আশরাফুল ইসলাম জগলু
বীর মুক্তিযোদ্ধা আরশাদ আলীর লাশ রণক্ষেত্র থেকে আমিই কাঁধে করে নিয়ে এসেছিলাম। এক মওলানাকে ডেকে জানাজা শেষে তাঁকে দাফন করে ৩১ বার রাইফেলের গুলি ছুড়ে তোপধ্বনি দেওয়া হয়েছিল। নীলফামারীর ডিমলার পশ্চিম ছাতনাই ইউনিয়নে বাঁশঝাড়ের নিচে শ্বেতপাথরে বাঁধাই করা রয়েছে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি। তাঁর নামানুসারে গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে আরশাদগঞ্জ। গ্রামের ঈদগাহ মাঠ এবং হাটের নামকরণও করা হয়েছে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরশাদের নামে।
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার কাছে এটি একটি অন্যতম স্মৃতি- বললেন মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী সিরাজগঞ্জের বাহুকা গ্রামের চৌধুরী পরিবারের সন্তান সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আশরাফুল ইসলাম চৌধুরী জগলু।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে একাত্তরের ২৮ অক্টোবরের রক্তক্ষয়ী টুনিরহাটের সেই যুদ্ধদিনের কথা। বীর মুক্তিযোদ্ধা জগলু চৌধুরী অপারেশনে অংশ নেন ৬নম্বর সেক্টরের অধীনে ডিমলা এলাকার টুনিরহাট, থল, হাতিবান্ধা, বাওড়া, বড়খাতা, শঠিবাড়ি ও খড়িবাড়িসহ বেশকিছু এলাকায়। তারা ছিলেন গেরিলা। দিনে আত্মগোপন করে থাকতেন, সন্ধ্যায় খাবার খেয়ে রাতে গ্রুপ করে বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন করতেন।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, নীলফামারীর ডিমলার টুনিরহাটের টাউড়িদহ এলাকায় ছিল পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকারদের বড় ক্যাম্প। আমরা ছিলাম থল এলাকায়, বাঁশঝাড়ে বাঙ্কার করে থাকি। সকালেই খবর আসে রেকি করতে যেতে হবে টুনিরহাট। রেকি করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে স্থানীয় ভাষার কারণে। তবুও নানা তথ্য নিয়ে ক্যাম্পে ফিরি। দুপুরে সিদ্ধান্ত হয় আক্রমণের। মনি ভাই ছিলেন ওই অপারেশনের কমান্ডার।
তিনি বলেন, ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় আমরা রওনা হই। পরিকল্পনা মোতাবেক ২৮ অক্টোবর খুব ভোরে অ্যাটাকে যাব। সবাইকে জাগিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব থাকে সেন্ট্রিদের। কিন্তু প্রচ- ক্লান্তিতে তারাও ঘুমিয়ে যায়। যখন ঘুম ভাঙে তখন সকাল, রোদ উঠেছে। কমান্ডার মনি ভাই নির্দেশ দিয়ে বলেন, গো। তিনটি গ্রুপ ছিল আমাদের একটা অ্যাম্বুশ, একটা হিট, একটা রিজার্ভ। কিন্তু দেরি হওয়ায় আক্রমণের কোনো পরিকল্পনাই ঠিক থাকে না। ডোবার মতো এক জায়গায় সবাই গিয়ে একসঙ্গে পজিশন নিলাম। পাকিস্তানি সেনারা ছিল একটু উঁচুতে, পাড়ের ওপর এক স্কুলের ভেতর ক্যাম্প করা।
ক্যাম্পের চারপাশে তারা মজবুত বাঙ্কার তৈরি করেছে কলাগাছ ও বড়গাছের গুঁড়ি দিয়ে। ওরা আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র। কেউ কেউ মগ ও বদনা হাতে দাঁড়িয়ে। তখনই ফায়ার ওপেন করি। দুই ইঞ্চি মর্টার তিনটা ফোটাই। নিয়ম হলো একবার এই মর্টার মেরেই পজিশন চেঞ্জ করতে হবে। ওটা করতে যাওয়ার আগেই পাকি হানাদাররাও বেশ কয়েকটা মর্টার শেল মারে। শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি।
এলএমজির দুটি ম্যাগাজিন ফোটানোর পরে গুলি আটকে যায় চেম্বারে। ম্যাগাজিনসহ অন্যান্য জিনিস থাকত টুআইসির কাছে। টুআইসি ছিলেন শহিদুল। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সহযোদ্ধা শাহজাহানও পাশে নেই। সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই পাকিসেনাদের গুলির মুখে। ফলে আর এগোতে পারিনি। কথা ছিল এমনটা ঘটলে উইথড্র করে ওই গ্রামেই দূরে একটা বড় আমগাছের কাছে সবাই একত্রিত হবে। ওখানে শহিদুলকে নিয়ে আসে এক লোক। তার সারা শরীর কাদায় মাখা। অপারেশনের সময় সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। ফিরে এসে সেই-ই জানাল, সহযোদ্ধা আরশাদ আলী নিহত হয়েছে।
লাশ পড়ে আছে ক্ষেতের ভেতরে। আরশাদের বাড়ি ছিল লালমনিরহাটের আদিতমারীতে। সহযোদ্ধার মৃত্যুর খবরে বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। সহযোদ্ধা হায়দারসহ আমরা আরশাদের লাশ আনতে যাই। পাকি হায়েনা দলের গুলি তার বুক ও গলা ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। ক্ষতস্থানে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। নিথর দেহ পড়ে আছে ধানক্ষেতে। এখনো চোখের সামনে ভাসে ওই করুণ দৃশ্যটা। আরশাদ আলীর লাশটা কাঁধে তুলে নিয়ে আসি।
ওই গ্রামেই তাকে দাফন করি। তাকে শ্রদ্ধা জানাতে আকাশের দিকেও গুলি ছুড়ি। ওই গ্রামের নাম ছিল বাদিয়াপাড়া। আরশাদকে কবর দেওয়ার পর আমরা ওই জায়গাটার নাম দেই আরশাদগঞ্জ। পরে আমরা খবর পাই, ওই অপারেশনে ১৭ পাকিসেনা ও ২০ রাজাকার খতম হয়েছিল।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন আমি দশম শ্রেণির ছাত্র। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে এবং বড় ভাই তৎকালীন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা আমিনুল ইসলাম চৌধুুরীর অনুপ্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেই। মে মাসের ১০-১২ তারিখের দিকে ১৭ জন ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হই নৌকায় যমুনা নদীর পথ ধরে। আমি ছাড়া চাচাতো ভাই দুলাল, ভাতিজা মিন্টু, বাবলু চৌধুরী, লুৎফর রহমান, বাছেদ, আব্দুল্লাহ, মোফাজ্জল প্রমুখ ছিলেন। নৌকা কখনো গুন টেনে, কখনো দাঁড় টেনে, কখনো লগি দিয়ে এগোয়। অন্যরা নৌকার পাটাতনের নিচে লুকিয়ে থাকে।
সরিষাবাড়ী, জামালপুর হয়ে ছয়দিন পর নামি মানকারচর। পাশেই পাহাড়ের ঢালে নেমে হাঁটছি। পাহাড়ের ভেতর থেকে আর্মি বের হয়ে আসে। ওরা ছিল গোর্খা। পরিচয় দেই। প্রশিক্ষণ নিতে আসছি জানাই। এমপিএ বা এমএনএর চিঠি না হলে ছাড়বে না বলে জানায় ওরা। বাবলুকে পাঠানো হলো মানকারচরে। আমাদের ওখানকার এমএনএ ছিলেন মোতাহার হোসেন তালুকদার। সংগ্রাম পরিষদের সভাপতিও ছিলেন। খবর পেয়ে উনি মানকারচর থেকে নৌকায় চলে আসেন।
সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে প্রথমে নতুনবন্দর, পরে রৌমারী ইয়ুথ ক্যাম্প। ১৫-২০ দিন সেখানে চলে লেফট-রাইট। ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন ইসমাইল হোসেন ভাই। এর পর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য আমাকেসহ ১০৪ জনকে লরিতে করে নেওয়া হয় দার্জিলিংয়ের মূর্তিনালা মুজিব ক্যাম্পে। সেখানেই এক মাস প্রশিক্ষণ চলে। মেজর চৌহান ছিলেন ক্যাম্প ইনচার্জ। রাজপুত তিনি। ক্যাম্পে একজন বাঙালি ওস্তাদ ছিলেন- নাম প্রেমাংশু।
স্মৃতি হাতড়ে মুক্তিযোদ্ধা জগলু বলেন, প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের তিন ভাগে ভাগ করা হয়। হেম কুমারী, গীতালদহ ও শীতলকুচি। আমি শীতলকুচি গ্রুপে পড়ি। চাচাতো ভাইদের থেকে তখন আলাদা হয়ে যাই। আমরা ৭/৮ জন বানু, লুৎফর ভাই, হারিছ, শহীদুল, হায়দার, শাহজাহান প্রমুখ শীতলকুচিতে যাই।
জুলাইয়ের দিকে আমাদের পাঠানো হয় নীলফামারীর ডিমলা এলাকায়। প্রতিদিনই অপারেশন হতো। পদ্ধতি ছিল হিট অ্যান্ড রান। নির্দেশ ছিল, যুদ্ধ করতে হবে না। পাকিস্তানিদের শুধু বুঝিয়ে দাও, তোমরা মাঠে আছো।
বীর মুক্তিযোদ্ধা জগলু বলেন, এর পর ৬ ডিসেম্বর ক্লোজ করা হয়। অর্ডার হয় নিজ নিজ এলাকায় চলে যাওয়ার। ফলে আমরা মানকারচর থেকে নৌকায় রওনা হই সিরাজগঞ্জের দিকে। ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের মেছড়াঘাটে পৌঁছি। নামতেই শুনি শহরে যুদ্ধ চলছে। রৌমারিতে লিডার ছিলেন আমির হোসেন ভুলু। তিনি আগেই সিরাজগঞ্জে চলে এসেছেন। আমাদের রিসিভ করেই তিনি বললেন, আগাও। সিরাজগঞ্জ মুক্ত করতে হবে। স্থানীয় জনগণও বলে, ‘আপনারা আগান’।
আমাদের বুকে তখন সিরাজগঞ্জে স্বাধীন পতাকা ওড়ানোর তীব্র বাসনা। ফলে পরিকল্পনা ছাড়াই বাঁধের ওপর দিয়ে অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়েই এগোতে থাকি। কিন্তু একদিন পরে শুনি দুঃসংবাদ। গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছেন আমাদের আরেক গ্রুপের সাতজন। সবাই ছিল উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ১৩ ডিসেম্বর তারা ঘাটে নেমেই সিরাজগঞ্জ শহরের দিকে এগোয়। নদীর পাড়ে ছিল পাকিসেনাদের সাবক্যাম্প।
এটা তাদের জানা ছিল না। ক্যাম্প থেকে তাদের লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি করে পাকিসেনারা। ফলে সেখানেই শহীদ হন কালু ভাই, ফকির চাঁন, সামাদ, স্বপ্ন, আহসান হাবীব ইঞ্জিনিয়ারসহ সাত বীর মুক্তিযোদ্ধা। শহরের দিকে এগোতে থাকি ধীরে ধীরে। সিরাজগঞ্জ মুক্ত হয় ১৪ ডিসেম্বর।