ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৪ মে ২০২৫, ২১ বৈশাখ ১৪৩২

কালের সাক্ষী ঐতিহাসিক নসরত গাজীর মসজিদ

সংবাদদাতা, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল 

প্রকাশিত: ১৭:৪৫, ২৭ মার্চ ২০২৩

কালের সাক্ষী ঐতিহাসিক নসরত গাজীর মসজিদ

নসরত গাজীর মসজিদ

বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলায় উপজেরা সদর থেকে তুলাতলী নদীর উপর নির্মিত বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খান সেতু হয়ে ১৫ কি: পূর্বে কবাই ইউনিয়নের শিয়ালঘুনি গ্রাম। এই গ্রামের চৌধুরী বাড়িতে অবস্থিত মুসলমানদের স্থাপত্যশিল্পের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন নসরত গাজীর ঐতিহাসিক জামে মসজিদ। প্রাচীন এই মসজিদের সীমানায় প্রবেশের প্রধান ফটকে প্রতিষ্ঠাকাল ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দ লেখা থাকলেও মসজিদটির নির্মাণকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য আজও পাওয়া যায়নি। মসজিদটি প্রায় ৫ শত বছরের পুরোনো বলেই জানান স্থানীয় বাসিন্দারা।

বাকেরগঞ্জে ৫শ বছর পূর্বে সুলতানী শাসনামলে স্থাপিত এই মসজিদ, যা আজও স্মরণ করিয়ে দেয় মুসলিম স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের কথা। আর এ মসজিদ এখন তালুকদার বাড়ী নসরত গাজীর ঐতিহাসিক জামে মসজিদ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু এক গম্ভুজ বিশিষ্ট্য মসজিদ, যার মধ্যে তালুকদার বাড়ী নসরত গাজীর ঐতিহাসিক জামে মসজিদ আজো টিকে আছে। যার নির্মাণশৈলী সবগুলোরই একই রকম। তৎকালীন সময়ে এদেশে যাঁরা ধর্ম প্রচারে এসেছিলেন তারাই হয়তো এগুলো নির্মাণ করেছেন। ঐসময়ে জনসংখ্যা কম থাকার কারনে আকারে এগুলো ছোট্ট করা হয়েছিল। তবে মসজিটি ঠিক কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সঠিক কোন ইতিহাস পাওয়া না গেলেও মসজিদটির গঠনশৈলি ও নির্মানের উপাদান মোগল আমলে নির্মিত মসজিদ এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

সে হিসেবে মসজিদটি প্রায় পাঁচ শত বছরেরও বেশি পুরনো। পাঁচ’শ বছরেরও বেশি সময় ধরে মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের ঐতিহ্য বহন করে আজো দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয়দের মতে জেলার সবচেয়ে পুরনো মসজিদ এর মধ্যে এই নসরত গাজীর মসজিদ অন্যতম।

এখনো নসরত গাজীর মসজিদে প্রতিদিন মুসুল্লীগন নামাজ আদায় করেন। মসজিদের ভিতরে ২৪ জন ও  ইমাম সহ ২৫ জন মুসল্লী একসাথে নামাজ আদায় করেন। মসজিদটির ভিতরে প্রবেশপথে পূর্ব দিকে একটি দরজা উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি জানালা রয়েছে। মসজিদটি প্রায় ৫০ ফুট উচু। এ উপরে রয়েছে বিশাল একটি গম্বুজ। দীর্ঘদিন সংস্কারের অভাবে বর্তমানে মসজিদের নানা কারুকার্য অস্তিত্ব ধ্বংসের শেষ পর্যায় পৌঁছেছে। একটি গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটি কোনো রড-সিমেন্ট ছাড়াই চুন-সুরকি ও পোড়ামাটির ইট দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদের দেয়াল প্রায় ৬০ ইঞ্চি পুরো। আর মসজিদের ভিতর দিকে রয়েছে নানা কারুকাজ খচিত মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের প্রাচীনতম নিদর্শন।

সরেজমিনে দেখা যায়, মসজিদের চার কোনায় চারটি অষ্টভুজাকার স্তম্ভ রয়েছে। পূর্ব, দক্ষিণ, উত্তর দিকে গথিক (ইউরোপের শিল্প ইতিহাসে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কাল গথিক শিল্পের কাল) খিলান বিশিষ্ট প্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদের ভেতরে পশ্চিম দেয়ালে একটি মিহরাব রয়েছে। এ ছাড়া উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে ছোট ছোট চারটি মিহরাব ও আলোকবাতি রাখার স্থান রয়েছে। মসজিদটির দেয়াল, কার্নিশ ও স্তম্ভে ফুল লতাপাতার কিছু অলংকরণ রয়েছে। 

কবাই ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের মধ্য শিয়ালগুলি গ্রামের মৃত্যু আবুল হোসেন চৌধুরীর পুত্র মসজিদ কমিটির সভাপতি বশির চৌধুরীর সাথে কথা হলে তিনি  

জনকণ্ঠকে জানান, এলাকার মুসল্লীরা নসরত গাজীর মসজিদে প্রতিদিন নামাজ পড়তে আসেন। রমজান মাসে ১৫০ জনের বেশি মুসল্লী প্রতিদিন মসজিদে আসে। তাই ২০১৪ সালে আমি ১৪ লাখ টাকা ব্যায় করে নসরত গাজীর মসজিদে সাথে নতুন ভবন নির্মাণ করে দেই। প্রতিদিন এখন মসজিদে আজান হয় মুসল্লিরা নামাজ আদায় করেন। তবে মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় আসার পর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কিছু সংস্কার কাজ করা হয়েছে। তবে অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের কার্যক্রম এখনো চালু না হওয়ায় গোটা বিভাগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন গুলো নিয়মিত দেখভাল তারা করছে না।

মসজিদের মুসল্লী মো: সাঈদ চৌধুরী বলেন, মসজিদটিতে বর্তমানে ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো. নূরুল হক। ঐতিহাসিক মসজিদ হওয়ায় এখানে বিভিন্ন এলাকা ও দেশের বাইরে থেকে তাবলিগ জামাতের মুসল্লিরা প্রায়ই আসেন। মসজিদটির বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরেছে। মসজিদটি সংরক্ষণ ও সংস্কারের জন্য সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি। 

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাকেরগঞ্জ ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার’ এ ফুল ও লতাপাতার নান্দনিক অলংকরণ বিশিষ্ট এই মসজিদের বর্ণনা আছে। গেজেটিয়ারেও মসজিদটির গায়ে থাকা শিলালিপি হারিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। ১৮৮৬ সালে বাকেরগঞ্জের তৎকালীন (বর্তমান বরিশাল জেলা) ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরেট এইচ বেভারেজের লেখা ‘দি ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ’ গ্রন্থেও এই মসজিদের বর্ণনা পাওয়া যায়।

হোসেন শাহী আমলের প্রথম শাসক আলাউদ্দিন হোসেন শাহর মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ ছেলে নাসির খান নাসিরউদ্দিন নুসরাত শাহ উপাধি নিয়ে বাংলার সিংহাসনে বসেন। তাঁর শাসনকাল ছিল ১৫১৯ থেকে ১৫৩৩ সাল পর্যন্ত। ধারণা করা হয়, এই সময়ে নসরত গাজী নামের তাঁর এক অনুসারী শিয়ালঘুনী গ্রামে মসজিদটি নির্মাণ করেন।

মুসলিম স্থাপত্যের এ নিদর্শন সরকারের একটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত এবং তত্ত্বাবধানে রয়েছে। প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্র জানায়, মসজিদটির প্রবেশ পথের খিলান নকশার সঙ্গে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদের প্রবেশপথের খিলান নকশার যথেষ্ট মিল রয়েছে।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের কাস্টোডিয়ান মো. আল আমিন বলেন, নসরত গাজীর মসজিদটি কত সালে নির্মিত তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এর কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি। তবে জনশ্রুতি আছে, এটা ষোড়শ শতকে নির্মিত। তবে অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের কার্যক্রম এখনো চালু না হওয়ায় গোটা বিভাগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন গুলো নিয়মিত দেখভাল করা সম্ভব হচ্ছে না।

এমএস

×