
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে টাঙ্গাইল-২
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। বিভিন্ন শুভেচ্ছার পাশাপাশি এই আসনের সম্ভাব্য বিভিন্ন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ব্যানার, ফেস্টুন, নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়সহ বিভিন্নভাবে প্রচার চালাচ্ছেন। নির্বাচন সামনে রেখে তারা উন্নয়নমূলক কাজ, জনসভা, পথসভা, র্যালিসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করছেন। শুধু নির্বাচনী প্রচারই নয়, জনসাধারণের সুখ-দুঃখের অংশীদারিত্বের প্রমাণ দিতে তারা মানুষের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা ও তরুণ কর্মীদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেতে সম্ভাব্য প্রার্থীদের ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ এলাকায় নির্বাচনী আমেজ তৈরি করছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় নেতারা কোন্দলে জর্জরিত হওয়ায় বেকায়দায় দলটির কর্মী-সমর্থকরা। অপরদিকে এই আসনে বিএনপিতে একক প্রার্থী থাকায় রয়েছে অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায়। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এই আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীরা তাদের নিজ নিজ নেতাকর্মীদের নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় উঠান বৈঠক, কর্মিসভা, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন। পাশাপাশি যে যেমন পারছেন ক্লাব, শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে আর্থিক অনুদান দিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রায় অর্ধডজন মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ায় দলীয় কোন্দল চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রত্যেক প্রার্থী দলের মধ্যে নিজস্ব বলয় (লোকবল) তৈরিতে ব্যস্ত থাকায় দলীয় কর্মসূচির চাইতে নেতা কেন্দ্রিক কর্মসূচি নিয়ে বিভক্ত কর্মীরা। এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ দলীয় তানভীর হাসান ছোট মনির। বর্তমান সংসদ সদস্য স্থানীয় ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করে প্রায় সব সময় উঠতি বয়সী তরুণদের নিয়ে চলাফেরা করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
তবে প্রকাশ্যে এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী সব প্রার্থীই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে বিরোধী প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নিচ্ছেন। এক প্রার্থী সমাবেশ আহ্বান করলে অপর প্রার্থীও একই স্থানে একই সময় সমাবেশ আহ্বান করছেন। এ নিয়ে গোপালপুর ও ভূঞাপুরে প্রার্থীর কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করতেও দেখা যায়।
গোপালপুর উপজেলার সাত ইউনিয়ন, এক পৌরসভা এবং ভূঞাপূর উপজেলার ছয় ইউনিয়ন, এক পৌরসভা নিয়ে গঠিত টাঙ্গাইল-২ আসনে কখনো একাধিপত্য দেখা যায়নি। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত গত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে পাঁচবার আওয়ামী লীগ, চারবার বিএনপি, একবার করে জাতীয় পার্টি ও জাসদের (সিরাজ) প্রার্থীরা জয়লাভ করেন।
১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হাতেম আলী তালুকদার ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির হাতেম আলী খানকে পরাজিত করেন। ১৯৭৯ সালে বিএনপি প্রার্থী আফাজ উদ্দিন ফকির জয়লাভ করেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী শামছুল হক তালুকদার ছানু আওয়ামী লীগের হাতেম আলী তালুকদারকে পরাজিত করে এমপি হন। ১৯৮৮ সালে নির্বাচিত হন জাসদের (সিরাজ) আব্দুল মতিন হিরু।
এরশাদ সরকারের পতনের পর গণতন্ত্র-উত্তর প্রথম (১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ) নির্বাচনে বিএনপির আব্দুস সালাম পিন্টু আওয়ামী লীগের হাতেম আলী তালুকদারকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদের একতরফা নির্বাচনে বিএনপির আব্দুস সালাম পিন্টু আবার এমপি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি হেরে যান আওয়ামী লীগ প্রার্থী খন্দকার আসাদুজ্জামানের কাছে। ফের ২০০১ সালে বিএনপি পুনরুদ্ধার করে আসনটি। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী খন্দকার আসাদুজ্জামানকে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে তৃতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন আব্দুস সালাম পিন্টু।
এছাড়া ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাল্লা ঘুরে খন্দকার আসাদুজ্জামানের দিকে। দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন তিনি। আব্দুস সালাম পিন্টু ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় কারাগারে থাকায় তার ছোট ভাই সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বিএনপির প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী খন্দকার আসাদুজ্জামান ও জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) আব্দুল আজিজের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। তৃতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন খন্দকার আসাদুজ্জামান।
খন্দকার আসাদুজ্জামান বয়সের ভারে ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার ছেলে খন্দকার মশিউজ্জামান রোমেল দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন। জার্মান আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, প্রবাস ফেরত ব্যবসায়ী ও টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক তানভীর হাসান ছোট মনির দলীয় মনোনয়ন পান। বিএনপি প্রার্থী তৎকালীন কেন্দ্রীয় যুব দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে পরাজিত করে এ আসনে প্রবাসীদের মধ্যে প্রথম তানভীর হাসান ছোট মনির এমপি নির্বাচিত হন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই আসনে আওয়ামী লীগের হয়ে প্রচারে এখন পর্যন্ত মাঠে রয়েছেন- বর্তমান সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির, গোপালপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার ঠা-ু, ভূঞাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুদুল হক মাসুদ, সাবেক এমপি খন্দকার আসাদুজ্জামানের ছেলে খন্দকার মশিউজ্জামান রোমেল ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক খন্দকার আশরাফুজ্জামান স্মৃতি।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একপক্ষের নেতাকর্মীরা জানান, বর্তমান এমপি তানভীর হাসান ছোট মনির দলের প্রবীণ ও ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করে না, উন্নয়ন কাজে স্থানীয় নেতাদের পরামর্শ না নেওয়া ও সংযুক্ত না করা, সাংগঠনিক কর্মকা-ে নেতাদের সঙ্গে যোগ না দেওয়াসহ নানা কারণে দলের নেতাকর্মীরা বর্তমান এমপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। আওয়ামী লীগের অপরপক্ষের নেতাকর্মীরা পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, মনোনয়নপ্রত্যাশী ভূঞাপুর পৌরসভার মেয়র মাসুদুল হক মাসুদ শুধু ভূঞাপুর উপজেলাতে অবস্থান করেন।
অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী গোপালপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার ঠা-ুর শুধু গোপালপুরে পরিচিতি রয়েছে। এই দুই নেতার নিজ উপজেলা ছাড়া অন্য উপজেলায় তেমন নেই কোনো নেতাকর্মী ও জনসমর্থন। এছাড়া সাবেক এমপি খন্দকার আসাদুজ্জামানের ছেলে খন্দকার মশিউজ্জামান রোমেল শুধু নির্বাচনের আগে এলাকায় এসে মনোনয়ন প্রার্থিতা ঘোষণা করে ঘুরে বেড়ায়। এদের নেই উল্লেখযোগ্য কোনো নেতাকর্মী কিংবা জনগণের সঙ্গে ব্যাপক সম্পৃক্ততা।
বর্তমান সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির টাঙ্গাইলের বহুল আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যা মামলার আসামি সাবেক এমপি রানাসহ তার ভাইদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আলোচিত নেতায় পরিণত হয়েছেন। এ কারণে তিনি গোপালপুর-ভূঞাপুরের যুবসমাজের কাছে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। সাংগঠনিক কাজের পাশাপাশি গোপালপুর-ভূঞাপুরের উন্নয়নে সব সময় সচেষ্ট রয়েছেন। তিনি এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সামাজিক কর্মকা-ে জনসাধারণের পাশে থাকেন।
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে বর্তমান এমপি তানভীর হাসান ছোট মনির জানান, গোপালপুর-ভূঞাপুরের সাধারণ মানুষ তাকে সন্তানের মতো গ্রহণ করেছেন। তাদের পাশে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। আওয়ামী লীগ একটি সুপ্রাচীন ও বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এই দল থেকে অনেকেই মনোনয়ন চাইতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একজন কর্মী হিসেবে বিগত সময়ে গোপালপুর-ভূঞাপুরের যে উন্নয়ন সাধিত করেছেন তাতে তিনিই দলীয় মনোনয়ন পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেন। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ও পরামর্শে তিনি দুই উপজেলায় অনেক উন্নয়মূলক কাজ করেছেন।
আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী গোপালপুর উপজেলা পরিষদের তিনবারের চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদার ঠা-ু এর আগে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে পাননি। এবার আটঘাট বেঁধে মাঠে নেমেছেন- দলীয় মনোনয়ন পেলে তিনি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নেবেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগে তার অবদান রয়েছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ছিলেন।
এদিকে ভূঞাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুদুল হক মাসুদ দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে এলাকায় পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন সাঁটিয়েছেন। মহান স্বাধীনতার পর ভূঞাপুর উপজেলা থেকে কেউ এমপি নির্বাচিত হয়নি, বড় দলগুলো কাউকে মনোনয়নও দেয়নি। এবার তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন বলে বিশ্বাস করেন। সে লক্ষ্যে স্থানীয় পর্যায়ে নানা উন্নয়ন কর্মকা- চালাচ্ছেন। সময়-অসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন।
অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী রাজধানীর ঢাকা ক্লাবের সভাপতি খন্দকার মশিউজ্জামান রোমেল মূলত একজন ব্যবসায়ী। বাবার সুনাম ধরে রাখতে তিনি টাঙ্গাইল-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। গোপালপুর-ভূঞাপুরের মানুষ নানা প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে বাবার সূত্রেই তার কাছে যান। তিনি সাধ্যমতো তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন। নির্বাচনী এলাকায় যাতায়াত কম হলেও তিনি সব সময় যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন।
এদিকে, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ক্ষমতাধর প্রার্থী সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর মৃত্যুদ-ের আদেশ হওয়ায় এই আসনে বিএনপি এখন প্রায় নিষ্ক্রিয়। আসনটি পুনরুদ্ধারে তার ছোট ভাই কেন্দ্রীয় জাতীয়তাবাদী যুবদলের বর্তমান সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু প্রার্থী হচ্ছেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় কারান্তরীণ বিএনপির সাবেক উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আব্দুস ছালাম পিন্টু আইনি জটিলতায় তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তাই গতবারের মতো এবারও তার ছোট ভাই কেন্দ্রীয় জাতীয়তাবাদী যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু এই আসনে বিএনপির প্রার্থী হবেন এটা প্রায় নিশ্চিত।
এ বিষয়ে স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, সরকারের জুলুম নির্যাতনের পরও এ আসনে বিএনপির জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন ও খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিলে বিএনপি অবশ্যই নির্বাচনে অংশ নেবে। টাঙ্গাইল-২ আসনে কেন্দ্রীয় যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু এই আসনে নির্বাচন করবেন।
এছাড়া এই আসনে জাকের পার্টির প্রার্থী সংগঠনের টাঙ্গাইল পশ্চিমাঞ্চল কমিটির সভাপতি এনামুল হক মঞ্জু নির্বাচনে অংশ নিবেন বলে শোনা যাচ্ছে।