
নওগাঁর এক সময়ের রক্তাক্ত জনপদ রাণীনগর ও আত্রাই উপজেলা নিয়ে গঠিত নওগাঁ-৬
নওগাঁর এক সময়ের রক্তাক্ত জনপদ রাণীনগর ও আত্রাই উপজেলা নিয়ে গঠিত নওগাঁ-৬ আসন, জাতীয় সংসদের ৫১ নম্বর নির্বাচনী এলাকা। দুই উপজেলায় মোট ভোটার তিন লাখ ১৯ হাজার ৩৩৫ জন। তার মধ্যে পুরুষ এক লাখ ৬১ হাজার ৭৭ জন, নারী এক লাখ ৫৮ হাজার ২৭১ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের দুজন।
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না হলেও মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নানা কর্মকা-ের মাধ্যমে নির্বাচনী এলাকায় জানান দিচ্ছেন তারা আগামী নির্বাচনের প্রার্থী। এই আসনে সরাসরি প্রচারে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় নৌকার মনোনয়ন চেয়ে মানুষের দোয়া চাচ্ছেন হাফ ডজনের বেশি প্রার্থী। পাশাপাশি বিএনপিরও হাফ ডজন নেতা মনোনয়নের আশায় তোড়জোড় শুরু করেছেন। তারা সবাই ভোটারদের দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি।
আগামী সংসদ নির্বাচনে এ আসনটি ধরে রাখতে সচেষ্ট ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। কিন্তু দলীয় বিভক্তি সে পথে প্রধান বাধা হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে হারানো আসন পুনরুদ্ধারে মরিয়া বিএনপির প্রার্থীরা। তাই আসনটি আওয়ামী লীগকে ধরে রাখতে ও বিএনপিকে ফিরে পেতে স্মার্ট, স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত প্রার্থী নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেইÑ এমনটাই মনে করছে সচেতন মহল।
১৯৯১ ও ’৯৬ সালে বিএনপি থেকে মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হন সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবীর। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা ওহিদুর রহমান। এরপর ২০০১ সালে পুনরায় আলমগীর কবীর বিজয়ী হন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন প্রয়াত নেতা ইসরাফিল আলম। ২০০৬-০৭ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষের দিকে আলমগীর কবীর এলডিপিতে যোগ দেন।
এতে আলমগীর কবীর ও তার পরিবারের ওপর ক্ষিপ্ত হন বিএনপি নেতাকর্মীরা। সে সময় অভিভাবকহীন বিএনপির কর্মিসমাবেশের আয়োজন করা হয়। যোগ দেন আলমগীর কবীরের ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন বুলু। বিএনপির হাল ধরেন তিনি। আগামী নির্বাচনে ফের আলমগীর কবীর বিএনপি থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন এমন গুঞ্জন রয়েছে নির্বাচনী এলাকায়। তাই বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রশ্নÑ কে পাবেন বিএনপির মনোনয়ন?
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ী হন তৎকালীন ঢাকা মহানগর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ইসরাফিল আলম। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবীরের ছোট ভাই বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন বুলু। এরপর ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন ইসরাফিল আলম এমপি। ২০১৮ সালে আবারও আলমগীর কবীরকে হারিয়ে আসনটি দখলে রাখেন ইসরাফিল আলম।
ইসরাফিল আলম বিজয়ী হওয়ার পর এক সময়ের রক্তাক্ত জনপদ হিসেবে খ্যাত এ দুই উপজেলায় শান্তির সুবাতাস বইতে থাকে। সর্বস্তরের মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। তবে ইসরাফিল আলম ২০২০ সালের ২৭ জুলাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এরপর উপনির্বাচনে তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন হেলালকে নৌকার মনোনয়ন দিলে তিনি নির্বাচিত হন। দীর্ঘ ১৫ বছর আসনটি ধরে রাখলেও দলের মধ্যে বিভক্তি নিরসন করতে পারেনি আওয়ামী লীগ।
বর্তমান এমপি আনোয়ার হোসেন হেলাল ছাড়াও আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শাহিন মনোয়ারা হক, ইসরাফিল আলমের সহধর্মিণী ও নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সুলতানা পারভীন বিউটি, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নওশের আলী, জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক এমপি প্রয়াত ওহিদুর রহমানের পুত্র ওমর ফারুক সুমন, রাণীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আরিফ রাঙ্গা, আত্রাই উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাহিদ ইসলাম বিপ্লব এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও রাণীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ড. মো. ইউনুস আলী প্রামাণিক।
আগামী নির্বাচন ঘিরে গ্রামগঞ্জ, হাটবাজার ও পাড়ামহল্লায় আওয়ামী লীগের কোনো না কোনো মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রতিদিনিই প্রায় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে নৌকা প্রতীকের ভোট চেয়ে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের বার্তা ভোটারদের কাছে পেঁৗঁছে দিচ্ছেন। চষে বেড়াচ্ছেন নির্বাচনী মাঠ। তবে বর্তমান আওয়ামী লীগের বর্তমান এমপি আনোয়ার হোসেন হেলালের দখলেই আছে মাঠ। নৌকার মনোনয়ন দৌড়ে তিনি এগিয়ে আছেন।
এমপি আনোয়ার হোসেন হেলাল বলেন, আমার পরিবারকে আওয়ামী লীগের আঁতুড়ঘর বলা হয়। রাজনীতি করতে গিয়ে দুই ভাইকে হারিয়েছি, এক সময় হয়েছি নির্যাতিত, নিপীড়িত, তবুও পিছপা হইনি। উপনির্বাচনে ৩৪ প্রার্থীর মধ্য থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে মনোনয়ন দিলে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে নেত্রীকে এই আসন উপহার দিয়েছি। এমপি নির্বাচিত হয়ে আমি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাস্তা-ঘাট ও ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণসহ অনেক উন্নয়ন করেছি। সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করেছি। মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে আছি।
তিনি বলেন, নির্বাচনী এলাকার অসহায় ও দুস্থদের পাশে থেকেছি সব সময়। আমার বিশ্বাস, আগামী নির্বাচনে জনসমর্থন এবং দলীয় সিদ্ধান্ত আমার পক্ষেই থাকবে।
মনোনয়নপ্রত্যাশী শাহিন মনোয়ারা হক বলেন, নওগাঁ-৫ (সদর) আসনে আমার স্বামীর বাড়ি আর নওগাঁ-৬ আসনে আমার পিতার বাড়ি। এই দুই আসনে আমার জনপ্রিয়তার কমতি নেই। জননেত্রী আমাকে যে আসনে মনোনয়ন দেবেন, সেই আসনেই আমি নৌকার ভোট করব।
আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী আব্দুল আরিফ রাঙ্গা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ বুকে ধারণ ও লালন করে ১৯৯৩ সাল থেকে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেছি। সব নির্বাচনে নৌকার পক্ষে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করেছি। তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়ন দেবেনÑ এটাই প্রত্যাশা করছি। এ জন্য আমি শতভাগ বিশ^াসী, আমাকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে।
সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত ওহিদুর রহমানের পুত্র ওমর ফারুক সুমন তার পিতার উত্তরসূরি হয়ে নির্বাচনী এলাকায় কাজ করছেন। নির্বাচনী এলাকায় তার বাবার ব্যাপক প্রভাব ও জনসমর্থন ছিল। এখনো তার পরিবারের প্রতি এলাকার মানুষের সহমর্মিতা রয়েছে। পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি নির্বাচনে মনোনয়নের বিষয়ে দৃঢ় আশাবাদী।
অপরদিকে, আগামী নির্বাচনে কোনো ভুল করতে চায় না বিএনপি। বিএনপির একাধিক প্রার্থীর নাম শোনা গেলেও তারা দলীয় সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন। নির্বাচনে গেলে বিএনপি থেকে সাবেক প্রতিমন্ত্রী মো. আলমগীর কবীর, নওগাঁ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক রেজাউল ইসলাম রেজু শেখ, আমিনুল হক বেলালের পাশাপাশি জেলা তাঁতী দলের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় তাঁতী দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. এচাহক আলী ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেন বুলুর নাম প্রার্থী হিসেবে শোনা যাচ্ছে।
জাতীয় পার্টি থেকে রাণীনগর উপজেলা সাধারণ সম্পাদক হাসান আলী দলীয় প্রার্থী হতে পারেন। এ ছাড়া ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টি, ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতে ইসলামী থেকেও মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। আলমগীর কবীর এলডিপিতে যাওয়ার পরও গত নির্বাচনে দলীয় সংসদ সদস্য প্রার্থী ছিলেন।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বলেন, নির্বাচনী এলাকার নেতাকর্মীদের মধ্যে পছন্দের প্রার্থী নিয়ে মতভেদ থাকলেও নৌকা প্রতীক নিয়ে কারও কোনো বিরোধ নেই। তাই দলের হাইকমান্ড যোগ্য মনে করে যাকে দলীয় মনোনয়ন দেবেন, সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা তার পক্ষেই কাজ করবেন।
অন্যদিকে বিএনপির নেতাকর্মীরা বলেন, দলের হাইকমান্ড যোগ্য মনে করে এ আসনে যাকে দলীয় মনোনয়ন দেবেন, সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা তার পক্ষেই কাজ করবেন। তবে যদি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন হয় তাহলে এ আসনটিতে আবার বিএনপি জয়লাভ করবে।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে ভাবনা জানতে চাওয়া হয় এলাকার সাধারণ, তরুণ ও নতুন ভোটারদের কাছে। তারা বলেন, স্মার্ট দেশে স্মার্ট নেতৃত্বই দরকার। যারা দুর্নীতিবাজ, দখলবাজ, দলীয় নেতাকর্মীদের মারপিট, অনিয়ম, মাদক ও সব বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে আগামী দিনের নেতৃত্ব দেবেন এলাকার উন্নয়ন করবেনÑ এ রকম যোগ্য প্রার্থীকেই তারা ভোট দেবেন। এ ছাড়া ভোটারদের প্রত্যাশা, শুধু ভোটের সময় নয়, নির্বাচিত এমপি সারাবছরই তাদের গ্রাম-মহল্লায় আসবেন। দলের সঙ্গে সর্বদা যোগাযোগ রাখবেন, তাদের মধ্যেই কেউ প্রার্থী হলে ভালো হয়। কেউ বলছেন পরিবর্তন হোক, আসুক নতুন নেতৃত্ব। যেখানে থাকবে না কোনো বিভক্তি। সাধারণ মানুষ থাকবে শান্তিতে।