ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বরিশাল-৫

আওয়ামী লীগ চায় ধরে রাখতে বিএনপি পুনরুদ্ধার

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল

প্রকাশিত: ০০:০৩, ৩১ জানুয়ারি ২০২৩

আওয়ামী লীগ চায় ধরে রাখতে বিএনপি পুনরুদ্ধার

কীর্তনখোলা নদীর তীরবর্তী বিভাগীয় শহর বরিশাল

কীর্তনখোলা নদীর তীরবর্তী বিভাগীয় শহর বরিশাল মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ড এবং সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত বরিশাল-৫ (সদর) আসনকে বলা হয় দক্ষিণাঞ্চলের রাজনীতির সদর দপ্তর। এ আসনটি সব রাজনৈতিক দলের প্রথম টার্গেট হলেও অতীতে বেশিরভাগ নির্বাচনে এই আসন থেকে জয়লাভ করে বিএনপি। তবে ব্যাপক উন্নয়নের পথ ধরে আসনটি পুনরুদ্ধারের পর আওয়ামী লীগ নির্বাচনী আসনটিতে শক্ত ভিত গড়ে তুলেছে। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ চায় আসনটি ধরে রাখতে, আর হারানো সা¤্রাজ্য ফিরে পেতে চায় বিএনপি। 
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বরিশাল-৫ আসনটি ধরে রাখতে ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী অসংখ্য নেতা দলের হাইকমান্ড থেকে শুরু করে তৃণমূলে মাঠ গোছাচ্ছেন। তবে নেপথ্যে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধকে কাজে লাগিয়ে একসময়ের বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত এ আসনটি পুনরুদ্ধারে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিএনপি। পাশাপাশি বসে নেই অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতারা। তারা বড় দুটি দলের চরম অভ্যন্তরীণ বিরোধকে পুঁজি করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গোপনে রাজনৈতিক মাঠ গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
বিএনপির দলীয় কোন্দলের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত শওকত হোসেন হিরন জয়লাভ করেছিলেন। সর্বশেষ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। মূলত তরুণ প্রার্থী হিসেবে সিটি করপোরেশনের তরুণ ও যুব ভোটারদের মন জয় করে নেওয়ার কারণেই তিনি (সাদিক আব্দুল্লাহ) বিপুল ভোটের ব্যবধানে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।

আর তিনি (সাদিক) তার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়েই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৫ সদর আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে বিজয়ী হতে সহায়তা করেছেন। 
ফলশ্রুতিতে এই আসন থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েই কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম বর্তমান সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। যা প্রায় তিন দশক পর বরিশাল সদর থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে কেউ ঠাঁই পেয়েছেন মন্ত্রিসভায়।

জাহিদ ফারুক শামীম বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর থেকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সদর আসন থেকে নির্বাচিত কোনো এমপি মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি।
এ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে আলোচিতরা হচ্ছেন বর্তমান সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম, সাবেক সংসদ সদস্য জেবুন্নেসা আফরোজ, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক এবং আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, বঙ্গবন্ধু পরিষদের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন আহম্মেদ বীর বিক্রম, রেলওয়ে শ্রমিক লীগের উপদেষ্টা, স্বেচ্ছাসেবী এস. আর সমাজ কল্যাণ সংস্থার চেয়ারম্যান ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সালাহউদ্দিন রিপন, আওয়ামী লীগ নেতা শিল্পপতি আরিফিন মোল্লা প্রমুখ। নিজ নিজ অবস্থান থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীরা কেন্দ্রে লবিংসহ নির্বাচনী মাঠ গোছাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
অপরদিকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় রয়েছেন এ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক হুইপ অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার, বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য বিলকিস জাহান শিরিন এবং বরিশাল দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আলহাজ এবায়েদুল হক চাঁন।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচন ছাড়া নব্বইয়ের পটপরিবর্তনের পর প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছে বিএনপির প্রার্থীরা। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৫ আসন থেকে বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রথমে স্পিকার ও পরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন আব্দুর রহমান বিশ্বাস। আব্দুর রহমান বিশ্বাস রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তাঁর ছেড়ে দেওয়া আসনে উপ-নির্বাচনে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও মহানগর বিএনপির তৎকালীন সভাপতি অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার।
এরপর ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আব্দুর রহমান বিশ্বাসের ছেলে এহতেশামুল হক নাসিম বিশ্বাস বিএনপির মনোনয়নে এমপি হন। ১৯৯৮ সালে নাসিম বিশ্বাসের আকস্মিক মৃত্যুর পর উপ-নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হন মজিবর রহমান সরোয়ার। ২০০১ সালের অষ্টম এবং ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চতুর্থবারের মতো এমপি হন বিএনপির মজিবর রহমান সরোয়ার। 
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, তৎকালীন সময়ের সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক শওকত হোসেন হিরনের কারিশমার কারণেই ভোটের ব্যবধান কমাতে পেরেছিল আওয়ামী লীগ। সবশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শওকত হোসেন হিরন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন। পরে তার (হিরন) আকস্মিক মৃত্যুর পর ওই বছরের ১৫ জুনের উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বরিশাল-৫ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন হিরনের স্ত্রী জেবুন্নেসা আফরোজ।

সবশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম। তিনি পেয়েছেন ২ লাখ ১৫ হাজার ৮০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি মনোনীত ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার পেয়েছিলেন ৩১ হাজার ৩৬২ ভোট।
এ ছাড়া বর্তমানে সব নির্বাচনে তরুণ নেতৃত্বের জয়-জয়কার হওয়ার প্রভাব পড়বে জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও। সেই অবস্থান থেকে বরিশাল-৫ আসনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে আলোচনার বেশ অগ্রভাগে রয়েছেন অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দার, সালাহউদ্দিন রিপন ও আরিফিন মোল্লা। আলোচিত সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে গোটা বরিশালজুড়ে অগ্রণী ভূমিকা পালনের মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করা, সমাজের অবহেলিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, একজন সফল শিক্ষানুরাগী ও রাজনৈতিক দক্ষতায় অ্যাডভোকেট বলরাম পোদ্দারের বরিশাল সদর আসনে রয়েছে বিশাল একটি ভোট ব্যাংক।

দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের ভোটারের কাছেও তাঁর (বলরাম পোদ্দার) ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।
নারী জাগরণের অগ্রদূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুপ্রেরণায় সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সালাহউদ্দিন রিপন দরিদ্র নারীদের ভাগ্য উন্নয়নে গত একযুগ ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। 
অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী আওয়ামী লীগ নেতা ও শিল্পপতি আরিফিন মোল্লা সদর আসনের দলীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। 
বিএনপি দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার এগিয়ে থাকলেও সবশেষ সিটি নির্বাচনে তিনি মেয়র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে বেশ সমালোচনার মুখে পড়েছেন। গোপন চুক্তির বিনিময়ে মাঠ ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এ অভিযোগের কারণেই তাঁকে (সরোয়ার) সম্প্রতি সময়ে মহানগর বিএনপির সভাপতির পদ হারাতে হয়েছে।
এ ব্যাপারে মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, বরিশাল বিএনপির ঘাঁটি। সিটি নির্বাচনে চুরি নয়; ডাকাতি করে আমাদের বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব দলের প্রার্থীর একযোগে নির্বাচন বর্জন। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে দল যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটাই মাথা পেতে নেব।
বিএনপির অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য বিলকিস জাহান শিরিন বলেন, আমরা এখনো বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারসহ নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছি। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। দীর্ঘদিন রাজনীতিতে থেকে মানুষের কল্যাণে কাজ করছি। দলের আনুগত্য থেকে নিবেদিত হয়ে দুঃসময়ে পাশে ছিলাম এবং আছি। 
এবায়েদুল হক চাঁন বলেন, জনগণের জন্য রাজনীতি করি। জনগণের জন্য কাজ করার সুযোগ তৈরি করতেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দলের কাছে মনোনয়ন চাইব। বাকি সিদ্ধান্ত দেবে দল। এ ছাড়াও বরিশাল-৫ আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত প্রার্থী হতে পারেন চরমোনাই পীরের ভাই মুফতী সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করীম। পাশাপাশি জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতা ইকবাল হোসেন তাপস ও মহসিন উল ইসলাম হাবুল। মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন জেলা বাসদের সভাপতি প্রকৌশলী ইমরান হাবিব রুম্মন।
সূত্রমতে, বরিশাল-৫ (সদর) আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৯৭ হাজার ২৩০ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৩৭৯ এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৯৬ হাজার ৮৫১ জন। এ আসনে ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১৭৪টি। তবে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ চলমান থাকায় ভোটার সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

×