ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

নালিতাবাড়ীর সুতানাল দীঘি

এম. সুরুজ্জামান, নালিতাবাড়ী, শেরপুর

প্রকাশিত: ০১:২৭, ১৭ নভেম্বর ২০২৩

নালিতাবাড়ীর সুতানাল দীঘি

নালিতাবাড়ীর সুতানাল দীঘি

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার শালমারা গ্রামে অবস্থিত সুতানাল নামের এক দীঘি। কারও মতে কমলা রানী বা সুতানাল, আবার কারও কাছে রানী বিরহিণী নামে দীঘিটি পরিচিত। তবে প্রাচীনকালের এই দীঘিটি এলাকায় সুতানাল দীঘি নামে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। বিশাল এই দীঘির নামকরণে রয়েছে চমকপ্রদ প্রাচীন কাহিনী। ৬০ একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল এ দীঘিটি। বর্তমানে এই দীঘিটি সংকুচিত হয়ে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৯ একরে। এটি এলাকার প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন বলে প্রবীণরা জানান। দীঘিটিকে একনজরে দেখার জন্য বছরের প্রায় প্রতিদিন উৎসুক মানুষ ছুটে আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। 
নালিতাবাড়ী উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে উত্তরে ভারত সীমান্তবর্তী কাকরকান্দি ইউনিয়নের শালমারা গ্রামে অবস্থিত এ সুতানাল দীঘি। ঐতিহাসিক এ দীঘিটি কে কখন কোন উদ্দেশ্যে খনন করেছিলেন তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি আজও। অনেকেই বলেন, মোঘল আমলের শেষের দিকে এ গ্রামে কোনো এক সামন্ত রাজার বাড়ি ছিল। আবার কেউ বলেন, এখানে একটি বৌদ্ধ-বিহার ছিল। কথিত আছে, রানি বিরহিণী সামন্ত রাজাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তুমি কী আমাকে ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে কিছু দিতে চাও? তাহলে এমন কিছু দান কর যা যুগ যুগ ধরে মানুষ আমাকে মনে রাখবে। তখন রাজবংশী সামন্ত রাজা রাণীকে খুশি করার জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন।

চরকীর সাহায্যে অবিরাম একদিন একরাত সুতা কাটা হবে। দৈর্ঘ্যে যে পরিমাণ সুতা হবে সেই পরিমাণ সুতার সমান লম্বা এবং প্রশস্ত একটি দীঘি খনন করা হবে। ওই দীঘির জল জনগণ ব্যবহার করবে আর তোমাকে স্মরণ করে রাখবে। রানির সম্মতিতে পরিকল্পনা অনুযায়ী দীঘির খনন কাজ শুরু হলো। দিনের পর দিন খনন কাজ চলতে থাকে। নির্মিত হয় বিশাল এক দীঘি। এই দীঘির এক পাড়ে দাঁড়ালে অন্য পাড়ের মানুষ চেনা যায় না। 
আরও কথিত আছে, খননের পর দীঘিতে জল উঠেনি। জল না ওঠায় নিচের দিকে যতটুকু খনন করা সম্ভব ততটুকু খনন করা হয়। তবু জল না ওঠায় রাজা প্রজা সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েন। অবশেষে কমলা রানি স্বপ্নাদেশ পান গঙ্গাপূজা কর নর বলি দিয়া, তবেই উঠিবে দীঘি জলেতে ভরিয়া। স্বপ্ন দেখে রাণী চিন্তিত হয়ে পড়েন। নরবলি দিতে তিনি রাজি হলেন না। নর বলি না দিয়ে রানি গঙ্গামাকে প্রণতি জানান। মহাধুমধামে বাদ্য বাজনা বাজিয়ে দীঘির মধ্যে গঙ্গা পূজার বিরাট আয়োজন করা হয়। কমলা রাণী গঙ্গামায়ের পায়ে প্রার্থনা জানিয়ে বলেন, কোনো মায়ের বুক করিয়া খালি! তোমাকে দিব মাতা নরবলি? আমি যে সন্তানের মা আমায় করিয়া রক্ষা কোলে তুলিয়া নাও।

মা পূর্ণ কর তোমার পূজা অর্চনা। তখন হঠাৎ বজ্রপাতের মতো শব্দে দীঘির তলায় মাটির ফাটল দিয়ে জল উঠতে লাগল। লোকজন তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে দীঘির পাড়ে উঠল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে দীঘির টইটম্বুর জলে রানী বিরহিণী তলিয়ে গেলেন দীঘির জলে। কমলা রানীর আর তীরে উঠে আসা সম্ভব হয়নি। রাজার কাছ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেলেন তিনি। সেই থেকে কমলা রানী বা সুতানাল নামেই এ দীঘি পরিচিতি পায়।
জানা গেছে, খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে শালমারা গ্রামে সশাল নামের এক গারো রাজা রাজত্ব করতেন। শালমারা গ্রামের উত্তরে গারো পাহাড় পর্যন্ত তার অধীনে ছিল। শামস উদ্দিন ইলিয়াস শাহ তখন বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন। ১৩৫১ সালে তিনি সশাল রাজার বিরুদ্ধে সেনা প্রেরণ করেন। সশাল রাজার রাজধানী ছিল শালমারা গ্রামে। রাজা পলায়ন করে আশ্রয় নেন জঙ্গলে। পরবর্তীকালে গারো রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর রাজা সশাল শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দীঘির মাঝখানে ছোট একটি ঘর তৈরি করে চারদিকে পরিখার মতো (খাল) খনন করেন।

রাজা যখন সেখানে অবস্থান করতেন তখন তার বাহিনী বড় বড় ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে চারদিক পাহারা দিতেন। কালক্রমে এই ভূখ-টি দীঘিতে রূপ নেয়। রাজার শেষ বংশধর ছিলেন রানী বিরহিনী। দীঘিটি রানী বিরহিণী নামে পরিচিতি পায়। ১৯৪০ সালে সরকারি ভূমি জরিপে দীঘিটিকে রানী বিরহিনী নামেই রেকর্ড করা হয়েছে। তবে দীঘিটি খননের সত্যিকারের দিনক্ষণ ইতিহাসে জানা না গেলেও এটা যে একটা ঐতিহাসিক নিদর্শন এ বিষয়ে এলাকার কারও কোনো সন্দেহ নেই। 
দীঘির পাড়ে বসবাসকারী মোফাজ্জল হোসেন জানান, ১৯৮৩ সালে দীঘিটিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে মধ্যমকুড়া সুতানাল দীঘি ভূমিহীন মজাপুকুর সমবায় সমিতি। ১৯৮৪ সালে সমিতিটি রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে এই সমিতির সদস্য সংখ্যা ১১৮ জন। সমিতির সব সদস্যরা দীঘির পাড়ে ঘরবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করে আসছেন। তিনি জানান, দীর্ঘদিন দীঘিটি পরিত্যক্ত থাকায় জলের ওপর শৈবাল জমে গিয়ে গজিয়ে ঘাস উঠে যেত। যার ওপর দিয়ে গরু অবাধে ঘাস খেতে পারত। ১৯৭২ সালে প্রথম দীঘিটি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে সংস্কার করার পর এখন এই দীঘিতে মাছ চাষসহ গৃহস্থালির কাজে পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। 
ওই সমিতির সদস্য ও এলাকার বাসিন্দা প্রবীণ ব্যক্তি আশরাফ আলী, শ্রমিক মফিজুল ইসলাম, শিক্ষার্থী ফিরুজ আলম বলেন, এই দীঘি খননের সঠিক ইতিহাস আমরা কেউ জানি না। তবে বাপ দাদার আমল থেকেই আমরা এই দীঘিরপাড়েই বসবাস করছি। দীঘিটিকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর অক্টোবর মাসে এখানে শৌখিন মৎস্য শিকারিদের মিলন মেলায় পরিণত হয়। সারাদেশ থেকে আসা মৎস্য শিকারীরা সমিতির দেওয়া টিকিটের মাধ্যমে মাছ শিকার করে থাকেন। এ দীঘির মাছ খুব সুস্বাদু বলে বেশ প্রশংসাও রয়েছে। ঐতিহাসিক এ দীঘিকে কেন্দ্র করে ভূমিহীনদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিবছর দূর-দূরান্ত থেকে শৌখিন মৎস্য শিকারী ও উৎসুক মানুষের আনাগোনায় পরিবেশ হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। কালের সাক্ষী হয়ে আজও রয়েছে এই সুতানাল দীঘি। 
দীঘিরপাড় এলাকার বাসিন্দা জমির আলী বলেন, ঐতিহাসিক এই সুতানাল দীঘিটি দেখার জন্য প্রায় সারা বছর দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এসে থাকে। এটিকে যদি সরকারি ব্যবস্থাপনায় সংরক্ষণ করে আরও সাজিয়ে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায় তাহলে সরকার আরও বেশি রাজস্ব পাবে।
এম. সুরুজ্জামান, নালিতাবাড়ী, শেরপুর

×