ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধদিনের স্মৃতি

পটিয়ায় মাদ্রাসায় অপারেশন করে ২০ রাইফেল ছিনিয়ে নেই

মোহাম্মদ আলী, রাঙ্গামাটি

প্রকাশিত: ২৩:৪১, ১৭ জানুয়ারি ২০২৩

পটিয়ায় মাদ্রাসায় অপারেশন করে ২০ রাইফেল ছিনিয়ে নেই

রুহুল আমিন

১৯৭১ সালে দেশ মাতৃকার ডাকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আপামর জনতা। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে ছিনিয়ে এনেছিলেন বিজয়। তাদেরই একজন রাঙ্গামাটির রুহুল আমিন। বর্তমানে তিনি রাঙ্গামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। দৈনিক জনকণ্ঠের কাছে গৌরবময় সেই লড়াইয়ের স্মৃতি চারণ করেন তিনি।
রুহুল আমিন বলেন, রাঙ্গামাটি সাহা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৬৫ সালে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেই।’৬৯ সালে গণআন্দোলনে যোগ দিয়ে সংগ্রাম করি। ’৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা চারুবিকাশ চাকমার নেতৃত্বে নির্বাচনে প্রচার চালাই। এরপর পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে যোগ দিয়ে সংগ্রাম শুরু করি। সারাদেশের ছাত্র সমাজের মতো আমরাও অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমরা সাড়া দেই। ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনী নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাতে যোগ দেই। 
এপ্রিল মাসে আমি আওয়ামী লীগের এসএম ইউসুফ ও প্রফেসর শামসুল ইসলামের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি তরুণ দল রামগড় হয়ে ভারতে ট্রেনিং করতে যায়। যাওয়ার পথে রামগড়ে  রাঙ্গামাটির সাংবাদিক আব্দুর রশিদ ও অধ্যাপক ফিরোজের নেতৃত্বাধীন একটি দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়।তারাও ভারতে ট্রেনিংয়ে যাচ্ছিল। ভারতের বগা পাহাড়ে ( টিঅ্যান্ডটি পাহাড়) একে বোস আমাদের ২২ দিন  ট্রেনিং দেন।  ট্রেনিং শেষে আমাদের  সঙ্গে ফটিকছড়ির   নুরুল আলম এমপি, সিএনজি  জাফর  কক্সবাজারের গোলাম রব্বানীসহ ১২ জনের একটি দল বাংলাদেশে প্রবেশ করি।  আমরা কিছুদিন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়েও  নতুনদের ট্রেনিং দিয়েছি। 
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার দলের ছয়টি বড় অপারেশন জীবনে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো চট্টগ্রামের পটিয়ার জিরি মাদ্রাসয়ায় অপারেশন। এ ছাড়া অন্য চারটি হলো পটিয়ার কিস্টখালী ব্রিজ ধ্বংস, বোয়ালখালী থানা আক্রমণ, চট্টগ্রাম বন্দরের তিন নম্বর জেটিতে গ্রেনেড হামলা রাউজান থানা আক্রমণ ওরাঙ্গুনীয়ায় জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিড ধ্বংস করা হয়। 
 ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট ওই মাদ্রসায় অবস্থানরত আলবদররা পাকিস্তানি পতকা উত্তোলন করে। আমরা অর্তকিত গিয়ে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলি। তখন সেখানে থাকা রাজাকাররা তাদের অবস্থান জোরদার করে  অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করে। ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে আমরা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে ভাদ্র মাসের ১৫ তারিখে জিরি মাদ্রাসায় অপারেশন করি। সেখান থেকে ২০টি রাইফেল ছিনিয়ে নেই। এই ঘটনার পর সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রমে রাজাকার আলবদরদের দাপট কমে যায়। 
কয়েকদিন পর  নাসিরের নেতৃত্বে  আবারও অপারেশন চালিয়ে পটিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কিস্টখালী ব্রিজ ধ্বংস করি। এর পর আমরা ধলঘাট রেল স্টেশনে এলে রেলগাড়ি থেকে আমাদের লক্ষ্য করে পাক হানাদররা গুলি বর্ষণ করে। আমরাও পাল্টা গুলি শুরু করলে রেল থেকে পাকসেনারা না নেমে চলে যায়। কিছুদিন পর আমরা বোয়ালখালী থানা আক্রমণ করি। সেখানে বেঙ্গুরা স্টেশনে আবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ও রাখি বড়ুয়া অংশ নেয়।  বোয়ালখালী থানা রাজাকার মুক্ত করার পর আমরা  রাউজান থানার প্রসিদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র  লাম্বুর হাটে যায়।

সেখানে আগে থেকে রাউজান থানার পুলিশ অবস্থান করছিল। আমাদের অবস্থান টের পেয়ে তারা আমাদের আক্রমণ করে। আমরাও প্রচ-ভাবে পাল্টা আক্রমণ করি। এতে তারা পিছু হটে যায়। পরে আমরা রাউজান থানা আক্রমণকরি। ওই সময়ে রাউজানের  গুরুত্বপূর্ণ কসাইপাড়া ব্রিজ পাহারা দিচ্ছিল রাজাকারের একটি দল। আমরা ব্রিজটি ধ্বংস করার জন্য গ্রেনেড আক্রমণ করলে চপর রাজাকার নিহত হয়। যার কারণে রাজাকারেরা ভয়ে রাউজানে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। 
সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করার পর আমরা রাঙ্গুনিয়ার ভবানি মিল এলাকায় গিয়ে কাপ্তাই থেকে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের  যাওয়া বিদ্যুৎ লাইনে গ্রেনেড চার্জ করে সারাদেশের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেই।

এরপর আমরা রাঙ্গামাটি প্রবেশ করি। আমার দলের সিদ্ধান্ত অনুসারে রাঙ্গামাটি থেকে আমি একা গোপন পথে সাধারণ লোকের বেশ ধরে  লুঙ্গি পড়ে চট্টগ্রাম শহরে যাই। সেখান থেকে চট্টগ্রামের ৩ নম্বর জেটিতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রেনেড চার্জ করি। তখন বিস্ফোরণে  জেটি পাহারারত দুই পাক  সেনা নিহত হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রাম বন্দরে তিনটি জাহাজকে  প্রবেশ করার সময় আমাদের দল এটিকে প্রতিরোধ করি।  যার ফলে এই জাহাজগুলো আর  বন্দরে প্রবেশ করতে পারেনি।
এদিকে রাঙ্গামাটির অপর একটি দল কাটাছড়ি থেকে রাঙ্গামাটি শহরে জেলা প্রশাসকের বাংলোয় আসার পর পাকসেনার হাতে ধরা পড়ে। এদের মধ্যে ছিলশুক্কুর, মতিন, রশিদইফতিকার, নুরুল ইসলাম, আবুল, মামুন। পাকসেনারা তাদেরকে র্নিমমভাবে হত্যা করে। 
১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর জেনারেল উবাং, শেখ ফজলুল হক মনি, শেখ সেলিম ও এসএম ইফসুফের নেতৃত্বে ১৮ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটি স্টেডিয়ামে আমরা জাতীয় পতাকা উত্তোলন করি।

×