ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

দমকল থেকে ফায়ার ব্রিগেড

সমুদ্র হক

প্রকাশিত: ০১:৫৪, ২৪ মার্চ ২০২৩

দমকল থেকে ফায়ার ব্রিগেড

প্রায় দুইশ’ বছর আগের পরিচিতি দমকল

প্রায় দুইশ’ বছর আগের পরিচিতি দমকল। আজও দেশে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে ‘দমকল’ নামেই ডাকে সাধারণ মানুষ। সুধীজনে কখনো বলা হয় ফায়ার ব্রিগেড। কখনও বলে ফায়ার সার্ভিস। জীবন বাজি রেখে যারা আগুন নেভায় এবং সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের উদ্ধার করে তারা ফায়ার ফাইটার (অগ্নিযোদ্ধা)। আগুনের উৎসের ভুল খবর পেয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে কখনো তাদের মৃত্যু ঘটে। যেমন গত বছর সীতাকু-ে ভয়াবহ আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার ফাইটাররা পানি দিয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে জীবন বিপন্ন করে ফেলে। তাদের ৯ কর্মী মারা যান।

তিনজন আজও নিখোঁজ। খবর দেওয়ার সময় তাদের বলা হয়নি বিস্ফোরকের আগুনের কথা। সঠিক খবর পেলে তারা পানির বদলে ভিন্ন রাসায়নিক ব্যবহার করে আগুন নেভাতো। দেশে ফায়ার ফাইটারের মৃত্যুর ঘটনা ছিল সেটাই প্রথম। আগুনে ফায়ারফাইটাররা মানুষের ভরসা।
 ফোনে আগুন লাগার কথা শুনলেই নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে অতি দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে মানুষের জীবন ও সম্পদ যারা বাঁচায় তাদের কথা ক’জনাই মনে রাখে। তাদের এই পরিষেবা না থাকলে সাধারণ মানুষের পক্ষে আগুন নেভানো কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। অতীতের দিকে তাকালে দেখা যাবে : একদা কোনো গ্রামের জীর্ণ কুটিরে আগুন লাগলে স্ফুলিঙ্গ বাতাসে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে গিয়ে পড়ে গ্রাম পুড়ে ছারখার হয়ে যেত। তখন আগুন নেভানোর ফায়ার ব্রিগেড ছিল না। 
ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুতে অবিভক্ত ভারতে কেবল গড়ে ওঠা কলকাতা শহরে বেশিরভাগ বাড়ি ছিল খড়ের চালায় বেড়ার ঘেরায়। মাঝেমধ্যে আগুন লাগলে কলকাতা পুলিশ আগুন নেভানোর কাজ করত। খবর পেয়ে সেখানে পৌঁছাতে সময় লাগত। ওই সময়ে উঁচু বাঁশের মাচায় একজন করে লোক পালাক্রমে বসিয়ে রাখা হতো। দায়িত্ব ছিল চারদিকে নজর রাখা। আগুনের ধোঁয়ার কু-লী দেখলেই শিঙায় ফুঁকে সতর্ক করে দিত।

১৮২০ সালে ব্রিটিশরা কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায় লাল রঙের লোহার একটি বাক্স স্থাপন করে। এই বাক্সের ভিতরে কাচের একটি খোপে থাকত ঘুরানোর হাতল। বলা হতো দম দেওয়ার কল। কাচ ভেঙে এই হাতল ঘোরালেই মাটির নিচে পাতা তারের মাধ্যমে খবর পৌঁছে যেত ফায়ার ব্রিগেডের কাছে। সেই থেকেই এই বাহিনীর নাম হয় ‘দমকল বাহিনী’।

এই যন্ত্র তৈরির পিছনে ছিলেন ব্রিটিশ অফিসার বার্নাড অ্যনসন ওয়েস্টব্রুক। যা ছিল উপমহাদেশে প্রথম ফায়ার এ্যালার্ম। ফায়ার ব্রিগেডের পানিবাহী গাড়ির পাম্প চালু হতো হাতল ঘুরিয়ে দম দিয়ে। পরে এই দমকল নামটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে আজও পরিচিতি বহন করছে। ঢাকায় দমকল বসানো হয়। ব্রিটিশরা অবিভক্ত ভারতে ১৯৩৯ সালে পুরান ঢাকায় ফায়ার ব্রিগেড স্থাপন করে। তখন নাম ছিল বেঙ্গল ফায়ার ব্রিগেড। নাম ফায়ার ব্রিগেড হলেও দমকল নামটি আর যায়নি। দেশ বিভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফায়ার ব্রিগেডের হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয় ঢাকায়।

যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান। গত শতকের পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ থেকে ষাটের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত দেশের বৃহত্তর জেলাগুলোতে পানিবাহী ও পাম্পবাহী যানসহ ফায়ার স্টেশন স্থাপিত হয়। ১৯৬৩ সালে বগুড়া শহরের শেরপুর রোডের ধারে ১ দশমিক ৭১ একর ভূমির ওপর স্থাপিত হয় ফায়ার স্টেশন। সেই থেকে ওই জায়গাতেই অফিস অবকাঠামোর উন্নয়নসহ আধুনিক যানবাহন যুক্ত হচ্ছে।

১৯৮১ সালের ৯ এপ্রিল এ্যাস্বুলেন্স সার্ভিস যুক্ত করে নামকরণ হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (এফএসসিডি)। সূত্র জানায় বর্তমানে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলা এবং প্রতিটি উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্সের অফিস আছে। এর সংখ্যা ১২৯টি। প্রতিটি ফায়ার স্টেশনে সিনিয়র স্টেশন অফিসার, স্টেশন অফিসার এবং সহকারী পরিচালক ও উপসহকারী পরিচালকগণ আছেন।

প্রতিটি ফায়ার স্টেশনে ফায়ার ফাইটার থাকেন ১২ থেকে ২৫ জন করে। তবে বড় শহর ও নগরীতে এরচেয়ে বেশি ফায়ার ফাইটার থাকেন।   
প্রতিটি ফায়ার স্টেশনে মান ও এলাকার অবস্থান অনুযায়ী বিভিন্ন ধারণ ক্ষমতার পানিবাহী গাড়িসহ পাম্প টানা গাড়ি আছে। বগুড়া ফায়ার স্টেশনে আছে সাড়ে ৬ হাজার ও সাড়ে চার হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতায় দুটি পানিবাহী গাড়ি ও দুটি পাম্পটানা গাড়ি। এর সঙ্গে আছে বিশেষ ধরনের মই। বগুড়ার ১০তলা ভবনে আগুন নির্বাপণ করা যায়। এর সঙ্গে আছে সড়ক দুর্ঘটনায় উদ্ধারের নানা ধরনের যন্ত্রপাতি। যেমন স্প্রেডার, র‌্যামজ্যাক, হাইড্রলিক কাটার ইত্যাদি। ফায়ার স্টেশনের মধ্যে আছে ২০ হাজার লিটার ধারণ ক্ষমতায় আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভার। উপজেলাগুলোতে একটি করে পানিবাহী ও একটি করে পাম্পটানা গাড়ি আছে।

কর্মকর্তা জানালেন ফায়ার সার্ভিসে বর্তমানে উন্নতমানের টার্ন টেবল লেডার (টিটিএল) গাড়ি আছে ঢাকায়। এই গাড়িতে পানি ধারণক্ষমতা ১১ হাজার লিটার। এই যানবাহন দিয়েই ফায়ার সার্ভিস অগ্নিনির্বাপণসহ মহাসড়কের দুর্ঘটনায় হতাহতদের রেসকিউ করছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আগুন নেভানোয় দক্ষতা অর্জনে উচ্চতর প্রশিক্ষণের পাশাপাশি সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনায় রেসকিউ অপারেশনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বহুতল ভবনে আগুন নেভানোর কাজে জীবন বাজি রেখে তাদের কাজ করতে হয়।

আগুন নেভানোর সময় আগুনে পোড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে তারা। বগুড়া ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার আবদুল হালিম জানালেন, তিনি ঢাকায় থাকাকালে বহুতল ভবনের এবং পুরনো ঢাকায় ঘিঞ্জির মধ্যে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। বললেন আগুন নিভিয়ে সম্পদ রক্ষা এবং অগ্নিদগ্ধদের বাঁচাতে পারার এই মহৎ সেবা তাকে এই পেশায় টেনে এনেছে। বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে মানবতার সেবায় তিনি অগ্নিযোদ্ধা হিসেবে যোগ দেন।

গত ১৯ বছর ধরে তিনি এই পেশায় থেকে সেবা দিচ্ছেন। বললেন, আগুন লাগার খবর দেওয়ার সময় কোনো উৎস থেকে আগুন লেগেছে তা জানানো দরকার। কোন আগুন পানিতে নিভবে কোন আগুন ফোমে নিভবে তা জানতে পারলে আগুন নিয়ন্ত্রণ আনা দ্রুত হয়।
বর্তমানে আগুন লাগার কয়েকটি কারণের মধ্যে আছে-বিদ্যুতের শর্ট সার্কিট, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, বিড়ি সিগারেট, গ্যাস সিলিন্ডার, যন্ত্রাংশের ঘর্ষণ, উচ্ছৃঙ্খল জনতার অগ্নিসংযোগ, বাজি ও ফানুস পোড়ানো, বয়লার বিস্ফোরণ, গ্যাস সরবরাহ লাইনে ফাটল, রাসায়নিক দ্রব্য ও বিস্ফোরক, গ্রামে মাটির চুলা, উত্তপ্ত ছাই, চিমনির স্ফুলিঙ্গ, ছোটদের আগুন নিয়ে খেলা।

চলতি বছর ফায়ার সার্ভিসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছর ৯ মার্চ পর্যন্ত দেশে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে ২৪ হাজার ১৬৩টি। এই ঘটনায় মারা যান ১২৮ জন। অগ্নিকা-ের ঘটনায় কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। ২০২১ সালে অগ্নিকা-ের ঘটনা ছিল ২১ হাজার ৬০১টি। ওই বছর মারা যান ২১৯ জন। প্রতিদিন দেশে গড়ে ৬৩টি অগ্নিকা- ঘটে।  
উত্তরাঞ্চলের ডুবুরির সংখ্যা খুবই কম। রাজশাহী ও রংপুর ফায়ার স্টেশনে ৮ জন ডুবুরি আছেন। নৌকাডুবি ও পানিতে ডোবার ঘটনায় বিভাগীয় শহর থেকে জেলা ও উপজেলায় ডুবুরি পাঠানো হয়। ততক্ষণে কি ডুবন্ত মানুষকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব। এই বিষয়ে এক কর্মকর্তা বললেন, অনেক সময় পানিতে ডোবা ব্যক্তির মরদেহ পাওয়া যায় না। ডুবুরিরা সেই মরদেহ উদ্ধার করে দেন। 

সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস

×