসংগঠিত হয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক দুর্বার আন্দোলন, যা ইতিহাসে টংক আন্দোলন নামে পরিচিতি। কৃষকদের অধিকার রক্ষার এ আন্দোলনে জড়িত ছিলেন হাজং নারীরাও। এ কারণে তাদের ওপর নেমে এসেছিল অত্যাচারের খড়গ। 
১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি তেমনি এক বিভীষিকাময় ঘটনা ঘটেছিল সুসঙ্গ দুর্গাপুরের বহেরাতলি গ্রামে। আন্দোলনকারীদের দমন করতে ব্রিটিশ পুলিশের ‘ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার্স’ বাহিনী সেদিন ওই গ্রামে চালিয়েছিল নারকীয় তা-ব। ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছিল হাজং কৃষকদের বাড়িঘর। লুট করেছিল বহু নারীর সম্ভ্রম। এক পর্যায়ে তারা যখন লংকেশ্বর হাজংয়ের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী কুমুদিনী হাজংকে টেনে হিঁছড়ে ক্যাম্পে নিয়ে যেতে উদ্যত হয়Ñ তখন তাকে রক্ষায় দাঁ, কুড়াল, কোঁদাল ও লাঠি নিয়ে পুলিশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে শতাধিক নারী-পুরুষ। 
হাজং নেত্রী রাশিমণির নেতৃত্বে ওই সম্মিলিত হামলায় দুই পুলিশ সদস্য নিহত হয়। অন্যদিকে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন হাজং নেত্রী রাশিমণি ও সুরেন্দ্র হাজং। আহত হন অনেকে। হাজং নারী-পুরুষদের বিদ্রোহের মুখে টিকতে না পেরে ব্রিটিশ পুলিশ শেষ পর্যন্ত কুমুদিনীকে ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়।
গারোপাহাড়ের নিভৃত পল্লীর এ ঘটনা তখন সারাবাংলায় ঝড় তোলে। তদন্তে ছুটে আসেন কলকাতার এমএলএ জ্যোতি বসু, ব্যারিস্টার স্নেহাংশু ভট্টাচার্য ও প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রভাত দাশগুপ্তের মতো ব্যক্তিরা। কিন্তু ময়মনসিংহের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বেস্টিন তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলে তারা আর ওই গ্রামে যেতে পারেননি। পরবর্তীতে জ্যোতি বসু ‘রেইন অব টেরর ওভার দা হাজংস : এ রিপোর্ট অব দ্য এনকোয়ারি কমিটি’ নামে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ওই ঘটনার ওপর একটি রিপোর্ট উপস্থাপন করেছিলেন। 
এদিকে কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বর হাজং, লংকেশ্বরের ভাই ইসলেশ্বর হাজং ও গজেন্দ্র হাজংÑ এরা সবাই ছিলেন টংক আন্দোলনের সক্রিয় সংগঠক ও কর্মী। সে কারণে পরবর্তীতে কুমুদিনীও জড়িয়ে পড়েন আন্দোলনে। এমনকি পুলিশের দায়ের করা মামলার আসামি হয়ে বেছে নেন ফেরারি জীবন। ‘স্বরস্বতী’ ছদ্ম নামে বেশ কিছুদিন ফেরারি ছিলেন কুমুদিনী। টংক প্রথা উচ্ছেদ ও মামলা প্রত্যাহারের পর তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। 
ইতিহাসে স্থান করে নেওয়া প্রতিবাদ-বিদ্রোহের জীবন্ত প্রতীক সেই কুমদিনী হাজং পরবর্তী জীবনে বহেরাতলি গ্রামের প্রায় একশ ফুট উঁচু এক পাহাড়ি টিলায় অত্যন্ত কায়ক্লেশে জীবনযাপন করেছেন। জীবিকার প্রয়োজনে করেছেন দিনমজুরিও। তার স্বামী লংকেশ্বর হাজং মারা যান প্রায় ১৮ বছর আগে। অকালে মারা গেছেন এক ছেলেও।

ছেলে-মেয়েদের অভাব-অনটনের সংসারে জরা-ব্যধিসহ নানান বাস্তবতার সঙ্গে সংগ্রাম করেই কাটিয়েছেন শেষ জীবন। তবুও অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামে। চেয়েছেন শোষিত, বঞ্চিত ও মেহনতি মানুষের মুক্তি। ব্রিটিশবিরোধী এ সংগ্রামী নারীকে বিভিন্ন সময়ে অনন্যা শীর্ষদশ ২০০৩, ড. আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার ২০০৫, কমরেড মণিসিংহ স্মৃতি পদক ২০০৭ সহ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মানে ভূষিত করেছে বিভিন্ন সংগঠন। 
শনিবার রাত ৮টার দিকে স্থানীয় শশ্মানে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এর আগে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

×