ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৩, ২৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩০

মহেড়া জমিদারবাড়ি

 নিরঞ্জন পাল, মির্জাপুর

প্রকাশিত: ০১:৩৬, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩

মহেড়া জমিদারবাড়ি

মহেড়া জমিদারবাড়ির সিংহদ্বার 

দেশের বিনোদন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে মহেড়া জমিদারবাড়ি অন্যতম একটি মর্যাদাশীল বিনোদন কেন্দ্র। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের নিয়ন্ত্রণাধীন শৌখিন পশ্চিমা ও প্রাচ্যের শৈল্পিক কারুকার্যে ভরপুর বিশাল এই মহেড়া জমিদারবাড়ি। দর্শনার্থীরা মির্জাপুর উপজেলার মহেড়া নামক স্থানে এই বিনোদন কেন্দ্রটিতে এসে উপভোগ করা ছাড়াও জানতে পারবেন মহেড়ার জমিদারদের কোন সময় কিভাবে এখানে গোড়াপত্তন ঘটে এবং তাদের ইতিহাস। স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে নান্দনিক শৈল্পিক কারুকার্যখচিত চার তরফের জমিদারদের চারটি ভবন। এর সঙ্গে রয়েছে স্ব স্ব কাচারীবাড়ি। বড় তরফের পিছনে ছিল বিশাল দুর্গামন্দির। বর্তমানে সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে সুইমিংপুল।

তৃতীয় তরফের পিছনে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বড় একটি বৈঠকখানা। পুরো জমিদার বাড়িটি ঘিরেই রয়েছে মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং দেশী-বিদেশী ফুলের বাগান। শিশুদের আকৃষ্ট করতে রয়েছে নানা ধরনের কৃত্রিম পশু-পাখির প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য। এছাড়াও রয়েছে শিশুদের বিনোদনের জন্য শিশুপার্ক। প্রত্যেক তরফের সামনে রয়েছে প্রশস্থ রাস্তা ও ফুলের বাগান। বাড়ির প্রবেশ পথে রয়েছে দুটি সিংহদ্বার। সর্ব সামনে দক্ষিণে রয়েছে বিশাখা সাগর নামে বিশাল একটি দীঘি। জমিদারবাড়ির পিছনের দিকে রয়েছে আরও একটি দৃষ্টিনন্দন পুকুর এবং পিকনিকের ব্যবস্থা।
মহেড়া জমিদার বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা পরিবার পরিজন নিয়ে বেড়াতে এসেছেন জমিদার বাড়ি দেখতে এবং জানতে। পাঁচ বছরের উপরে বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রবেশ মূল্য জনপ্রতি ১০০ টাকা। জমিদারবাড়ির ইতিহাস কারুকাজ সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে দর্শনার্থীরা উৎফুল্ল এবং মুগ্ধ। 
যেভাবে জমিদারদের গোড়াপত্তন ॥ ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর উপজেলার মহেড়া ইউনিয়নের মহেড়া নামক স্থানে প্রায় ১২শ’ শতাংশ জমির ওপর চার তরফের চার জমিদার চারটি ভবন নির্মাণ করে তাদের জমিদারী কার্যক্রম শুরু করেন। জমিদার বিদু সাহা, বুদ্দু সাহা, হরেন্দ্র সাহা ও কালীচরণ সাহা জমিদারের অংশীদারী ছিলেন। জনশ্রুতি রয়েছে মহেড়ার জমিদাররা ছিলেন কলকাতার ডালের ব্যবসায়ী।

অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে মহেড়াতে বসবাস শুরু করেন। ডালের ব্যবসার পাশাপাশি লগ্নি ব্যবসা করে প্রচুর টাকা পয়সা উপার্জন করে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করলে এদের ছেলেরা করটিয়ার ২৪ পরগনার জমিদারের কাছ থেকে একটি অংশ কিনে নেন। জমিদার বিদু সাহা, বুদ্দু সাহা, হরেন্দ্র সাহা ও কালীচরণ সাহার পরবর্তী বংশধররা রায় চৌধুরী পদবী লাভ করেন। ঊনবিংশ শতকের চল্লিশ দশকে জমিদারী প্রথার বিলুপ্তি হয়। দেশ বিভাগের পর জমিদারদের অধিকাংশ সদস্য কলকাতায় পাড়ি জমান।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা জমিদার বাড়িসহ পুরো গ্রামে হামলা চালায় এবং লুটপাট করে। শুধু তাই নয়, পাকি বাহিনী জমিদারবাড়ির কুলবধু ও পুরুহিতসহ পাঁচ জনকে গুলি করে হত্যা করে বলে ওই গ্রামের মুরুব্বিরা জানিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মান্নান পরিত্যক্ত জমিদারবাড়িতে পুলিশ ট্রেনিং স্কুল স্থাপন করেন। যা ১৯৯০ সালে টাঙ্গাইল পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার হিসেবে উন্নীত করা হয়।
এই বিশাল জমিদার বাড়িতে রয়েছে চারটি তরফ। তরফগুলোর মধ্যে রয়েছে বড় তরফ (মহারাজ লজ), দ্বিতীয় তরফ (আনন্দ লজ), তৃতীয় তরফ (চৌধুরী লজ) ও ছোট তরফ (কালীচরণ লজ)। জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করতে রয়েছে দুটি সিংহদ্বার। চারটি প্রাসাদের তিনটিই দ্বিতল ভবন। শুধু কালীচরণ ভবনটি একতলা।
বড় তরফ ॥ চার তরফের সর্ব পশ্চিমে অবস্থান বড় তরফের। বড় তরফের ভবনটির নাম মহারাজ লজ। মহারাজ লজটি জমিদারবাড়ির সর্ববৃহৎ স্থাপনা। এই দ্বিতল ভবনটিতে আছে সুপ্রশস্ত ১০টি কক্ষ। পশ্চিমা স্থাপত্যকলায় ভবনটি নির্মিত। ভবনটির পিছনে ছিল নাট মন্দির ও দুর্গা মন্দির। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে বড় তরফের ভবনটি নির্মিত হয়। গজেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী ছিলেন বড় তরফের কর্ণধার। ব্রিটিশ আমলে তিনি ছিলেন একজন বিচারক। তিনি বাঘ হরিণ ঘোড়া ময়ূর টিয়া ও ময়নাসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী লালন পালন করতেন। বর্তমানে ভবনটি পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের দেশী-বিদেশী প্রশিক্ষকদের ডরমিটরী হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।
দ্বিতীয় তরফ ॥ বড় তরফ সংলগ্ন দ্বিতীয় তরফের ভবনের অবস্থান। এই ভবনটির নাম আনন্দ লজ। একই সময় নির্মিত ভবনটিতে রয়েছে ১২টি কক্ষ। শৈল্পিক কারুকাজে ভরপুর ভবনটির নিচতলা ট্রেনিং সেন্টারের প্রশাসনিক অফিস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এই তরফের প্রধান কর্তা ছিলেন বকুল রায় চৌধুরী। তিনি ছিলেন একজন সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি। যাত্রাপালা গানবাজনা ও থিয়েটার নিয়ে তিনি সব সময় ব্যস্ত থাকতেন। এই তরফের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি ছিলেন রাধিকা লাল রায় চৌধুরী। তিনি ভারত বর্ষের দ্বিতীয় সুদর্শন পুরুষ হিসেবে ব্রিটিশ কর্তৃক নির্বাচিত হন বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
তৃতীয় তরফ ॥ পশ্চিমা ও প্রাচ্যের শৈল্পিক কারুকাজে নির্মিত তৃতীয় তরফের ভবনটি। এই ভবনের নাম চৌধুরী লজ। এই তরফের প্রধান ব্যক্তির নাম সুধীন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী। ভবনটিতে ছয়টি কক্ষ রয়েছে। ভবনটি অফিস হিসেবে ব্যবহার করছে ট্রেনিং সেন্টার কর্তৃপক্ষ।
ছোট তরফ ॥ ছোট তরফের নাম হলো সিংহদ্বার ও কালীচরণ লজ। জমিদার কালীচরণ সাহা ভবনটি নির্মাণ করেন। এই ভবনের সামনে ছিল পূজা ম-প। সেখানে রানী জমিদার নন্দন নন্দনীগণ পূজা নিবেদন করতেন। বছরের সব সময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এই জমিদার বাড়িতে বিনোদন পিপাসুরা বেড়াতে আসেন। তবে ঈদ ও দুর্গা পূজার সময় এই বিনোদন কেন্দ্রটিতে দর্শনার্থীদের ভিড়ে এক উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়।
পিকনিক বা বনভোজনের ব্যবস্থা ॥ বিনোদন কেন্দ্রটিতে রয়েছে পিকনিক বা বনভোজনের ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জানা গেছে, কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বেশি লোক নিয়ে পিকনিকের আয়োজন করতে চাইলে কর্তৃপক্ষকে আগে অবহিত করতে হবে। সারা দিনের জন্য চেয়ার টেবিলসহ পিকনিকের শেড ভাড়া ১০ হাজার টাকা। এছাড়া ট্রি হাউস নামে আরও একটি শেড রয়েছে যার ভাড়া ১৫ হাজার টাকা। এখানে অনুষ্ঠানসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা যাবে। খাবার নিজেরা বাইরে থেকে ব্যবস্থা করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া জমিদারবাড়ির বাইরে কাউন্টার সংলগ্ন পিটিসি কো-অপারেটিভ সোসাইটি (বিকিকিনি) নামে রেস্টুরেন্ট রয়েছে। 
কিভাবে যাবেন মহেড়া জমিদারবাড়ি ॥ রাজধানী ঢাকা থেকে মহেড়া জমিদারবাড়ির দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে টাঙ্গাইলের যে কোন বাসে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পিটিসি বা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার রোড নামতে হবে। 
ডিআইজির বক্তব্য ॥ টাঙ্গাইলের মহেড়া পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের ডিআইজি নজরুল ইসলাম এনডিসি বলেন, বিভিন্ন জমিদারবাড়িসহ দেশের অনেক স্থাপত্যকলা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মহেড়া জমিদারবাড়িটি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করায় তার সকল স্থাপত্যকলা ও ঐতিহ্য নিয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে।     নিরঞ্জন পাল, মির্জাপুর