ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাঙ্গামাটি

আওয়ামী লীগ বিএনপিতে কোন্দল ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

মোহাম্মদ আলী, রাঙ্গামাটি

প্রকাশিত: ০০:২৪, ১৯ এপ্রিল ২০২৩

আওয়ামী লীগ বিএনপিতে কোন্দল ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা

তিন পার্বত্য জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসন হলো ২৯৯ রাঙ্গামাটি আসন

তিন পার্বত্য জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসন হলো ২৯৯ রাঙ্গামাটি আসন। স্বাধীনতার পর থেকে নানা কারণে এই আসনটি পার্বত্যবাসীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিন পার্বত্য জেলায় বিভক্ত করার পূর্বে রাঙ্গামাটি ছিল তিন জেলার প্রাণকেন্দ্র। আয়তনের দিক দিয়ে এটি দেশের ৩শ’ আসনের মধ্যে সবচেয়ে বড় নির্বাচনী আসন। 
১০টি উপজেলা ও ১২টি থানা ২টি পৌরসভা ও ৫০টি ইউনিয়ন নিয়ে এই আসনটি গঠিত। প্রায় সোয়া ৬ লাখ জনসংখ্যার এই জেলায় প্রায় ৫ লাখ ভোটার রয়েছে। কাপ্তাই লেকের স্বচ্ছ বিশাল জলরাশি ও পাহাড় ঘেরা ২৯৯নং আসনের এই জনপদ বরাবরই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসাবে খ্যাত। ঐতিহ্যগতভাবে এই আসনটি পার্বত্যবাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। 
ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির মূল নেতৃত্ব তথা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমা, দীপংকর তালুকদার, ঊষাতন তালুকদার, চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় ও গৌতম দেওয়ান এই সব হেভিওয়েট নেতারা সকলেই রাঙ্গামাটির আসনের অধিবাসী। নেতৃত্বে দ্বন্দ্বের কারণে মাঝে মধ্যে এই আসনে বিএনপি ও আঞ্চলিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ভাগ বসায়। দেশের প্রথম উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্রটি রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় অবস্থিত। এটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন উদ্বোধন করেছিলেন। এটি দুই পাহাড়ের মাঝে দেখার মতো দৃষ্টিনন্দন একটি স্থান। তাছাড়া পশ্চাৎপদ আবহেলিত এই পার্বত্য জনপদের স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখানে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় এবং এ অঞ্চলে একমাত্র মেডিক্যাল কলেজ স্থাপন করেছেন। যার কারণে সমগ্র পার্বত্যবাসী উপকৃত হচ্ছে।
এসব কারণে নির্বাচনী এই আসনটির সাধারণ লোকের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থক বেশি। শিক্ষার প্রসারের জন্য এখানে প্রতি উপজেলায় একটি করে হাইস্কুল ও ৭ উপজেলায় একটি করে কলেজ সরকারিকরণ করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব বিপ্লব সাধিত হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো সীমান্ত সড়ক তৈরি। জেলায় ৬টি বড় ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। এদের মধ্যে তিনটিই নির্মাণ করা হয়েছে রাঙ্গামাটি পৌরসভা এলাকায়। 
এছাড়া জেলার সবচেয়ে বড় ও নান্দনিক ব্রিজ হলো নানিয়ারচর ব্রিজ। এই ব্রিজটির দৈর্ঘ্য ৫শ’ মিটার। এছাড়া লংগদুর গাতাছড়া ব্রিজ ও বাঘাইছড়ি কাচালং খালের ব্রিজ অন্যতম। এদের মধ্যে শহরের ২টি ও গাতাছড়া ব্রিজ দেখার মতো যা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড নির্মাণ করেছে। এই সরকারের আমলে উন্নয়ন বোর্ডের বদৌলতে জেলায় সেচ নর্দমা, সড়ক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রচুর উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে কাপ্তাই লেকের ড্রেজিং না হওয়া ও অন্য দুই জেলার তুলনায় রাঙ্গামাটিতে পর্যটন খাতে উন্নয়ন না হওয়ায় এই দুইটি সেক্টরের ওপর নির্ভর কয়েক লাখ সাধারণ মানুষ এটিকে ভাল চোখে দেখছে না। একই সঙ্গে শহরে সড়ক কেটে এলজিইডি ২টি ব্রিজ করায় মানুষ খুশি হতে পারেনি। 
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও আঞ্চলিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি নির্বাচনী মাঠ দখলের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এই আসনে ত্রিমুখী হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দীপংকর তালুকদার বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অবশ্য সেই সময়ে জনসংহতি সমিতি আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী মনি স্বপন দেওয়ান নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পুনরায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী দীপংকর তালুকদার এমপি নির্বাচিত হন। পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির পক্ষ থেকে উষাতন তালুকদার এমপি নির্বাচিত হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দীপংকর তালুকদার আবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। 
তবে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচনী এলাকাটির রাজনৈতিক হালচাল পাল্টে যেতে শুরু করেছে। বিএনপি ঘরের বিবাদে জড়িয়ে পড়লেও খুব একটা সুখে নেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও। বর্তমানে জনসংহতি সমিতি এখানে অনেকটা সুসংহত। বিপরীতে আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে অনেকটা মান-অভিমানের দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। বিগত বছরে জেলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে এই দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কাউন্সিলের ১০ মাস পর সম্প্রতি জেলা কমিটি অনুমোদন হয়ে আসছে। এতে পুরনো কমিটির ১৮ জন ত্যাগী সদস্য বাদ পড়েছে। বাদপড়া সকলে মিলে সম্প্রতি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদককে দাবি সংবাদ সম্মেলন করেছে। এই ধরনের সংবাদ সম্মেলন বিগত ২৭ বছরে এই প্রথম হয়েছে। 
আগামী নির্বাচনে এই রাঙ্গামাটি আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বারবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য অন্যতম শক্তিশালী প্রার্থী। আগামী নির্বাচনেও তিনি মনোনয়ন চাইবেন জানিয়ে দীপংকর তালুকদার জনকণ্ঠকে জানান। একই সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা দলের সম্ভাব্য প্রার্থী হতে পারেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এর বাইরেও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও দলের সহ-সভাপতি চিংকিউ রোয়াজা প্রার্থী হওয়ার কথাও মাঠে এসেছে। 
তবে নিখিল কুমার চাকমাকে পুনরায় বোর্ড চেয়ারম্যান করা হলে সেই ক্ষেত্রে ভিন্ন অবস্থাও হতে পারে। তিনি সাদামাটাভাবে চলাফেরা করেন বিধায় তার যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও রয়েছে। তবে দীপংকর তালুকদার অনেক পরিপক্ব রাজনীতিবিদ, নির্বাচনী এলাকায় তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা বিগত নির্বাচনগুলোতে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন বলে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর জানান। তিনি বলেন, তাদের দল আগের চেয়েও অনেক সুসংহত। 
এদিকে, বিএনপির টার্গেট আসনটি পুনরুদ্ধার করা। দল চাইলে বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী মনিস্বপন দেওয়ান আগামী নির্বাচনে অংশ নেবেন বলে জানান। এছাড়া অ্যাডভোকেট দীপেন দেওয়ান ও একজন বাঙালি প্রার্থীও বিএনপির মনোনয়ন চাইতে পারে। এর মধ্য থেকে দলীয়ভাবে প্রার্থী নির্ধারণ করা অনেকটা দুরূহ ব্যাপার হবে। সেই ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে। তবে দলের হাইকমান্ডের মতে, বিএনপিতে কোনো ধরনের কোন্দল নেই। 
অন্যদিকে, এই আসনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতিতেও কোনোরূপ দ্বন্দ্ব নেই বলে দলের একাধিক সূত্রে জানা যায়। তাদের একক প্রার্থী হবেন দলটির সহ-সভাপতি ঊষাতন তালুকদার। এই আসনে জাতীয় পার্টির শক্ত কোনো অবস্থান নেই। এখানে অপর আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফেরও তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। 
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির উভয় দলেই গৃহবিবাদ রয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের গৃহবিবাদ অনেকটা প্রসার লাভ ঘটেছে। এখানে দল বঞ্চিত ত্যাগী নেতা, দলের নিস্ক্রিয় নেতা এবং বিএনপি-জামায়াত থেকে অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে একটি বড় দ্বন্দ্ব রয়েছে। যা দিন দিন শাখা প্রশাখা বিস্তার করে চলছে। এছাড়া একজন চাকরিজীবী ওলেমা লীগ নেতার কারণে ওলামা মাশায়েকগণ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে আছে। তবে ঘরের বিরোধ মিটাতে পারলে আগামী নির্বাচনেও ফসল আয়ামী লীগের ঘরেই উঠবে। তবে নির্বাচনের আগে এই দ্বন্দ্ব নিরসন করতে না পারলে আগামীতে এই আসনটি ধরে রাখা আওয়ামী লীগের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।

×