ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

পরিচ্ছন্ন ও মনোরম শহর রাজশাহী

সড়কে রঙিন বাতি- যেন মিটিমিটি জ্বলছে তারা

সমুদ্র হক/মামুন-অর-রশিদ ॥

প্রকাশিত: ২৩:৩৭, ২৭ মে ২০২৩

সড়কে রঙিন বাতি- যেন মিটিমিটি জ্বলছে তারা

রাজশাহীর আলো ঝলমলে সড়ক

‘রাজা নেই শাহী নেই রাজশাহী নাম, হাতিঘোড়া কিছু নেই আছে শুধু আম’ ষাটের দশকে এমন অনেক জেলার পরিচিতি দিয়ে সুরেলা কণ্ঠের গান ছিল। একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকের মধ্যভাগে রাজশাহী শুধু আমের নয় রাজশাহীর মানুষ সবাই রাজা। রাজশাহী প্রবেশের পর চোখে ধাঁধা লেগে যাবে। এমন ছিমছাম পরিপাটি সাজানো গোছানো পরিষ্কার নগরী হতে পারে। এ তো কল্পনাকেও হার মানায়। ফুলের বাগান তরুলতার ছায়ায় উত্তরবঙ্গের এক মনোরম ভুবন। যেখানে রাতের তারা নেমে আসে।
৯৬ দশমিক ৭২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রাজশাহী মহানগরীর প্রতিটি সড়ক চারলেনের। মধ্যস্থলে (মিডিয়াম বা ডিভাইডার) ফুলের বাগান। একেক সড়কে একেক ফুল। কোথাও সোনালু কোথাও সূর্যমুখী কোথাও গোলাপ-গাঁদা কোথাও অর্নামেন্টাল। সড়কগুলোতে এক টুকরো ময়লা পাওয়া যাবে না। লোকজন কিছু ফেলে না। পদ্মার তীর ঘেঁষা ঢালু বাঁধে দৃষ্টি কেড়ে নেওয়া বাগান। বাঁধে বড় ও মাঝারি গাছের শাখা প্রশাখায় এবং বাগানে  বিভিন্ন ধরনের বাতি দেয়া হয়েছে। রাতে মনে হবে আকাশের তারা নেমে মিটিমিটি জ¦লছে। চারদিকে সবুজ গাছগাছালি। প্রতিটি সড়কের ধারে দশ পনেরো মিটার পর ছাতিম তরু এমনভাবে রোপিত হয়েছে মনে হবে প্রকৃতির ছাতা।

গরমে ছাতিম তরুতলে সাধারণ মানুষ স্বস্তি পায়। হাল্কা বৃষ্টিতে গা ভেজে না। ঋতু পরিবর্তনের সময় সুগন্ধী ছড়ায়। কয়েকটি সড়কের একধারে বহুতল ভবন অপর প্রান্তে সবুজের প্রচ্ছদ। মধ্যের চারলেন সড়কে যানবাহনের নিরবচ্ছিন্ন চলাচল। সহজে কেউ হর্ন বাজায় না। দরকারও পড়ে না। দুই তিনটি পয়েন্টে সাময়িক যানজট ছাড়া কোথাও যানজট নেই। লোকজন স্বাচ্ছেন্দ্যেই চলাফেরা করে।
বাইরে থেকে যারা রাজশাহী যান চারদিকের সৌন্দর্যের মায়ায় মুগ্ধ হয়ে বলবেন বাংলাদেশ না বিদেশের কোনো নগরী। নিকট অতীতে যারা রাজশাহী গিয়েছিলেন তারা সহজে চিনতে পারবেন না। কৌতূহলী প্রশ্নে বলবেন ‘কে বানালেন এই নগরী!’ কথা হয় মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড রাজশাহী কর্মচারি ইউনিয়নের সভাপতি ও বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড কর্মচারি ফেডারেশন ঢাকার মহাসচিব মো. হুমায়ন কবীর লালুর সঙ্গে। বললেন নিজের নগরীকে দেখে নিজেই অভিভূত হয়ে যাই।

জানালেন এই নগরীর রূপকারের হৃদয়ে উন্নত সৌন্দর্যবোধ ছিল বলেই গড়তে পেরেছেন। কে তিনি! এমন প্রশ্নে উত্তর মেলে- শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের ছেলে এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন। যিনি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর গত পাঁচ বছরে যে সুন্দর নগরী উপহার দিয়েছেন তা পূর্বের কোনো সময়ে হয়নি। এলাকার সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বললে একই উত্তর মেলে। রাজশাহীতে যাওয়া এক ব্যক্তি সৈয়দ কবির বললেন রাজশাহীকে অনিন্দ্য সুন্দরে অপরূপ লাগছে।
প্রতিবেদকদ্বয়ের সঙ্গে কথা হয় সাবেক মেয়র এবং মেয়র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নেয়া আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের। বললেন নগরী ঘুরে দেখে আপনাদের ভালো লাগলে তবেই সার্থকতা পাবে উন্নয়ন। তিনি শুধু আধুনিক নগরী গড়ার চেষ্টা করছেন। আপনাকে পুনরায় নির্বাচিত করলে পরের অধ্যায় কি হবে! এমন প্রশ্নে মৃদু হেসে বললেন, রাজশাহীবাসীর আগের ভাবনা এবং উন্নয়নের পরের ভাবনা মিলিয়ে নিলেই উত্তর পাবেন। তবে আগামীতে আরও কি করা যায় তার রূপরেখা হৃদয়ে লালন করে রেখেছেন। তিনি চান এই নগরী দেশের সেরা নগরীর খাতায় উঠে আসুক। হযরত শাহ মখদুম (র) মাজারসংলগ্ন মসজিদ এবং কাছের কেন্দ্রীয় ঈদগা ইসলামী স্থাপত্যে সংস্কার করা হচ্ছে।
চারদিকে ঘুরে যা দেখা গেল পদ্মা পড়ের নীলকুঠি যে ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশেই বনায়নের মধ্যে সৌন্দর্যের কাঠামোগুলো গড়ে উঠেছে। যেখানে প্রজন্মের তরুণ তরুণী ভিড় করে আগামীর পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখে। কথা হয় ক’জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। বললেন এমন নগরী তারা আশা করেন। যেখানে মুক্ত শ^াস নিতে পারেন। লালন শাহ পার্ক, মুক্ত মঞ্চে বসার ট্রেন, টি গ্রোয়েন, আই বাঁধ, পঞ্চবটি বাঁধ, ফুলতলা জাহাজ ঘাট, শ্রীরামপুর এলাকা, রেলগেট থেকে সিঅ্যান্ডবি মোড়, কাশিয়াডাঙ্গা বহরমপুর রেলগেট, ভদ্রা শহীদ কামারুজ্জামান চত্বর, তালাইমারী মোড় থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ, কল্পনা মোড় থেকে কাজলা বিশ^বিদ্যালয়সহ আরও অনেক স্থানকে মোহনীয় রূপ দেয়া হয়েছে। যেন সুন্দরের বংশীবাদক সুর তুলছে।
সড়কের সৌন্দর্যের সঙ্গে বাতিগুলোর মিল রাখা হয়েছে। যেমন রাজমুকুট সড়ক বাতির প্রতিটি পোলে রয়েছে এক সঙ্গে ১৩ টি করে চাঁদের আলোর ¯িœগ্ধ বাতি। কোনো সড়কের পোলের বাতিগুলোর প্রজাপতির পাখায় ঝলমলে হয়ে উঠেছে। সড়কের অর্ধেকেরও বেশি রয়েছে সোলার বাতি। রাতে কখনো অন্ধকার হয় না। পদ্মার তীরে প্রায় ১১ কিলোমিটার হাঁটা সড়ক (ওয়াকওয়ে) টাইলসে মোড়ানো। ফুটপাথ কোনটি ৩০ ফুট চওড়া। অনেক স্থান ফ্রি ওয়াইফাই জোনের আওতায়।
ঢাকার পরের অবস্থানে রয়েছে রাজশাহীর কেন্দ্রীয় চিড়িয়াখানা। সেখানে স্থাপিত শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান বোটানিক্যাল গার্ডেন দেশের অন্যতম। বঙ্গবন্ধু নভো থিয়েটার এবং হাইটেক পার্কের কাজ শেষ পর্যায়ে। রাজশাহীর সিনেমা হলগুলো আর নেই। সিনেমা হলের নামে হয়েছে সড়ক মোড় ও অবকাঠামোর নাম। যেমন বর্ণালী মোড়, অলোকার মোড়, কল্পনার মোড়, উপহার মাল্টিপ্লেক্স। রাজশাহীর সড়কে ব্রিটিশদের ঢোপকলের ইতিহাস সংরক্ষণ করা হয়েছে। অতীতে সুপেয় পানির আধারের নির্মিত ঢোপকলগুলো চওড়া সড়কের মিডিয়ামে রাখা হয়েছে। রাজশাহীর সৌন্দর্যের এতকিছুর পরই একটি কান্না ভেসে আসে পদ্মার তীরে গেলে। একদার প্রমত্তা পদ্মা অনেকদূর সরে গেছে। যত দূর চোখ যায় বালিয়াড়ি চর। ‘পদ্মার ঢেউ রে মোর শূন্য হৃদয় পদ্ম নিয়ে যা যা রে’ গানের সেই সুরের ঢেউ নেই। পদ্মা হৃদয় নিয়ে যায় না। সেই হৃদয় ধরে রেখেছে পদ্মা পাড়ের মহানগরীর সৌন্দর্য।

×