ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পোল্ট্রি খামারির দিনবদলের গল্প

আব্দুর রউফ সরকার, আবু কায়সার শিপলু, শফিউল হক মিঠু ও জিয়াউল হক

আরমানুর রহমান লিংকন

প্রকাশিত: ০১:১৭, ২ জুন ২০২৩; আপডেট: ০১:২০, ২ জুন ২০২৩

আব্দুর রউফ সরকার, আবু  কায়সার শিপলু, শফিউল হক মিঠু ও জিয়াউল  হক

রায়েরকাঠীতে হুমকির মুখে একটি পোল্ট্রি খামার

এক সময়ের বেকার লিংকন এখন নিজের কাজ নিয়ে মহাব্যস্ত। তিনি একা ব্যস্ত নন। আরও ৫/৭ জন বেকারকেও তিনি কাজে ব্যস্ত রেখেছেন। লিংকনের দিনের কার্যক্রম শুরু হয় ভোর ছয়টা থেকে চলে রাত দশটা পর্যন্ত। রাতের খাবার খেয়ে আবার বসে যান সারাদিনের ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশ নিয়ে। কাজের ফাঁকে একটু অবসর সময় খোঁজেন। কিন্তু কাজের চাপে মেলে না ফুরসত। অথচ এই লিংকন এক সময় কাজের জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন এখানে-সেখানে। চাকরির পেছনে ছুটেছেন অনেকদিন অনেকের দ্বারে দ্বারে। কোনো লাভ হয়নি। কর্মহীন বেকার জীবন এক সময় খুব কষ্টকর মনে হতো। উপার্জন করতে না পেরে নিজেকে এক সময় মনে হতো পরিবারের বোঝা। হতাশা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েননি। এটি রংপুর সিটি করপোরেশনের বাহার কাছনা এলাকার জীবনযুদ্ধে সংগ্রামী এক সফল উদ্যোক্তা আরমানুর রহমান লিংকনের।
লিংকনের বাবা ছিলেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। তারা তিন ভাই এক বোন। বাবার চাকরির উপরই পুরো পরিবার নির্ভরশীল। সংসারে বাড়তি আয়ের কোনো সুযোগ নেই। এর মধ্যে বাবাও অবসরে যান। তিনি সংসারের বড় সন্তান। স্বাভাবিকভাবেই সংসারের দায়িত্ব অনেকটা লিংকনের উপরই বর্তায়। তাছাড়া ছোটকাল থেকে লিংকন ছিলেন অত্যন্ত আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন। সংসারে বাবাকে সহযোগিতা করার প্রবল ইচ্ছা তার ছোটবেলা থেকেই। ১৯৯৬ সালের কথা। সবেমাত্র গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন। সংসারের হাল ধরতে যত দ্রুত সম্ভব তার একটি চাকরি দরকার।

যথারীতি চাকরির পেছনে ছুটলেন কিছুদিন। কিন্তু কোনো ফল পেলেন না। অবশেষে এক হিতাকাক্সক্ষী পরামর্শ দিলেন কোনো একটা বিষয়ে ভকেশনাল কোর্স করলে কমপক্ষে কোনো একটা কাজ জোগাড় করা যাবে। সেই চিন্তা থেকে রংপুরের একটি সরকারি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনের উপরে কোর্স করলেন তিনি। সেটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার চিন্তা করলেন। কিন্তু মনে মনে ভাবতে লাগলেন এর চেয়ে ভালো কিছু করা যায় কিনা।
তিনি নিয়মিত পত্র-পত্রিকায় ক্যারিয়ার বিষয়ক ফিচারগুলো পড়তে থাকেন। কয়েকটি ফিচার পড়ে অনেকের সাফল্যের গল্প তার ভেতরে উদ্যোক্তা হওয়ার আকাক্সক্ষা তৈরি করে। তার মনে হয় তিনিও তো চাকরির পেছনে না ছুটে একজন উদ্যোক্তা হতে পারেন। 
লিংকন বলেন, এক সময় মুরগির খামার করার সিদ্ধান্ত নিলাম। অনেকে দেখি মুরগির খামার করে লোকসান করেছেন। অনেকে আবার স্বাবলম্বীও হয়েছেন। আমার পরিবার এবং চারপাশের লোকজন আমাকে মুরগির খামারের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করলেন। তারা ভয় দেখালেন মুরগির খামারে অনেক পরিশ্রম। ঝুঁকিও অনেক বেশি। একবার খামারে মড়ক লাগলে লাভ তো দূরের কথা পুঁজি হারিয়ে পথে বসতে হবে। তাদের কথায় আমি দমে যাইনি। সাহস করে মুরগির খামার করার পরিকল্পনা করলাম। কিন্তু প্রধান সমস্যা পুঁজি। আমার পরিবার এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় এক টাকাও দিতে রাজি নয়।

ভোকেশনাল কোর্স করতে গিয়ে ৪৮০০ টাকা সরকারি বৃত্তি পেয়েছিলাম। বাধ্য হয়ে সেই টাকা নিয়ে বাড়ির একটি পরিত্যক্ত ঘরে ১৮টি লেয়ার মুরগি কিনে খামার শুরু করলাম। ১৯৯৯ সালে কর্মসংস্থান ব্যাংক, রংপুর শাখার কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান শাহিন আমাকে ৫০ হাজার টাকা ঋণের ব্যবস্থা করে দেন। সেই ঋণের টাকা আমার জন্য অনেক বড় আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। ওই টাকায় খামার সম্প্রসারণ করি। শুরু হয় আমার দিনবদলের পালা।

রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস তাকে নিয়মিত পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করেছে বলে জানান তিনি। 
তিনি বলেন, এখন আমার খামারে সাড়ে চার হাজার মুরগি। মুরগির খামারের আয় দিয়ে ছাগল-গরুর খামার করেছি। ছাগল-গরুর খামারের জন্য ঘাসের জমি কিনেছি। শুধু তাই নয়, মুরগি এবং ছাগল-গরুর খাদ্য তৈরির জন্য মেশিন কিনেছি। সেখান থেকে যে পরিমাণ খাবার তৈরি করা যায় তা দিয়ে নিজের খামারের চাহিদা মিটিয়েও অন্যান্য খামারিদের কাছে বিক্রি করছি। সেটাও আমার একটা বাড়তি আয়।’
১৯৯৬ সাল থেকে ২০২৩। দীর্ঘ ২৭ বছরের সাধনায় তিল তিল করে গড়ে তোলা তার স্বপ্নের খামারের সম্পদ এখন কোটি টাকার উপরে। তিনি শুধু একজন খামারিই নন। অনেক খামারি তৈরি হয়েছে তারই অনুপ্রেরণায়। তিনি এখন রংপুর পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক। তার এই ২৭ বছরের সাধনার পথ খুব সহজ ছিল না। প্রথম ৫ বছর তিনি খামারের জন্য কোনো কর্মচারী রাখেননি। মুরগির বিষ্টা পরিষ্কার করা, খাবার খাওয়ানো, ভ্যাকসিন দেওয়া থেকে শুরু করে সব কাজ একাই করেছেন। এমনও হয়েছে প্রতিনিয়ত মুরগির বিষ্টা পরিষ্কার করতে করতে তার হাতে ঘা ধরে গেছে। গন্ধে আর অতিরিক্ত পরিশ্রমে অনেকবার অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ডিমের দাম কমে যাওয়ায় এবং বার্ডফ্লুর আক্রমণে তার খামার অনেকবার ধাক্কা খেয়েছে। প্রবল ইচ্ছাশক্তি এবং কঠোর পরিশ্রমের ফলে তিনি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। 
তিনি বলেন, ‘খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় তার লাভ এখন অনেকটা কমেছে। বর্তমানে তার খামারে ৬/৭ জন নিয়মিত শ্রমিক কাজ করে। খাদ্য, ওষুধ, কর্মচারীর বেতন ও আনুষঙ্গিকসহ শুধু মুরগির খামারে তার মাসিক ব্যয় প্রায় ১১ লাখ টাকা এবং আয় প্রায় ১২ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিমাসে তার প্রায় লাখ টাকা লাভ থাকে। বর্তমানে প্রতিশত ডিমের দাম ১০৪০ টাকা। খাদ্যের দাম প্রতি  কেজি ৬০/৬৫ টাকা। কিছুদিন আগেও খাদ্যের দাম ছিল ৫০ টাকা প্রতি কেজি। বছর দেড়েক আগে ২৮/৩০ টাকা কেজিতে খাদ্য পাওয়া যেত। তখন অনেক লাভ হতো। খাদ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় লাভ করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাবে। সম্ভাবনাময় এই খাতটি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমিষের চাহিদা পূরণ এবং কর্মসংস্থানের একটি বড় ক্ষেত্রে পরিণত হবে।’ 
মুরগির খামার করে অনেকেই লোকসানের কারণে নিঃস্ব হয়েছেন। এর কারণ জানতে চাইলে লিংকন বলেন, ‘এটা তো জীবন নিয়ে ব্যবসা। মুরগির অসুখ-বিসুখ হবে, মারা যাবে। ডিমের দামে উঠা-নামা করবে। এসব ধাক্কা সামলাতে না পারার কারণে অনেকে খামার বন্ধ করতে বাধ্য হয়। মুরগির খামার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ভালো ধারণা না নিয়ে অনেকেই খামার শুরু করে দেন। আবার নিজের সাধ্যের চেয়ে অনেক বড় আকারে খামার শুরু করেন। শুরুতেই পুরোটাই ঋণের উপর নির্ভর করেন। ফলে কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা ঋণের বোঝা টানতে টানতে আর দাঁড়াতে পারেন না।’
বেকার যুবক বা নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে তার পরামর্শ কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যে কোনো পরিশ্রমী বেকার যুবক মুরগির খামারের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হতে পারে। বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য এর চেয়ে সহজ পথ আর নেই। মুরগির খামার ঝুঁকিপূর্ণ হলেও অন্য সকল খামারের চেয়ে অনেক বেশি লাভজনক। তবে, এতে পরিশ্রমও অনেক বেশি। সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়। সামান্য উদাসীনতার কারণে খামারের অনেক বেশি ক্ষতি হতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে খামার করার আগে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। প্রথমে স্বল্প পরিসরে শুরু করতে হবে। কাজের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খামার সম্প্রসারণ করতে পারবে। প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতা ছাড়া একবারে বড় আকারে শুরু করলে তার লোকসান অনিবার্য।

খামার পরিচালনা ব্যয় কমানোর বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বর্তমানে বিষ্টা পরিষ্কার করা, খাবার খাওয়ানো ও পানি পান করানোর জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি পাওয়া যায় যা শ্রমিকের ব্যয় অনেক কমিয়ে দেয়। আধুনিক পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে। অবশ্যই প্রয়োজন মাফিক মানসম্মত খাবার নিশ্চিত করতে হবে। ভেজাল খাবেরর কারণে রোগব্যাধি বেশি হয়। আবার পরিমিত খাবার না খাওয়ালে গ্রোথ কমে, ডিম পাড়া বন্ধ হয়ে যায়। তাই, পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাবার আর নিবিড় পরিচর্যার উপর খামারের লাভ-লোকসান অনেকখানি নির্ভর করে। কর্মচারীর উপর ভরসা না করে নিজেকেই প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থেকে পরিশ্রম করতে হবে। প্রতিদিন প্রতিটি মুরগির পায়খানা, চোখ, ঠোঁট, খাবারের রুচি পরীক্ষা করতে হবে।

মুরগির রোগব্যাধি এবং তার প্রতিকার সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা থাকতে হবে। যেমন শীতকালে বার্ডফ্লু রোগ হয়। এ ছাড়া রাণীক্ষেত, কলেরা, মাইট্রোপ্লাজমা মুরগির কমন রোগ। এসব রোগ থেকে বাঁচাতে সময়মতো ভ্যাকসিন দিতে হবে। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছেÑ বাচ্চা লালন-পালন, ডিম উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে ডিম পৌঁছানো পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়া খামারির নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। ২০ শতাংশ জমিতে একটি মাঝারি মানের খামার গড়ে তোলা যায়।
রংপুর প্রাণিসম্পদ দপ্তরের উপ-সহকারী প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শামসুজ্জোহা বলেন, পোল্ট্রি একটি অনেক বড় সম্ভাবনাময় শিল্প। বর্তমানে রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট ৪৩০টি ছোটবড় সচল খামার রয়েছে। তার মধ্যে ২৬০টি ব্রয়লার এবং ৩৫টি লেয়ার মুরগির খামার। খাদ্যের দাম বৃদ্ধি, পুঁজি সংকটসহ নানা কারণে বেশকিছু খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এই শিল্পের বিকাশে আমাদের দপ্তরের পক্ষ থেকে সব রকম সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির জন্যও আমরা কাজ করছি।

চাকরি ছেড়ে সফল উদ্যোক্তা
বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার দাড়িয়াল ইউনিয়নের পশ্চিম কোষাবর গ্রামের আবু হাসান মুরাদ মুন্সী মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখায় জুনিয়র অফিসার পদে চাকরি করতেন। অন্যের অধীনে চাকরি তার ভালো লাগেনি। সিদ্ধান্ত নেন উদ্যোক্তা হবেন। নেমে পড়লেন নিজের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে। কঠোর পরিশ্রম করে দুটি গরু দিয়ে বাকেরগঞ্জের নিজ গ্রামে গড়ে তোলেন গরুর খামার। যে খামার ঘুরিয়ে দিয়েছে তার ভাগ্যের চাকা। তার খামারে এখন কোটি টাকার গরু রয়েছে। 
উপজেলার দাড়িয়াল ইউনিয়নের আবুল কালাম মুন্সীর পুত্র আবু হাসান মুরাদ মুন্সী। মুন্সী ন্যাচারাল ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী তিনি। এখন মুন্সী ন্যাচারাল ডেইরি ফার্মে ১০ জনের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। তার ফার্মে গরুর সংখ্যা এখন ৫০টি। তিনি প্রথমে ৫ লাখ টাকা নিয়ে ডেইরি ফার্ম শুরু করেন। এখানে তিনি এ পর্যন্ত ৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। নিজস্ব সম্পত্তির ওপর গড়ে তুলেছেন মুন্সী ন্যাচারাল ডেইরি ফার্ম। এই ফার্মের গরুর খাবারের জন্য প্রায় ২ একর সম্পত্তিতে বিদেশী ঘাসের চাষ করেছেন। নিজের চাষকৃত ঘাসে গরুর খাবারের জোগান দেয়। ফার্মের চারপাশে নিচু জমিতে সবুজ ঘাসের সমারোহ থাকে বছরজুড়ে। প্রতিদিন ফার্মের শ্রমিকরা মাঠ থেকে ঘাস কেটে গরুর খাবার দিচ্ছে। 
এইচএসসি পাস করে ঢাকাতে মার্কেন্টাইল ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ব্যাংকে চাকরি তার ভালো লাগেনি। তাই তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে উদ্যোক্তা হয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা করেন। ২০২০ সালের শেষের দিকে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর তিনি গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন। ওই বছরই ৮ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে তিনি দুইটি উন্নত জাতের গাভী দিয়ে তার বাড়িতে ডেইরি ফার্ম শুরু করেন। তারপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, আবু হাসান মুরাদ মুন্সী তার বাড়ির সামনে ১৩০ ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি টিন শেডের পাকা গোয়াল ঘরে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে ডেইরি ফার্ম তৈরি করেছেন। ফার্মে বিশুদ্ধ পানিসহ নিজের উৎপাদিত ঘাস মেশিনে কেটে গরুর জন্য প্রতিদিন খাবার তৈরি করে। প্রত্যকটি গরুর জন্য আলাদা আলাদা খাবার পানির হাউস ও গরুর মাথার ওপর একটি সিলিং ফ্যানের ব্যবস্থা করে রেখেছে। গরুর মলমূত্র অপসারণের দায়িত্বে দুজন কর্মচারী সর্বক্ষণ কর্মরত থাকেন। স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে ফার্মের গরু সুস্বাস্থ্য হয় কম সময়ে বেড়ে ওঠে। প্রতিদিন এই ডেইরি ফার্ম থেকে ২০০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। এই ডেইরি ফার্মের উৎপাদিত দুধ স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে প্রতিদিন বিক্রি করা হয় উপজেলা শহরেও।
আবু হাসান মুরাদ মুন্সী জানান, উদ্যোক্তা হয়ে ডেইরি ফার্ম করা যেতে পারে। এটি লাভজনক ব্যবসা। চাকরির পেছনে না ঘুরে আত্মপ্রত্যয়ী হলেই এই ব্যবসা থেকে লাভ করা যায়। মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়। কোরবানির ঈদ সামনে রেখে আমার ফার্মে বেশ কিছু গরু বাজারে নিতে প্রস্তুত করা হচ্ছে। বাকেরগঞ্জে এবার কোরবানির ঈদ পশুর হাটের আলোচিত গরু আমার ফার্ম থেকে নেওয়া হবে। বিশেষ যতেœ চারটি গরুর লালন-পালন করা হচ্ছে যার নাম দেওয়া হয়েছে টারজেন। টারজেন ওয়ান সাদা কালো কুচকুচে নাদুস-নুদুস গরুটির দাম হাঁকানো হয়েছে ২০ লাখ টাকা। প্রতিদিন গরুটি দেখতে ভিড় জমাচ্ছেন নানা প্রান্তের মানুষ। লম্বায় সাড়ে ৮ ফুট, উচ্চতা ৬ ফুট, ২৫ মণ। আশা করি কোরবানির ঈদ বাজারে আমার ফার্মের গরু বিক্রি করে বেশ লাভবান হব। বর্তমানে আমার ফার্মে এক কোটি টাকার গরু রয়েছে। 

সফল উদ্যোক্তা
একজন সফল উদ্যোক্তা পোল্ট্রি  খামারি শহীদুল ইসলাম সাবু। জন্ম তার বোয়ালী ইউনিয়ন, গাইবান্ধা সদর। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ফল খুব একটা ভালো হয়নি। এ ফল নিয়ে খুব বেশিদূর এগোনো যাবে না, নিজের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হয় শহীদুলের। তাই লেখাপড়ার আনুষ্ঠানিক পাট চুকিয়ে মনোনিবেশ করেন ক্ষুদ্র কৃষি খামারে। তবে এর আগেও অন্য আর একটা গল্প রয়েছে। বেশি টাকা আয়ের নেশায় ১৯৯৩ সালে কৃষিকাজ বন্ধ রেখে চলে যান ঢাকায় চাকরি করতে যায়। সেখানে এক মাস ১৭ দিন চাকরি করে ফিরে আসেন নিজ জেলায়। এসেই শুরু করেন পুরোদমে কৃষিকাজ। সেখানে পান সফলতাও। প্রথমে শুরু করেন মুরগি পালন। বর্তমানে প্রায় ১০০ শতাংশ জায়গায় গড়ে তুলেছেন দুই হাজারেরও বেশি লেয়ার মুরগির ফার্ম। ৫০ হাজার টাকায় শুরু করা ব্যবসায় এখন লাখ লাখ টাকা ইনকাম করছেন তিনি। ১০ থেকে ১৫ জন বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। এখন স্বপ্ন দেখেন বড় উদ্যোক্তা হওয়ার।
সফল শহীদুল ইসলাম জানান, ব্যবসার শুরুটা ছিল আমার স্বপ্নের মতো। শত বাধা আর প্রতিকূলতার মধ্যেও আমি দমে যাইনি, নিরাশ হইনি। যেখানে আমি বেকারত্ব নিয়ে দিশেহারা ছিলাম, সেখানে আজ আমি ১০ থেকে ১৫ জন যুবকের কর্মসংস্থান করছি। আরও কিছু জায়গায় অন্যান্য ফার্ম দিতে ইচ্ছা আছে। ব্যবসায় সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু সমস্যার কথাও জানান ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা শহীদুল। তিনি বলেন, এক সময় এ ব্যবসায় অনেক বেশি লাভ করা যেত। এ ব্যবসার আয় দিয়ে সংসার চালিয়ে তিন ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছি। শহরে বাড়ি করেছি। বর্তমানে পশু-প্রাণীর খাবার ও ওষুধের দাম বৃদ্ধিতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। কোনো কোনো মাসে লাভের বদলে লোকসানও গুনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, উদ্যোক্তাদের কারণে আমাদের মতো মাঝারি বা ছোট উদ্যোক্তাদের টিকে থাকা কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা বাজার দখলে নিয়েছেন। তারা বেশি উৎপন্ন করে কম দামে বেশি বেশি সেল করে পুষিয়ে নেন। কিন্তু আমাদের মতো ক্ষুদ্র বা মাঝারি উদ্যোক্তাদের চাহিদা কম। আমরা কম উৎপন্ন করছি কিন্তু বেশি দামে বিক্রি করতে পারছি না।
গত ১০ বছর ধরে এ খামারেই কাজ করছেন বেলাল  ও হেলাল নামের দুই ভাই। তারা বছরে দুই-একবার বাড়িতে গেলেও এ খামারই যেন তাদের আসল বাড়ি। এ খামারের পশুদের সঙ্গেই তাদের বেশি সখ্য। নিজের সন্তানের মতোই লালন-পালন করে আসছেন খামারের গাভীদের। মুরগির অসুখ-বিসুখে চিকিৎসক ডাকা, সময়মতো ওষুধ খাওয়ানো, ইঞ্জেকশন দেওয়াসহ যাবতীয় কাজ করে থাকেন বেলাল ও হেলাল। সবাই ব্যস্ত থাকেন বিভিন্ন কাজে। কেউ খাবার তৈরি করছেন, মুরগির ফার্ম থেকে ডিম সংগ্রহ করছেন। তারা এ প্রতিবেদককে বলেন, মালিকের অনুপস্থিতে আমরাই খামার দেখাশোনা করি। এ খামারই আমাদের বাড়িঘর, এখানেই থাকা-খাওয়া। মাসের পাঁচ থেকে ১০ তারিখের মধ্যেই বেতন-ভাতা পাই। তা দিয়ে আমাদের সংসার চলে।
এ ব্যাপারে দেবিদ্বার উপজেলা কৃষি কর্মকতা শাহাদাৎ হোসেন জানান, উপজেলা কৃষি বিভাগ সব সময়ই উদ্যোক্তা তৈরি করার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন। শহীদুল ইসলাম আজ একজন সফল উদ্যোক্তা। তাকে দেখে অনেকের শিক্ষা নেওয়া উচিত। চাকরির পেছনে না ঘুরে উপজেলা কৃষি বিভাগ থেকে খামারির প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের খামারেই শত শত বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়।

পোল্ট্রি শিল্পে তদারকির অভাব
প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে পোল্ট্রি খাবার ও ওষুধের দাম। ফলে দেশের অধিকাংশ ডিমের চাহিদা পূরণকারী পিরোজপুরের অনেক মুরগির খামার ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে বেকারত্ব। অন্যদিকে পোল্ট্রির খাবার ও ওষুধের দাম বৃদ্ধির ফলে খামার বন্ধ হওয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুই সহস্রাধিক পরিবার হুমকির মুখে। সরেজমিনে দেখা যায়, দেশের আমিষ চাহিদা পূরণে অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে উপকূলীয় জেলা পিরোজপুর। পাশাপাশি বর্তমান সময়ের অধিক দামের মাছ ও মাংসের বিকল্প হিসেবে মুরগির ডিম সরবরাহকে সচল রেখেছে এ জেলা। 
অন্যদিকে পোল্ট্রি খাদ্যসহ সংশ্লিষ্ট সব কিছুর মূল্যবৃদ্ধি ও সরকারি তদারকির অভাবে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে রয়েছে জেলার আয়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য খাত পোল্ট্রি শিল্প। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে জেলার শতাধিক পোল্ট্রি খামার। ফলে একদিকে যেমন দেনায় জর্জরিত হয়েছেন খামার মালিকরা, অন্যদিকে মূলধন আটকে গেছে খাবার সরবরাহকারীদের। এদিকে সর্বশেষ কয়েক মাসে খাবারের দাম কয়েক দফায় বস্তাপ্রতি দুই শতাধিক টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। খাবারের দাম বাড়ায় ও ডিমের দাম কমায় আর্থিক সংকটে পড়ে ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে জেলার কয়েকশ মুরগির খামার। 
ফলে দেনায় জর্জরিত হয়ে নিঃস্ব হওয়ার পর্যায়ে খামার মালিকরা। এছাড়া খাবার ও ওষুধের দাম বৃদ্ধির কারণে ডিমের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে পোল্ট্রি খামারিদের সঙ্গে বাজারে ডিমের মূল্য নির্ধারণকারীদের সমন্বয় না থাকায় লোকসানে পড়ছেন খামারিরা। ফলে ঋণের পাল্লা ভারি হওয়ায় পোল্ট্রি শিল্প বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন খামারিরা। তবে খামারিদের পরামর্শসহ বিভিন্ন সহায়তা করছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ। শেখ রাসেল নামের এক শ্রমিক বলেন, সর্বশেষ এক বছরে খাবার ও ওষুধের দাম অনেক বেড়েছে। যে খাবার ২২০০ টাকা কিনতাম সেই খাবার এখন খামার পর্যন্ত আসতে ৩৭০০ টাকা খরচ হয়। মুরগি লালন-পালনের ইচ্ছা উবে গেছে আমাদের।

ব্যবসার যে অবস্থা তাতে খামার মালিকরা আমাদের ঠিকমতো বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। তাই তারা শ্রমিক ছাঁটাই করছেন। এতে বহু মানুষ বেকার হয়ে যাচ্ছে। আরেক শ্রমিক শিলা আক্তার বলেন, আগে খামারে কাজ করে শেষ করতে পারতাম না। এখন কাজের চাপ কমে গেছে অনেকটা। ফার্মের সঙ্গে সঙ্গে মুরগিও কমে যাচ্ছে দিন দিন। যে অবস্থা তাতে কতদিন কাজ করে টিকতে পারি জানি না। সরকার যদি খামারিদের ঠিকমতো না দেখে তা হলে কাজ করে আমাদের বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে যাবে। পোল্ট্রি খামার মালিক বাদশা খান বলেন, পিরোজপুর জেলায় কয়েক হাজার পোল্ট্রি খামার রয়েছে। বিগত কয়েক মাসে খাবারের দাম বস্তাপ্রতি এক হাজার টাকা করে বেড়েছে। উৎপাদন করতে আমাদের যেমন খরচ হচ্ছে গোস্ত ডিম বিক্রি করতে গেলে আমরা সেই দাম পাচ্ছি না। যাতে আমাদের টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেক পোল্ট্রি খামার বন্ধ হয়ে গেছে ও যেগুলো বাকি আছে সেগুলো ধীরে ধীরে বন্ধের পথে। 
অনেক পরিবার আছে যারা এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে নিজেদের জীবনজীবিকা নির্বাহ করছে, তারা বেকার হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে খামার শিল্পটি ধ্বংসের মুখে পড়বে। এ নিয়ে আমরা খামারিরা হুমকির মুখে রয়েছি। জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. তরুণ কুমার সিকদার বলেন, পিরোজপুর জেলায় ৫ হাজারের বেশি পোল্ট্রি খামার রয়েছে। যার সঙ্গে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। যারা এখানে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
পিরোজপুরে যে খামারগুলো রয়েছে তা থেকে বছরে প্রায় ৪৫ কোটি ডিম উৎপাদন হয়, যা থেকে দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ডিম ও গোশতের চাহিদা পূরণ হয়। কিন্তু বর্তমানে খাবারের বাড়তি দামের কারণে ডিমের যে উৎপাদন খরচ তার সঙ্গে বাজার ব্যবস্থাপনা সামঞ্জস্য নয়। যারা বাজারে ডিমের মূল্য নির্ধারণ করে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে বিক্রি করলে খামারিরা লাভবান হবেন বলে আমি মনে করি। উপকূলীয় চরাঞ্চল প্রাণিসম্পদ সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রতি ইউনিয়নে ৫শ’ উপকারভোগী খামারি নির্বাচিত হয়েছে। যার মাধ্যমে প্রান্তিক চাষিরা উপকৃত হবে বলে আশা করছি। জেলা ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ খামারিদের বিভিন্ন সময় পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করে থাকে।

×