ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

টাঙ্গাইল-১

শক্ত অবস্থানে কৃষিমন্ত্রী ড. রাজ্জাক দুর্গ ভাঙতে চায় বিএনপি

ইফতেখারুল অনুপম, টাঙ্গাইল

প্রকাশিত: ০০:০৪, ৯ আগস্ট ২০২৩

শক্ত অবস্থানে কৃষিমন্ত্রী ড. রাজ্জাক দুর্গ ভাঙতে চায় বিএনপি

টাঙ্গাইল একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ

টাঙ্গাইল একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদ। বহু অতীত ঐতিহ্য আর বাংলার চির পরিচিত লোক-সংস্কৃতি ইতিহাসে ক্রমধারার উত্তরাধিকারী। প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্যে আর লোক-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যে টাঙ্গাইল জেলার অবস্থান অনেক উঁচুতে। টাঙ্গাইলের লোক-ঐতিহ্য নিয়েও প্রবাদ বচন রচিত আছে। যেমন- ‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’ টাঙ্গাইলের লোক তৈরি চমচম মিষ্টি আর তাঁতের শাড়ি পৃথিবী খ্যাত। নকশীকাঁথার ক্ষেত্রে বিখ্যাত এই জেলাটি।
টাঙ্গাইল জেলার আটটি নির্বাচনী আসন। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে প্রতিটি আসনে বইতে শুরু করেছে নির্বাচনী হাওয়া। সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীরা ইতোমধ্যে ছুটতে শুরু করেছেন নির্বাচনী এলাকায়, ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের মন জয় করার চেষ্টা করছেন। 
টাঙ্গাইল-১ (মধুপুর-ধনবাড়ী) উপজেলা মিলে সংসদীয় এই আসন গঠিত। আসনটি নানা কারণে জেলার ৮টি আসনের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। মধুপুরের বিশাল শালবন, ধনবাড়ীর জমিদারবাড়ী, আদিবাসীদের নানা সংস্কৃতি আর রানী ভবানীর স্মৃতি বিজড়িত লাল ও এঁটেল মাটির অঞ্চল মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলা নিয়ে এই আসনটি আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত। এই আসন থেকে চারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সভাপতিম-লীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক পঞ্চমবারের মতো বিজয়ী হতে নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। বসে নেই প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। তারাও আসনটিতে ভাগ বসাতে কাজ করছে। 
 ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৩ আসন পেয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও মধুপুর-ধনবাড়ীর এ আসনটি হাতছাড়া হয়ে যায়। তখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মহেন্দ্র লাল বর্মণকে পরাজিত করেন জাসদ মনোনীত প্রার্থী আবদুস সাত্তার। তবে এরপরে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের বিজয় পেতে আর কোন বেগ পেতে হয়নি।
বিশেষ করে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী এই আসন থেকে বিজয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর অন্যতম সদস্য, বর্তমান সরকারের কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এই আসনের বর্তমান এমপি। তিনি টানা চারবার এই আসনের প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন। বিগত ২০০১ সালে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এই আসনে বিজয়ী হওয়ার পর থেকে আসনটি আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। তবে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এই দুর্গ ভাঙতে বিএনপি মরিয়া হয়ে মাঠে নেমেছে।
নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে রাজনীতিতে অভিষেক ঘটিয়েই চমক সৃষ্টি করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত আবু সাঈদ চৌধুরীর ছেলে আবুল হাসান চৌধুরী। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বিএনপি মনোনীত সাবেক এমপি সৈয়দা আশিকা আকবরকে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। বিগত ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনে মধুপুর-ধনবাড়ী থেকে কোনো প্রার্থী না পাওয়ায় পাশের জেলা জামালপুরের সরিষাবাড়ির আসনের তৎকালীন বিএনপির মহাসচিব ব্যারিস্টার আব্দুস সালাম তালুকদারকে মনোনয়ন দিয়ে এ আসন থেকে নির্বাচিত করে বিএনপি। পরে ওই বছরের ১২ জুনের নির্বাচনে আব্দুস সালাম তালুকদারকে হারিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল হাসান চৌধুরী পুনরায় এমপি নির্বাচিত হন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বও পান তিনি। 
পরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় বিগত ২০০১ সালে মনোনয়ন বঞ্চিত হন আবুল হাসান চৌধুরী। বিগত ২০০১ সালে টাঙ্গাইলের পাশের উপজেলা ভূঞাপুরের সন্তান ভূঞাপুর-গোপালপুরের সাবেক এমপি আফাজ উদ্দিন ফকিরের ভাতিজা শিল্পপতি ফকির মাহবুব আনাম স্বপনকে বিএনপি এ আসন থেকে মনোনয়ন দেয়। অপরদিকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান কৃষিবিজ্ঞানী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি প্রথম নির্বাচন করেই চমকে দেন সবাইকে। প্রায় দ্বিগুণ ভোটের ব্যবধানে বিএনপির প্রার্থী ফকির মাহবুব আনাম স্বপনকে পরাজিত করেন। 
কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বিগত ২০০৮ সালের নির্বাচনেও ব্যক্তি ইমেজে ও সাংগঠনিক দক্ষতায় প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে বিএনপির ফকির মাহবুব আনাম স্বপনকে দ্বিতীয়বারের মতো হারান। পরে ড. আব্দুর রাজ্জাক খাদ্য, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। বিগত ২০১৪ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। মধুপুর-ধনবাড়ী দুই উপজেলাতেই ড. আব্দুর রাজ্জাকের শক্ত অবস্থানের কারণে তাঁর কোনো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী নেই বলে মনে করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। 
এছাড়া মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগসহ আওয়ামী লীগের সকল অঙ্গসংগঠনের নেতকর্মীরা তাঁর প্রতি আস্থাশীল। আগামী সংসদ নির্বাচনেও তিনি পঞ্চমবারের মতো এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন, এমনটা তার দলীয় নেতাকর্মীরা মনে করেন। দলীয় নেতাকর্মীরা জানান, জাতীয় নেতা ড. আব্দুর রাজ্জাকই কেন্দ্রীয় সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে বর্তমানে আওয়ামী রাজনীতির টাঙ্গাইলের অভিভাবক। এ আসনে তাঁর বিকল্প প্রার্থী নেই বলেও জানান বেশিরভাগ দলীয় নেতাকর্মীরা। 
বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. আব্দুর রাজ্জাক দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করার সুযোগ পেয়েছেন। সুযোগটা কাজেও লাগিয়েছেন এই নেতা। এরই মধ্যে নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় নেতাকর্মীদের সুসংগঠিত হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। 
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এ আসনে ড. আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে লড়তে উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজছে বিএনপি। আলোচনায় উঠেছে বিএনপির উপযুক্ত প্রার্থী হচ্ছেন নির্বাহী কমিটির সদস্য ফকির মাহবুব আনাম স্বপন। তবে সাধারণ মানুষের ধারণা, এবার এই আসনে একটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে। সবার কাছে সজ্জন হিসেবে পরিচিত উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম সরকারের (সরকার শহীদ) অকাল মৃত্যুতে সাংগঠনিক কার্যক্রমে কিছুটা স্থবিরতা এলেও বিএনপি নেতারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। 
ইতোমধ্যে মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলার সব পর্যায়ের কমিটি গঠন করে সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করেছে। সংগঠনটি নিজস্ব ভোট ব্যাংকের সঙ্গে ক্ষুব্ধ মানুষের ভোট যুক্ত করে বিএনপি আসন পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন নিয়ে কাজ করছে। আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকের। তবে এই আসনে তিনি একাই মনোনয়ন চাইবেন এমনটি নয়। প্রকাশ্যে এখনো কেউ প্রার্থিতা ঘোষণা না করলেও কয়েকজন মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে। 
এসব বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিগত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমার নির্বাচনী এলাকা ধনবাড়ী ও মধুপুরে ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। ধনবাড়ীতে মডেল উপজেলা ভবন, ১০০ শয্যার হাসপাতাল, থানা ভবন, ফায়ার সার্ভিস, মধুপুরে ৭২ হাজার টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন অত্যাধুনিক সাইলো নির্মাণ, কোল্ড স্টোরেজ, মধুপুর অডিটোরিয়ামসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতে ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। ধনবাড়ী ও মধুপুর উপজেলার প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলার মানুষ। মধুপুর ও ধনবাড়ী উপজেলা এখন উন্নয়নের রোল মডেল।
অপরদিকে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম নাজুক অবস্থানে রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফকির মাহবুব আনাম স্বপন বলেন, আমাদের এমন কোনো নেতাকর্মী নেই যে দমন-পীড়নের শিকার না হয়েছেন। এর মধ্যে দিয়েই আমরা সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছি। ধনবাড়ী উপজেলা প্রতিষ্ঠা করায় ব্যাপক ভূমিকা রেখেছি। তাছাড়া পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে ধনবাড়ী ও মধুপুরে ব্যাপক উন্নয়ন করেছি নিজেদের টাকা দিয়ে। সবকিছু ছেড়ে এসে এ অঞ্চলের মানুষ হিসেবে আমি সবার পাশে থাকতে চাই। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশনা মেনে কাজ করছি। নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারলে এ আসনে বিএনপি প্রার্থী অবশ্যই জয়ী হবে। 
মধুপুর-ধনবাড়ী উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক বৃহৎ রাজনৈতিক দল। দলে একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকতেই পারেন। তবে দল থেকে ফকির মাহবুব আনাম স্বপন মনোনয়ন পেলে বিএনপি এ আসনে জয়লাভ করতে পারবে। তাদের ধারণা, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করবেন। নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে আলোচনায় আছেন বিএনপির কয়েকজন নেতা। ডাকসুর সাবেক সদস্য ও টাঙ্গাইল-১ আসনের সাবেক এমপি খন্দকার আনোয়ারুল হক, বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আলী দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। 
এছাড়া জাতীয় পার্টি (জাপা) থেকে মনোনয়ন চাইতে পারেন মধুপুর উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি সার্জেন্ট (অব.) মোহাম্মদ আলী। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মধুপুর উপজেলা শাখার সহ-সভাপতি মাওলানা জহিরুল ইসলাম দলের মনোনয়ন চাইবেন বলে জানা গেছে।
টাঙ্গাইল-১ আসনটি মধুপুর উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়ন এবং ধনবাড়ী উপজেলার একটি পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। আগের তালিকা অনুযায়ী এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৪৭ জন।

×