ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

আমার সাথী মাইন বিস্ফোরণে মারা যায়

আবুল হোসেন, বেনাপোল থেকে

প্রকাশিত: ০০:১৮, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আমার সাথী মাইন বিস্ফোরণে মারা যায়

দ্বীন ইসলাম মল্লিক

বাংলাদেশ এবং বাঙালি জাতির ইতিহাসে একাত্তরের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এ দেশের মুক্তিপাগল মানুষ স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে মাথা তুলে দাঁড়ায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ আর অসীম সাহসে আমরা পাই স্বাধীনতা। এমনই একজন বেনাপোলের বীর মুক্তিযোদ্ধা দ্বীন ইসলাম মল্লিক।

জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা দ্বীন ইসলাম মুক্তিযুদ্ধে ৮নং সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন।
যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা দ্বীন ইসলাম মল্লিক বলেন, ১৯৭১ সালের ৩০ জুন যুদ্ধে যোগ দেই। তখন আমার বয়স ছিল ২৯ বছর। একাত্তরের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতির জন্য ২৫ মার্চ মধ্যরাতে সর্বত্র বেতার যোগে নির্দেশনা পাঠানো হলো।

এরপর শুরু হলো যুদ্ধ। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে যশোর ছিল ৮নং সেক্টরের আওতায়। এই ৮নং সেক্টরকে আবার সাতটি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হলো। শার্শা থানায় তৈরি হলো দুটি সাব-সেক্টর। একটি বেনাপোল অপরটি শিকারপুর। বেনাপোল সাব-সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন তৌফিক ই এলাহী। পরে তার সঙ্গে যোগ দেন লে. জাহাঙ্গীর।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আলহাজ তবিবুর রহমান সরদারের পৃষ্ঠপোষকতায় শার্শা থানায় স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৭ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির সভাপতি ছিলেন প্রয়াত আলহাজ আব্দুল হক, সেক্রেটারি ছিলেন মমতাজ উদ্দিন সরদার। এছাড়া কমিটিতে ছিলেন খলিলুর রহমান, কওছার আলী মাস্টার, আবু সাইদ, হবিবুর রহমান, মহসিন আলী, ইসমাইল হোসেন প্রমুখ।

স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের সহযোগিতায় তৈরি হয় স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ২১ সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটির সভাপতি ছিলেন এরশাদ আগুলিয়া। এ বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন হাজী মশিয়ুর রহমান, যার সঙ্গে আলহাজ আলী কদর নাভারনের আবু সাইদ কমান্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আরও বলেন, মে মাসের মাঝামঝি রঘুনাথপুর গ্রামে পাঞ্জাবীরা আমাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় আমার মা, স্ত্রী-পুত্রের কোনো সন্ধান না পেয়ে বনগাঁতে যাই। বনগাঁ রোডের ব্রিজ পার হয়ে দেখা হলো বসতপুরের তাবারক খানের সঙ্গে। তিনি আমাকে চাপাবেড়িয়া ইয়ুথ ক্যাম্পে নিয়ে যান।

সেখানে গিয়ে বেনাপোলের আনিছুর রহমান, যশোরের এমপি মোশারফ বিশ্বাস, এমপি তবিবর রহমান সর্দার, বেনাপোলের আব্দুল হক, আলী কদর, স্বাদীপুরের আয়ুব মেম্বারসহ অনেকের সঙ্গে দেখা হয়। আমি তাদের বললাম, আমাকে একটি টিকিট দিন। আমি উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে একটি স্লিপ দিলেন তারা। ক্যাম্পে আমরা দুই মাস অনাহারে-অর্ধাহারে কোনো মতে খিচুড়ি খেয়ে দিন কাটাতে থাকলাম। হঠাৎ একদিন টালীখোলা ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন মুখার্জি লে. মতিয়ার রহমান ও লোহাগড়ার এমপি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন।

কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করে তারা চলে গেলেন। এরপর আরেকদিন ক্যাপ্টেন হাফিজ ও একজন ডাক্তার এসে বলল, উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য লোক ভর্তি করব। তোমরা লাইনে দাঁড়াও। লাইন থেকে যারা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী তাদের সবাইকে নিয়ে গেলেন। অবশিষ্ট যারা রইল, তাদের সবাইকে বলল, এবার এসো তোমাদের নিয়ে যাব। তৃতীয় ব্যাচে আমি বললাম, ইয়ুথ ক্যাম্পে থাকব না। আমি উচ্চতর প্রশিক্ষণে যাব। তখন আমাকে বিহার চাকুলিয়া ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হয়। আমি ছিলাম ৪নং উইংয়ে। উইং কমান্ডার ছিলেন উৎপল সিং এবং সেকশন কমান্ডার ছিলেন বাঙালি ইপিআর ল্যান্সনায়েক মুজিবর। ২৮ দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে বনগাঁ পেট্রাপোলে আবারও ফিরে আসি।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, হঠাৎ একদিন যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন হাফিজ ২০০ সেনা সদস্য নিয়ে বেনাপোল কাস্টমস কলোনিতে এলেন। একথা শুনে আমাদের বুকে সাহস জেগে উঠল। আমাদের কাছে ভারি অস্ত্র ছিল না। সেনা সদস্যদের কাছে ছিল চাইনিজ রাইফেল, এলএমজি ও টুইন্স মর্টার ও সীমিত গুলি। সেনাবাহিনীর ২০০, ১৫০ ইপিআর সদস্য, মুজাহিদ ও আনসার মিলে ৪৫০ জন সৈনিক ছিল। এরপর যশোর থেকে খবর এলো, আমাদের কাছে গুলি নাই।

আমি তখন বিএসএফের ক্যাম্পে পেট্রাপোলে যাই। আমার কাছে ল্যান্স নায়েক শাহাবুদ্দিন একটি চিঠি দিয়ে বিএসএফ ক্যাপ্টেন কেপি সেনের কাছে পাঠালেন। তারপর আমি বিএসএফ ক্যাম্পে গিয়ে চিঠি দেখাই ও মুখে বিষয়টি বলি। বিএসএফ ক্যাপ্টেন ১২ বাক্স গুলি দিলেন। কিন্তু ওই গুলি আমাদের হাতিয়ারে খাটল না। তারপরে আমরা যশোর থেকে ফিরে আসি। পরে আবার কলকাতা ইছাপুর গান ফ্যাক্টরি থেকে গুলি তৈরি করিয়ে এনেছিলাম।
তিনি বলেন, ১৪ এপ্রিল কাগজপুকুর, কাগমারী ও গয়ড়ার রাস্তার দুই পাশে আমাদের ডিফেন্স বসিয়ে দেয়। পরে শুনতে পেলাম, পাকবাহিনী নাভারন পুরানো বাজারে এক গোডাউন দখল করে নিয়েছে। দেশ থেকে বহু মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে পেট্রাপোলে চলে এসেছে। ২১ এপ্রিল ক্যাপ্টেন হাফিজ ২০ জন সৈনিক নিয়ে পাঞ্জাবীদের দখল করা গোডাউনে আক্রমণ করতে যান। এই আক্রমণে বেশকিছু পাকি সেনা হতাহত হয়। ২৪ এপ্রিল ভোরে পাঞ্জাবীরা লাওতারা হয়ে গয়ড়া, কাগমারী ও কাগজপুকুর আক্রমণ করে।

এই হামলায় সুবেদার মুজিবুল হক, হাবিলদার আতিকুর রহমান, নায়েক পিয়ার আলী, নায়েক আব্বাস আলী, নায়েক লিয়াকত আলী, সিপাহী নুরুল ইসলাম মুজাহিদ ও জাকারিয়া শহীদ হন। এমতাবস্তায় আমরা পিছিয়ে বড়আঁচড়া কাস্টম কলোনি নামাজগ্রাম, স্বাদীপুর পজিশনে থাকি এবং বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে রাখি। এরপর গেরিলা যুদ্ধ শুরু হলো।
তিনি বলেন, ২৪ অক্টোবর আমরা গোরপাড়া, নিজামপুর ও সোনানদীয়া সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করতে থাকি। ওইদিন নিজামপুর ও গোরপাড়ায় তিনজন শহীদ হন। এরপর ৫ ডিসেম্বর পাঞ্জাবীরা রঘুনাথপুর ও বেনাপোল হতে চলে যায়। তখন আমরা কেউ বেনাপোল, কেউ নাভারনের দিকে ছুটতে থাকি। আমার সাথী পাঞ্জাবীদের পুতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে শহীদ হন এবং আমিন উদ্দিন আহত হন।

×