ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে শুক্রবার রাত থেকে উৎপাদন স্থগিত

রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র আট মাসে সাতবার বন্ধ

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:৫৬, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩

রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র আট মাসে সাতবার বন্ধ

আট মাসে সাতবার বন্ধ

দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে বেশ ঘটা করেই উদ্বোধন করা হয়েছিল দেশের অন্যতম বড় রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রথম ইউনিট উৎপাদনেও এসেছে প্রায় আট মাস আগে। কিন্তু আট মাসে যান্ত্রিক ত্রুটিসহ কয়লা সংকটে সাতবার বন্ধ হয় এর উৎপাদন। ভাদ্রের তালপাকা গরমে যখন বিদ্যুতের চাহিদা চরমে তখন এত বড় কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ থাকলে স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ সরবরাহে। সর্বোপরি উৎপাদন শুরুর পরও বারবার নানা কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই কেন্দ্রটিকে গলার কাঁটা হিসেবেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা যায়, গত শুক্রবার রাত ১১টায় আবারও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কেন্দ্রটির উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। কেন্দ্রের ছাঁই নির্গমন প্রক্রিয়ায় ত্রুটির জন্য এবার এটি সাময়িক বন্ধ রাখা হয়েছে জানিয়ে কেন্দ্রটির ব্যবস্থাপক আনোয়ারুল আজিম জনকণ্ঠকে বলেন, কিছু কারিগরি ত্রুটির কারণে উৎপাদন সাময়িক বন্ধ রয়েছে। ঠিক হতে কতদিন সময় লাগবে তা বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। 
দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে যতগুলো বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে বাগেরহাটের রামপালে এই তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি অন্যতম। বাংলাদেশ-ভারত জয়েন্ট ভেঞ্চারে নির্মাণ করা ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতার রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট উৎপাদন শুরু করে গত বছরের ১৫ আগস্ট থেকে। তখন পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করলেও এরপর ধাপে ধাপে বিভিন্ন লোডে ইউনিটটির উৎপাদনক্ষমতা পরীক্ষা করা হয়। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর থেকে প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়। কিন্তু উৎপাদন শুরুর পর থেকেই কখনো কয়লা সংকট, কখনো কারিগরি ত্রুটি লেগেই আছে। এ নিয়ে গত আট মাসে সাত বার নানা কারণে সাময়িক বন্ধ রাখতে হয়েছে তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি। 
চালুর পর প্রথম গত ১৪ জানুয়ারি কয়লা সংকটের কারণে সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ওই সময় এক মাসের মতো বন্ধ রাখা হয়। এরপর ২৩ এপ্রিল একই কারণে ১৫ দিন বন্ধ রাখা হয়, ৩০ জুলাই সাময়িক বন্ধ রাখা হয় ১৬ দিন। এভাবে প্রতি মাসে কখনো কয়লা সংকট, কখনো যান্ত্রিক ত্রুটিতে কোনো মাসে দুইবারও বন্ধ রাখতে হয়েছে। সর্বশেষ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ১৫ সেপ্টেম্বর রাত থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে বিব্রত খোদ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতি মাসেই রানিং বিদ্যুৎকেন্দ্র হঠাৎ বন্ধ ঘোষণা করতে হচ্ছে। এটা স্বাভাবিক হতে পারে না। কয়লা সংকট ভিন্ন বিষয়, কিন্তু চালুর পর থেকেই কারিগরি ত্রুটি কতবার হতে পারে? কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের বেশকিছু যন্ত্রপাতিতে সমস্যা রয়েছে বলেও জানান তিনি। 
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখতে রামপালের এই কেন্দ্রটি চালু করা হয়েছিল। কেন্দ্রটি থেকে ঢাকায় দৈনিক প্রায় ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। বাকি বিদ্যুৎ খুলনায় সরবরাহ করা হতো। কিন্তু বৈশ্বিক ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে না পারায় জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো বন্ধ করে দেওয়া হয় এর উৎপাদন। এর এক মাস পর গত ৯ ফেব্রুয়ারি ৩০ হাজার টন কয়লা জেটিতে আসার পর আনলোড করে ১৫ ফেব্রুয়ারি আবারও উৎপাদন শুরু করে কর্তৃপক্ষ। এরপরে ৫৫ হাজার টন কয়লা নিয়ে আরেকটি জাহাজ আসলে উৎপাদন কিছুটা স্বাভাবিক হয়।

কিন্তু তারপর থেকে একের পর এক যান্ত্রিক ত্রুটি লেগেই আছে জানিয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) পরিচালক মো. শামীম হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম বেড়ে যাওয়ায় কেন্দ্রটি থেকে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ পড়ছে প্রতি ইউনিট ১৩-১৪ টাকা। সামনে বিশ্ববাজারে কয়লার দাম কমে এলে উৎপাদন খরচও কমে আসবে। কিন্তু উৎপাদন এরকম বারবার বিঘ্নিত হলে এই কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ কি  হবে বলা মুশকিল। 
কেন্দ্রটির এখনো সিওডি (বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ) না হওয়ায় এর উৎপাদন বন্ধ থাকলেও কোনো প্রভাব পড়বে না জানিয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনকে। পুরো গ্রীষ্মটাই আমরা চেষ্টা করেছি বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে। এই কেন্দ্রটি থেকে খুব বেশি বিদ্যুৎ যে পাওয়া যেত তা নয়। তবে কেন বারবার কারিগরি ত্রুটি দেখা দিচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা হবে। শুনেছি ওই কেন্দ্রের বয়লার মেশিনে উৎপাদনের চাপ বাড়ালেই জটিলতা তৈরি হয়। এটির সমাধান নিশ্চয়ই দ্রুত হবে। তবে বিদ্যুৎ না পেলে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয় না বলে দাবি করেন তিনি। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, চুক্তি অনুযায়ী রামপালের বিদ্যুৎ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (বিপিডিবি) কিনতে হয়। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্টদের দাবি, বিপিডিবির কাছে বিআইএফপিসিএলের ১৭ মিলিয়ন ডলার পাওনা হয়েছে। কিন্তু অর্থ পরিশোধ করছে না। এর মধ্যে বিপিডিবি তাদের কেন্দ্রটি চালিয়ে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল। যে  কারণে জরুরি মজুত কয়লা দিয়েই এত দিন কেন্দ্রটি চালু রাখা হয়। ভরা গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা যখন তুঙ্গে তখন এত বড় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের হঠাৎ করে এমন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া অনাকাক্সিক্ষত। তাও যদি এক/দুইবার হতো তাহলে কথা ছিল। আট মাসে ৭ বার বন্ধ হয়ে যাওয়া কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়।
পাওয়ার সেল বলছে, গ্রীষ্মে বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদা পূরণের জন্য কেন্দ্রগুলো থেকে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, সেজন্য কী পরিমাণ কয়লা, এলএনজি, প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল লাগবে তা হিসাব করে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছিল। কিন্তু একটি কেন্দ্র যদি কারিগরি ত্রুটির কারণে বারবার বন্ধ হয় তাহলে সরবরাহে বিঘœ ঘটে জানিয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, পিক আওয়ারে গ্রীষ্মকালে আমাদের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। তাই আমরা বিদ্যুতের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। কোনোভাবেই যেন গ্রাহকদের ভোগান্তি পোহাতে না হয় সে ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আশা করছি রামপালের প্রভাব আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। 

×