ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৪ মার্চ ২০২৩, ৯ চৈত্র ১৪২৯

monarchmart
monarchmart

প্রকৃতির সান্নিধ্যে বনভোজন

সুসং দুর্গাপুর

 সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা

প্রকাশিত: ০১:৫৬, ২৭ জানুয়ারি ২০২৩

সুসং দুর্গাপুর

এবারও জমে উঠেছে প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের জনপদ

ভরা শীত মৌসুম চলছে। তাই বরাবরের মতো এবারও জমে উঠেছে প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের জনপদ খ্যাত সুসং দুর্গাপুরের পর্যটন স্পটগুলো। পিকনিকের টানে প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন হাজারও পর্যটক। 
সুসং দুর্গাপুর কতদূর? নেত্রকোনা সদর থেকে ৩৩ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এক পাহাড়ি জনপদ সুসং দুর্গাপুর। সরকারি কাগজপত্রে উপজেলার নাম ‘দুর্গাপুর’ হলেও ঐতিহাসিক কারণে এটি ‘সুসং দুর্গাপুর’ নামেই বেশি পরিচিত। দুর্গাপুরের ঠিক উত্তরপাশে ভারতের মেঘালয়। পশ্চিমে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া। আর পূর্বে নেত্রকোনার কলমাকান্দা। ধোবাউড়া এবং কলমাকান্দাও সীমান্তবর্তী এলাকা।

ওই দুটি উপজেলাও পাহাড়ি জনপদের অন্তর্গত। নেত্রকোনা সদর থেকে দুদিক দিয়ে যাওয়া যায় দুর্গাপুরে। একটি রাস্তা হচ্ছে, জেলা শহরের রাজুরবাজার থেকে দুর্গাপুর পর্যন্ত। ওই রাস্তার মাঝখানে ডেওটুকুন ঘাটে পাড়ি দিতে হয় কংস নদী। নদীতে সেতু না থাকায় রাস্তাটিতে সিএনজি, অটোরিক্সা বা মোটরসাইকেল ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলে না। আরেকটি বিকল্প রাস্তা হচ্ছে, নেত্রকোনা-পূর্বধলা সড়ক। ওই সড়কে পূর্বধলা উপজেলার চৌরাস্তা হয়ে যেতে হয় দুর্গাপুরে। এ রাস্তায় সব ধরনের যানবাহন চলে। 
যা আছে সুসং দুর্গাপুরে ॥ মেঘালয় রাজ্যের কোল ঘেঁষে অবস্থিত এ জনপেেদর উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিকে রয়েছে কুল্লাগড়া এবং দুর্গাপুর সদর ইউনিয়নের কয়েকটি ছায়া ঢাকা-পাখি ডাকা গ্রাম। আর এসব গ্রামের বেশিরভাগ বাসিন্দাই ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর আওতাভুক্ত। মূলত এ গ্রামগুলোকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বিশাল এক পর্যটনপল্লি, যদিও সরকারিভাবে পর্যটন শিল্পের বিকাশে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি আজো। এসব গ্রামের পাশ ঘেঁষে রয়েছে ঘন সবুজ অরণ্যবেষ্টিত গারোপাহাড়, যা দূর থেকে দেখলে মনে হয় এক খ- ঘনকালো মেঘ যেন সেই কবে থেকে আকাশ-মাটির সঙ্গে মিতালী করে আছে। তবে এসব পাহাড়ের বেশিরভাগই ভারতের সীমানায় অবস্থিত। 
এদিকে কুল্লাগড়া ইউনিয়নের বিজয়পুর এবং সদর ইউনিয়নের গোপালপুর এলাকায় অবস্থিত টিলাগুলোর পরতে পরতে রয়েছে চিনামাটির খনি। গহিন স্তর থেকে এসব চিনামাটি সংগ্রহ করা হয়। এরপর তা দিয়ে তৈরি করা হয় সিরামিকের বাসন ও আসবাবপত্র। আদালতের নির্দেশে বর্তমানে চিনামাটি আহরণের কাজ বন্ধ থাকলেও আগে খনন করা পাহাড়ি টিলাগুলো সেখানকার সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। টিলার পরতে পরতে গড়ে উঠেছে বেশকিছু লেক। এসব লেকের একেকটাতে দেখা মেলে একেক রঙের পানি। তবে স্বচ্ছ নীল পানির লেকগুলো পর্যটকদের বেশি আকর্ষণ করে।

সুসং দুর্গাপুরের আরেক আকর্ষণ হচ্ছে সোমেশ^রী ও আত্রাইখালি নদী। গারোপাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার মতো এ দুই নদীও সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। বর্ষা মৌসুমে নদীগুলো পাহাড় থেকে বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক কয়লা, নুড়ি পাথর ও সিলিকা বালি বয়ে আনে। এ কারণে নদীগুলোর বুকে মাইলের পর মাইল চর জমে। নির্মাণশিল্পের কাঁচামাল হিসেবে এখান থেকে প্রতিদিন নানা উপায়ে হাজার হাজার মেট্রিক টন সিলিকাবালি সংগ্রহ করা হয়। মরুভূমির মতো জেগে ওঠা সিলিকাবালির চরগুলোকে দেখলে মনে হয় একেকটি সমুদ্র সৈকত। তাই শীত মৌসুমে মিষ্টি রোদের নিচে সৈকতসদৃশ চরগুলোতে হাঁটতে গিয়ে অন্য এক ভুবনে হারিয়ে যান পর্যটকরা।  
এদিকে দুর্গাপুরের বৈচিত্র্যময় জনবসতি এবং তাদের বিচিত্র জীবনধারাও ভ্রমণপিপাসুদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। বাঙালি ছাড়াও সেখানে বসবাসরত গারো, হাজং, কোচ প্রভৃতি ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর কেউ পাহাড় বা টিলার ওপর, আবার কেউ পাহাড়-টিলা সংলগ্ন সমতলে বংশ পরম্পরায় বসবাস করছেন। যুগ যুগ ধরে বিরূপ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকা এই মানুষগুলোর রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি, যা পর্যটক মনকে কৌতূহলোদ্দীপ্ত করে। দুর্গাপুরের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে পা রাখলেই চোখে পড়ে ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ছুটে চলা আদিবাসী নারীদের কর্মচাঞ্চল্য।

তারা কেউ পাহাড়ে কাঠ কুড়াচ্ছেন। আবার কেউ কাদামাটিতে দাঁড়িয়ে ধানের চারা রোপণ করছেন। অথবা কেউ পাহাড়ি ছড়ায় (ঝরনার মতো ছোট্ট জলধারা) গর্ত করে বালির নিচ থেকে সংগ্রহ করছেন খাবার পানি। কখনো দেখা যায়, হাজং নারীরা ছড়া থেকে মাছ শিকার করছেন জাখা দিয়ে। 
এদিকে দুর্গাপুরে বিভিন্ন জায়গায় অবস্থিত ক্ষুদ্র ও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর কিছু প্রতিষ্ঠানও দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। এর মধ্যে রানীখং গ্রামের টিলায় ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত সাধু জোসেফের ধর্মপল্লি উল্লেখযোগ্য। ‘রানীখং মিশন’ নামে খ্যাত এ ধর্মপল্লিটি স্থানীয় ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী গারোদের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রার্থনালয়। সেখানে রয়েছে বেশকিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা, গীর্জা, ভাস্কর্য ও বাগান।

এ ছাড়াও বিরিশিরিসহ আরও কয়েকটি স্থানে আরও কিছু গীর্জা এবং ধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে। দুর্গাপুরের প্রবেশমুখ বিরিশিরিতে রয়েছে ‘ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি’। এটিও একটি পর্যটন স্পট। গারো, হাজং, হদি, কোচসহ অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা, সংরক্ষণ ও চর্চার লক্ষ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ১৯৭৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। একাডেমির অভ্যন্তরে রয়েছে: প্রশিক্ষণ কক্ষ, লাইব্রেরি, সংগ্রহশালা ও প্রদর্শনীকেন্দ্র, অডিটোরিয়াম, সুদৃশ্য বাগান এবং রেস্ট হাউজ। আদিবাসীরা ব্যবহার করেন এমন অনেক জিনিসের দেখা মেলে সংগ্রহশালাটিতে। 
ঐতিহাসিক নানা কারণেও দুর্গাপুরের রয়েছে আলাদা পরিচিতি। দুর্গাপুর সদরের বাগিচাপাড়ায় রয়েছে ‘টঙ্ক শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ কমরেড মণিসিংহের বাড়ি ও ‘মণি সিংহ জাদুঘর’। কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে গারোপাহাড় অঞ্চলে সংঘটিত টঙ্ক ও তেভাগা আন্দোলনের নানা ঘটনাপ্রবাহের ছবি, ছবি সংবলিত ইতিহাসের বিবরণ, বইপত্র এবং আন্দোলনকারীদের ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো হয়েছে সদ্য প্রতিষ্ঠিত এ জাদুঘরটি। এ ছাড়া পৌর এলাকার সাধুপাড়ায় রয়েছে সুসং মহারাজার সুদৃশ্য বাড়ি। দোর্দ- প্রতাপশালী সুসং রাজাদের নির্মিত ঘর, কাছারি, পুকুর ও মন্দিরসহ অনেক স্মৃতিচিহ্নের দেখা মেলে ওই রাজবাড়িটিতে গেলে। এদিকে কুল্লাগড়া ইউনিয়নের বহেরাতলি গ্রামে রয়েছে ঐতিহাসিক টঙ্ক আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ‘তীর-ধনুক’ আকৃতির রাশিমণি স্মৃতিসৌধ। 
এ ছাড়াও বিরিশিরি গ্রামের কমলা রানীর দিঘি, চন্ডীগড় গ্রামের মানবকল্যাণকামী অনাথালয়, কুল্লাগড়ার রামকৃষ্ণ মঠ, দুর্গাপুর সদরের দশভূজা মন্দির, বিজয়পুরের স্থলশুল্ক বন্দর, ভারতের বাঘমারা বাজার, বিরিশিরি বধ্যভূমি, গাভীনা গ্রামের জলসিঁড়ি পাঠাগারসহ আরও কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। 
এসব প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং ঐতিহাসিক নানা নিদর্শনের টানে দুর্গাপুরে প্রায় সারা বছরই দেশী-বিদেশী পর্যটকদের ভিড় থাকে। তবে শীত মৌসুমে পর্যটকের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। রীতিমতো ঢল নামে। এ সময় বিভিন্ন স্পটে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। এবারের শীতেও তাই হয়েছে। বাসে, ট্রাকে, পিকআপে করে ছুটে আসছেন হাজারো ভ্রমণপিপাসু মানুষ। 
পর্যটন-সুবিধার অভাবে বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগ: পর্যটন কেন্দ্র বা পিকনিক স্পট হিসেবে দিন দিনই বাড়ছে দুর্গাপুরের পরিচিতি। কিন্তু উপযোগী রাস্তাঘাট, ব্রিজ, হোটেল ও মোটেলসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধার অভাবে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে ভ্রমণপিপাসুদের। বিশেষ করে পর্যটন এলাকায় যাওয়ার পথে দুর্গাপুর সদরের তেরিবাজার-শিবগঞ্জ এলাকার সোমেশ^রী নদীতে পাকা সেতু না থাকায় মূল পর্যটন এলাকাটিতে চার চাকার গাড়ি নেওয়া যায় না। একটি খেয়া নৌকায় অথবা কাঠের পাটাতনের সেতু দিয়ে শুধু মানুষজন পার হতে পারেন। এ কারণে নদীর ওপারে গিয়ে চড়তে হয় ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল বা ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সায়। অনুন্নত এবং অপ্রশস্ত রাস্তায় এসব যন্ত্রযানে চলতে গিয়ে নিতে হয় দুর্ঘটনার ঝুঁকি।     সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা

monarchmart
monarchmart

শীর্ষ সংবাদ: