ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

নারীর অলঙ্কার এবং কারিগর

হাফিজুর রহমান, মধুপুর, টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ০১:৪৭, ৮ ডিসেম্বর ২০২৩

নারীর অলঙ্কার এবং কারিগর

শাঁখা শিল্পীদের দিনকাল

শাঁখা শিল্পীদের দিনকাল
মানিকগঞ্জের ঘিওরে দুই শতাধিক পরিবার শাঁখা শিল্পের সঙ্গে জড়িত থেকে মানবেতর জীবনযাপন করছে। শতবর্ষের ঐতিহ্য বহন করা শাঁখা শিল্পের চাহিদা এবং যশ ছিল দেশজুড়ে। শুধু অলঙ্কার হিসেবেই নয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের নারীদের হাতে পড়ার শাঁখার স্থান সর্বাগ্রে। আর্থিক সংকটের মধ্যেও পৈত্রিক ব্যবসা হিসাবে অনেকে ধরে রেখেছেন এ ব্যবসা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করা হলে এখানকার শিল্পীদের তৈরি শাঁখা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের বাজারেও সমাদৃত হবে।
জানা গেছে, উনিশ শতকের শুরুর দিকে ছোট বরুরিয়া গ্রামের সেন, দত্ত ও কর পরিবার হাতে ব্যবহারের শাঁখা তৈরি কাজ শুরু করেন।

তাদের পূর্ব পুরুষরা শাঁখারীবাজার ও চট্টগ্রাম থেকে এ কাজ শিখেছিলেন। শুরুর দিকে তারা এলাকায় ঘুরে ঘুরে শাঁখা বিক্রি করতেন। পরে নাম যশ ছড়িয়ে পরার পর বাজার প্রসারিত হয়। শতাধিক  পরিবারের শিল্পীরা এখনো সুনিপুণভাবে শাঁখা তৈরি করে নিজেদের দক্ষতার দৃষ্টান্ত রেখে আসছেন। এই শিল্পকে পরিচিত করে তুলতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সরেজমিনে দেখা যায়, ছায়াঘেরা ছোট বরুরিয়া গ্রামের শাঁখাপল্লীতে সারাদিন ঠুং ঠাং আর ঝিঁঝিঁ পোকার মতো শঙ্খ কাটার আওয়াজ।

পুরুষদের পাশাপাশি বাড়ির নারী ও শিশুরাও এ কাজে সহায়তা করছেন। পাইকার ও খুচরা ক্রেতাদের সঙ্গে দরদাম চলছে। এই শাঁখা তৈরি করেই সারা বছর সংসার চলে এখানকার ব্যবসায়ী ও কারিগরদের। ঘিওরের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা দোলা রায় বলেন, শত বছরেরও বেশি সময় ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ঘিওরের শঙ্খশিল্প। এখান থেকে আমরা অর্ডার দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের শাঁখা ক্রয় করি। এছাড়াও বিয়ে, পূজা-পার্বণ উপলক্ষে এখানকার শিল্পীদের হাতে তৈরি সুনিপুণ শাঁখার ব্যবহার হয় বেশি।
শঙ্খশিল্পী প্রহলাদ সেন বলেন, শ্রীলঙ্কা ও ভারত থেকে আসা শঙ্খ ঢাকা ও খুলনার মহাজনদের কাছ থেকে আমরা কিনে আনি। সেই শঙ্খ মেশিনে কাটার পর হাতের কারুকাজে তৈরি হয় বিভিন্ন আকৃতি ও ডিজাইনের শাঁখা। সাধারণত প্রতি জোড়া শাঁখা ৩শ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। কারিগর শক্তি কর ও হরিপদ কর বলেন, অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা কমে যাওয়া এবং বাইরে থেকে আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় ঐতিহ্য ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছি।
ঘিওর লোকনাথ শঙ্খ শিল্পালয়ের মালিক সোপেন দত্ত বলেন, এখানকার শাঁখা ভারতে ও ইউরোপের হিন্দু ধর্মাবম্বীরা কিনে নিয়ে যান। ঢাকা, ও স্থানীয় মহাজনদের অর্ডার অনুযায়ী নকশা আর ডিজাইনের শাঁখা তৈরি করি। আমাদের শাঁখা ব্যবসার কদর ও সম্মান ছিল সারাদেশে। কিন্তু পর্যাপ্ত পুঁজির অভাবে আধুনিক যন্ত্রপাতি কিনতে পারছি না। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। গৃহবধূ দীপা সেন বলেন, বড় শঙ্খ কেটে শাঁখা তৈরি করার পর যে শঙ্খগুঁড়া জমে, তা নববধূ ও কিশোরীরা মুখের দাগ দূরীকরণের জন্য কিনে নেন। পূজার কাজে ব্যবহার করার জন্য নকশা করা আস্ত শঙ্খও তৈরি করি। বাড়ির পুরুষদের সঙ্গে আমরাও নকশী কাজে সহায়তা করি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, বাংলার লোকশিল্পের অন্যতম এই গৌরবোজ্জ্বল শাঁখাশিল্প। ঘিওরের এই শাঁখাশিল্প সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং অনলাইন বাজার সৃষ্টিতে উপজেলা প্রশাসন থেকে যাবতীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ বিষয়ে কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে।
রামপ্রসাদ সরকার দীপু , ঘিওর, মানিকগঞ্জ।
ইমিটেশন গহনা 
ঝিনাইদহের মহেশপুরে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ইমিটেশনের গহনা তৈরির কাজ। ছোটবড় কারখানার পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রামের নারী-পুরুষ নিজেদের হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় তৈরি করছেন কানের দুল, সিতাহার, হাতের বালা সহ হরেক রকমের গহনা। তবে নতুন ডিজাইনের ভালো মানের গহনা তৈরির মাধ্যমে বিশ্ববাজার ধরতে পারলে এ শিল্প দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে বিসিক কর্মকর্তা দাবি করেন।
ঝিনাইদহের সীমান্তবর্তী উপজেলা মহেশপুরের নওদা গ্রামের বাসিন্দা ইমরান হোসেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপকরণ সংগ্রহ করে তৈরি করছেন বিভিন্ন ডিজাইনের কানের দুল। প্রায় ১৫ বছর ইমিটেশনের গহনা তৈরি করছেন তিনি। তার বাড়িতে ১০ জন কারিগরের কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হয়েছে। এখন তার মাসিক আয় গড়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। ১৯৯৮ সাল থেকে মহেশপুরে প্রথম যাত্রা শুরু হয় ইমিটেশন গহনা তৈরির কাজ। ঝিনাইদহের মহেশপুরে প্রতি বছর গড়ে ১৬ কোটি টাকার ইমিটেশনের গহনা তৈরি করা হয়। কানের দুল বেশি তৈরি করা হলেও খুবই অল্প পরিসরে হাতের বালা, সিতাহার, নেকলেস তৈরি করা হয়।
ইমরান হোসেন জানান, শুধু আমি না এভাবে উপজেলার নওদা গ্রাম, বৈচিতলা, জলিলপুর, মহেশপুর পৌর এলাকাসহ বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ৪ হাজার পরিবার বিভিন্ন কারখানা ও ব্যক্তিগতভাবে জড়িত ইমিটেশনের গহনা তৈরির সঙ্গে। সাধারণত গহনা তৈরির জন্য তার, পাত, ডাইস, পুথি, চেন, রেজি, পাইনসহ অন্যান্য উপকরণ স্থানীয় বিভিন্ন দোকান এবং কারখানার মালিক থেকে ক্রয় করেন কারিগররা। এরপর ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে ঝালাইয়ের কাজ শেষে রং করে  বিক্রির উপযোগী হয় ইমিটেশনের গহনা। পুরুষের পাশাপাশি সংসারের কাজ সামলিয়ে নারীরাও তৈরি করেন ইমিটেশনের গহনা। যা আয় হয় তা দিয়ে ভালোই চলে তাদের সংসার।

এখানে তৈরি ইমিটেশনের গহনা সরবরাহ করা হয় দেশের বিভিন্ন জেলায়। সরকার যদি কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতা করে তাহলে বিদেশে রপ্তানি সম্ভব বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। এলাকার বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম জানান, আমার জানামতে পৌর এলাকার প্রায় ৪ হাজার পরিবারের মানুষ বিভিন্ন কারখানায় ইমিটেশনের গহনা তৈরির সঙ্গে জড়িত আছে। এলাকার সাধারণ মানুষ ইমিটেশনের গহনা তৈরির কারখানায় কাজ করে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। ঝিনাইদহ বিসিক শিল্পনগরীর উপ-ব্যবস্থাপক সেলিনা রহমান জানান, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) এর এই কর্মকর্তা বলছেন, দেশের অভ্যন্তরে বাজার ব্যবস্থা আরও সম্প্রসারিত হলে এবং যদি গার্মেন্টস পণ্যের মতো বিশ্ববাজার ধরা যায় তাহলে দেশের অর্থনীতিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখবে এই শিল্প।    এম রায়হান, ঝিনাইদহ

 সফল পাঁচ নারী
কষ্টের জীবন সংগ্রাম লড়াইয়ের পথ অতিক্রম করে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর পাঁচ নারী উদ্যোক্তা আজ সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছেন। সরেজমিনে কথা বলে জানা গেছে, নারী জয়িতা ধনবাড়ী উপজেলার পৌর শহরের কিশামত গ্রামের ফজর আলীর ছেলে বাবলু মিয়ার স্ত্রী ময়না বেগম। তিনি তার বাবার ঘরে বড় মেয়ে সন্তান হওয়ায় তার মাকে সহ্য করতে হয়েছে অনেক যন্ত্রণা। পরে ১২ বছর বয়সেই  একই এলাকার বাবলু মিয়ার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন বাবা। বিয়ের পরে স্বামী বাবলু মিয়া তেমন কোন কর্ম না করায় শ^শুর বাড়িতে অর্ধহারে অনারে দিনপার করতে হয় ময়না বেগমের। এর মধ্যেই তাদের ঘরে জন্ম হয় এক কন্যাসন্তানের। কন্যাসন্তান হওয়ার পরে  শাশুড়ি ও ননদের নির্যাতন বেড়ে যায়।

সেই সময়ে একদিন বাবার বাড়িতে গেলে সেখানে নিজেরা করি নারী কর্মীর মিটিংয়ে উপস্থিত হন। সেই মিটিংয়ে নারী কর্মী তার দুঃখের গল্প শুনে তাকে ভেঙ্গে না পড়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ দেন। তার পরামর্শে সমিতিতে ভর্তি হয়ে কিছু টাকা জমা করে ও তার মায়ের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা নিয়ে মোট পঁচিশ’শ টাকা দিয়ে টাঙ্গাইলের করটিয়া হাট থেকে এলাকার অন্য নারী কাপড় ব্যবসায়ীদের মতো সে কাপড়ের ব্যবসা শুরু করেন। এলাকায় ফেরি করে কাপড় বিক্রি করেন তিনি। পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় সেই ব্যবসায় টিকতে পারেনি বেশিদিন। কোনো উপায় না পেয়ে ময়না বেগম মধুপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিস থেকে ১০ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে হাঁস মুরগির টিকা প্রদানের কাজ শুরু করেন।
২ বছর কাজ করার পরে মেয়ে বড় হতে থাকে পরে সেই দুই বছরে কষ্টার্জিত কিছু টাকা ও গ্রামীণ ব্যাংক থেকে এক হাজার ৫শ টাকা লোন নিয়ে স্বামীর বাড়ির পাশে আমবাগান মোড়ে একটি মনোহারীর দোকান দেন। সেই দোকানের খবর পেয়ে স্থানীয় হুজুর ও সমাজের লোকজন মেয়ে মানুষ দোকান করতে পারবে না এটা শরিয়তবিরোধী বলে ক্ষিপ্ত হয়ে দোকান বন্ধ করে দেন। আমি সকল বাধা উপেক্ষা করে স্বামীকে বুঝিয়ে ব্যবসায় তাকে মনোযোগী করিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করাই। বর্তমানে সেই ছোট্ট দোকান আস্তে আস্তে বড় দোকানে পরিণত হয়েছে। 
শুধু ময়না বেগমই নয় দারিদ্র্যের গল্প জয় করে সমাজের নারীদের এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন উপজেলার কয়ড়া গ্রামের গৃহবধূ আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী জামিলা বেগম। জামিলা বেগমের পড়া-লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণ থাকলেও দরিদ্র ঘরের মেয়ে হওয়ার কারণে তিনি পড়াশোনা করতে পরেননি। তাকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পরেই ১৩ বছর বয়সে একই এলাকায় বিয়ে দেন। পড়াশোনা না করতে পারলেও নিজেরা করি ভূমিহীন সমিতির মাধ্যমে দলীয় কর্মকা-সহ সমাজে নারীর উন্নয়নের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি সমাজে বাল্যবিয়ে, দারিদ্র্য ও অসহায়ের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। 
পৌরসভার চাতুটিয়া গ্রামের বীরমুক্তিযোদ্ধা মোকছেদ আলীর মেয়ে মোর্শেদা বেগম দরিদ্র পরিবারে চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন। বড় পরিবারে একমাত্র শিক্ষক বাবা সামান্য বেতন দিয়ে কষ্টে পরিবারের ব্যয়ভার করেছিলেন। ওই সময়ে এসএসসি পাস করার পরেই মোর্শেদাকে বিয়ে দেন পাশের যদুনাথপুর ইউনিয়নের পাথালিয়া গ্রামের সোহেল রানার সঙ্গে। বিয়ের পরেও পড়াশোনা চালিয়ে যান তিনি। পরে বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষা দিয়ে শেষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি হয় তার। বর্তমানে তিনি এলাকার অসহায় দরিদ্র ছেলে মেয়েদের শিক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে আসছেন। তিনি বর্তমানে ধনবাড়ী পৌর শহর এলাকায় নিজস্ব জমি ক্রয় করেছেন। একটি ছেলে সন্তান ও স্বামী নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছেন তিনি।
নিজবর্ণি গ্রামের মোতাহের আলী খন্দকারের মেয়ে মোছা. নূরজান বেগম। দারিদ্র্যতার কারণে প্রাথমিকের শিক্ষালাভের পরেই বিয়ে দেন তার পরিবার। বিয়ের পরে স্বামী পাট অধিদপ্তরের চাকরিজীবী হওয়ায় নূরজাহান বেগমকে ধোপাখালী হাই স্কুলে ভর্তি করে দেন ষষ্ঠ শ্রেণিতে। 
জীবনে সংগ্রাম পিছু ছাড়েনি অরেক অদম্য মেধামী নারী পৌরসভার কিশামত ধনবাড়ী এলাকার মোছওয়ার আহম্মেদ সিদ্দিকীর মেয়ে তাহমিনা সিদ্দিকার। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। বড় পরিবার ও অভাবের সংসার হওয়ার কারণে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটাতে হতো তার। 
হাফিজুর রহমান, মধুপুর, টাঙ্গাইল

×