
জেলার বদলগাছী-মহাদেবপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত নওগাঁ-৩ সংসদীয় আসন
জেলার বদলগাছী-মহাদেবপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত নওগাঁ-৩ সংসদীয় আসন। এ আসনটি জাতীয় সংসদের ৪৮ নম্বর নির্বাচনী এলাকা। দুই উপজেলায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মধ্যে যেন বিভক্তি লেগেই রয়েছে। তাই বিভক্ত আওয়ামী লীগের একাংশ এবার প্রার্থী পরিবর্তনের দাবি তুলেছে। অপর অংশ বর্তমান এমপির পক্ষেই সোচ্চার। অন্যদিকে বিএনপি থেকেও রয়েছে একাধিক প্রার্থী। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটি ধরে রাখার চেষ্টায় মরিয়া আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে আসনটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় মাঠে রয়েছে বিএনপি।
জানা গেছে, ১৯৯১ সাল থেকে মরহুম ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী নান্নু নওগাঁ-২ থেকে পর পর চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরমধ্যে ২০০১ সালে দল তাকে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত করেন। এরপর ২০০৮ সালে ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী নান্নুকে পরাজিত করে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) চেয়ারম্যান ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী নির্বাচিত হন। তখন তিনি ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত লাভ করেন।
পরবর্তীতে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে আগের মতো যোগাযোগ না রাখার কারণে রাজনৈতিক কর্মকা-ে দুই উপজেলার নেতা-কর্মীদের মাঝে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা যায়। নির্বাচনে তিনি জনপ্রতিনিধি হলেও তার পরিবারের অনেকেই নির্বাচনী এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে। তৃণমূল নেতাকর্মীরা ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে বিকল্প প্রার্থী দেখতে চেয়েছেন। এরফলে তৎকালীন মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও চেরাগপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিমের পক্ষে অধিকাংশ নেতাকর্মী দল থেকে মনোনয়নপত্র চান।
ড. আকরাম হোসেন চৌধুরীকে দল থেকে মনোনয়ন দেয়ায় ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সে সময় আওয়ামী লীগের সারাদেশে জয়জয়কার হলেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ড. আকরাম হোসেন চৌধুরীকে প্রায় ৩০ হাজার ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিম। নির্বাচিত হওয়ার প্রায় সাড়ে তিন বছর পর ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিমকে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
বর্তমান সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিম মহাদেবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। দীর্ঘ ১৫ বছর একনাগাড়ে ক্ষমতায় থাকার কারণে তিনি মহাদেবপুর ও বদলগাছী সংসদীয় এলাকায় একটি নির্দিষ্ট বলয় তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছেন। নির্বাচনী এলাকায় উন্নয়নও করেছেন। কিন্তু দলের একসময়ের বলিষ্ঠ ও ত্যাগী নেতাদের কৌশলে দলের কমিটি থেকে বাদ দিয়ে তাদের কোণঠাসা করে রাখার অভিযোগ রয়েছে বর্তমান সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দিন তরফদার সেলিমের বিরুদ্ধে। এছাড়া তার কিছু ঘনিষ্ট হাতেগোনা নেতাকর্মীরা নির্বাচনী এলাকায় প্রভাব বিস্তারসহ নানা অনৈতিক কর্মকা-ে জড়িত হওয়ারও অভিযোগ তুলেছেন তার বিপক্ষের নেতাকর্মীরা।
দলের দুঃসময়ের ত্যাগী নেতাকর্মীদের কৌশলে দূরে রেখে স্বজনপ্রীতি ও বিএনপি-জামায়াত সদস্যদের দলীয় পদ দিয়ে অনুগতদের নিয়ে পকেট কমিটি গঠনের অভিযোগ করেছেন কয়েকজন সিনিয়র স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। এই অংশের দাবি বর্তমান এমপি বাদে অন্য যে কেউ নৌকা প্রতীক পেলে দলমত নির্বিশেষে ভোটাররা নৌকাকে বিজয়ী করবে।
তবে সংসদ সদস্য ছলিম তরফদার সমর্থিত নেতাকর্মীরা এসব অভিযোগকে মিথ্যা ও অসত্য উল্লেখ করে দাবি করেন, মনোনয়নের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকা কিছু নেতাই এসব প্রপাগা-া ছড়াচ্ছে। তাদের দাবি, বর্তমান এমপির জনপ্রিয়তা বেড়েছে। আগামী নির্বাচনেও তিনি মনোনয়ন পাবেন এবং এই আসনটিতে নৌকাকে বিজয়ী করে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও উপহার দেবেন।
এদিকে, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে দুজনের মধ্যে মনোনয়নের লড়াই হওয়ার কথা থাকলেও ঢাকঢোল পিটিয়ে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন ঘটেছে। তিনি হচ্ছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ক্লিন ইমেজের পরিচিত সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্ত্তী সৌরেন। বর্তমানে তিনি নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য। তিনি কর্মজীবন থেকেই নিজ এলাকা বদলগাছী ও মহাদেবপুর উপজেলায় রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ সংযোগসহ জনগণের সুবিধার জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক অনেক কাজ করেছেন। সাবেক এই সচিবের আগে থেকেই এলাকার জন্য কিছু করার ইচ্ছে ছিল। সুযোগ পেলে করেছেন অনেক উন্নয়ন। জনপ্রতিনিধি হলে আরও কাজ করার সুযোগ পাবেন বলে আশা তৃণমূল নেতাকর্মীদের।
মহাদেবপুর-বদলগাছীর সুধী ও বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনৈতিকদের অনুরোধে পেশাগত জীবন অতিবাহিত করে জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন। তার পিতা ব্রজেন্দ্র নাথ চক্রবর্ত্তী একজন হিতৈষী সমাজসেবী হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। মাতা সবিতা চক্রবর্ত্তী স্বাধীনতাপূর্ব এবং উত্তর বদলগাছী থানার মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী ছিলেন। বিদূষী সংবেদনশীলা সবিতা চক্রবর্ত্তী শিক্ষা, সংস্কৃতি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমাজকল্যাণ ও সেবাব্রতে যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, সেজন্য নওগাঁ অঞ্চলে জাতি, ধর্ম -বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর মহান মুত্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক নাটোর সদরের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত শঙ্করগোবিন্দ চৌধুরীর তিনি কনিষ্ঠ জামাই।
এই আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিম ছলিম ছাড়াও আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চাইবেন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএমডিএ চেয়ারম্যান ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী, নওগাঁ জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী এবং সাবেক পুলিশ সুপারের স্ত্রী সখিনা সিদ্দিক।
অন্যদিকে, বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক ছাত্র নেতা ও বদলগাছী থানা বিএনপির সভাপতি ফজলে হুদা বাবুল, মহাদেবপুর থানা বিএনপির সভাপতি ও জেলা বিএনপির সদস্য রবিউল আলম বুলেট এবং জাতীয় সংসদের সাবেক ডেপুটি স্পিকার প্রয়াত আখতার হামিদ সিদ্দিকী নান্নুর ছেলে পারভেজ আরেফিন সিদ্দিকী জনি। অন্য দল থেকে কেউ দাঁড়ালেও মূলত এই আসনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যেই।
বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী রবিউল আলম বুলেট বলেন, দল যদি নির্বাচন করে সেক্ষেত্রে আমি মনোনয়ন চাইবো এবং শতভাগ বিশ্বাস করি দল আমাকে মনোনয়ন দেবে। কলেজ শাখা ছাত্রদলের রাজনীতির মধ্য দিয়ে আমার রাজনীতি জীবন শুরু। এরপর থানা, জেলা পর্যায়ে রাজনীতি করেছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র রাজনীতি করেছি। বর্তমানে আমি মহাদেবপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও জেলা বিএনপির সদস্য। দলকে সুসংগঠিত করতে আমি দিনরাত পরিশ্রম করেছি এবং সবসময় তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশে থেকেছি, এখনো থাকছি। আমি মনোনয়ন পেলে নিশ্চিত এই আসনটি পুনরুদ্ধার করতে পারব।