আজাদ সুলায়মান ॥ দেশে ৭৩ লাখ মাদকাসক্ত। মোট জনগোষ্ঠী ১৬ কোটির অনুপাতে এ সংখ্যা কতটা ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়। এত বিপুলসংখ্যক মাদকাসক্তের বিপরীতে একটি মাত্র সরকারী প্রতিষ্ঠান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। মাদক নিয়ন্ত্রণে মূল কাজটা এই প্রতিষ্ঠানেরই। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির জনবল, সরজাঞ্জামাদি ও অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধার চিত্র শুনলে যে কোন নাগরিকেরই মনে প্রশ্ন জাগবে-এটা কি করে হয়। এই প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি মাত্র মোটরসাইকেল বরাদ্দ। দেশব্যাপী কাজ করছে ৯৭৮। গাড়ি আছে মাত্র ৩৯। এ দিয়েই কাজ করতে হচ্ছে সারাবছর সারাদেশে। এমন এক দৈন্যদশার মাঝেই আজ উদযাপিত হচ্ছে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আজ মঙ্গলবার রাজধানীর তেজগাঁয়ে প্রতিষ্ঠানটির সদর দফতরে পালিত হচ্ছে ২৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এতে রেওয়াজ অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র্রমন্ত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে থাকেন। কিন্তু এবার তিনি দেশে থাকায় তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী এ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান। তিনিই বক্তব্য দেবেন মাদকের কুফল নিয়ে।
মাদকের করাল গ্রাসে দেশের বিপুুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে থাকলেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে এখনও একটি শক্তিশালী ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়া সম্ভব হয়নি। গতানুধিক প্রতিবছরই ২রা জানুয়ারি পালন করা হয় মাদকদ্রব্য অধিদফতরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করা হলেও জনবল ও সরঞ্জামাদি যানবাহনের সঙ্কটে মাদক অধিদফতর এখন নিজেই পঙ্গু প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এটিকে এখনও একটি কমগুরুত্বের ও চরম অবহেলার প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা হচ্ছে।
গত ২৮ বছরে এই প্রতিষ্ঠানটি কি ভূমিকা পালন করেছে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয়ের একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জবাব দেন, ‘কি আর বা-ই করবে? সারাদেশ ইয়াবাতে ছেয়ে গেছে। হাত বাড়ালেই মেলছে-গাজা হেরোইন ফেনসিডিলের মতো ভয়ঙ্কর সব মাদক। এখন নাকি ইয়াবার চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর নেশার উপাদান ঢুকেছে ঢাকায়। এসব প্রতিষেধক, প্রতিরোধ, দমন নিয়ন্ত্রণের তো উপায় নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ঠুনকো জগন্নাথে পরিণত।
কেন নেই জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৭৩ লাখ মাদকাসক্ত সারাবাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এটা যদি পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে অনুপাত বের করা হয় তাহলেও মানুষ আতকে ওঠার কথা। তার মানে ৬৮ হাজার গ্রামে গড়ে ১০৭ জন করে মাদকাসক্ত রয়েছে। এর বিপরীতে নিয়ন্ত্রণের চিত্রটা কেমন ? গত ২৮ বছরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর মাদক ব্যবসায়ী ধরেছে ৩ লাখেরও বেশি। শুধু ইয়াবা জব্দ করেছে ৪ কোটির কাছাকাছি। অবশ্য এগুলো মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ছাড়াও অন্যান্য সরকারী সংস্থার সম্মিলিত অভিযানে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এত বিশাল নেটওয়ার্ক যেখানে মাকড়সার মতো সারাদেশে বিস্তার করে আছে সেখানে কি করে মাদকনিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের জন্য একটি মাত্র মোটরসাইকেল বরাদ্দ। এটা আছে শুধু চিঠি বিলির জন্য তেজগাঁয়ের সদর দফতরে। অবিশ্বাস্য হলে ও সত্যি মাদক অভিযানের জন্য নেই একটি মোটরসাইকেলও। রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি জেলায় মাদকের নামকাওয়াস্তে একটি করে অফিস থাকলেও তাতে লোকবল রয়েছে মাত্র ৯৭৮ জন। ১৭০৬ জনের অনুমোদিত অর্গানোগ্রামের বিপরীতে এই ৯৭৮ জন দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। এদের সবার জন্য রয়েছে ৩৮টি যানবাহন, পিকআপ, হলারভ্যান, ও ভাঙ্গাচোরা পুরানো মডেলের জিপ ও মাইক্রো। এই জনবল আর সরঞ্জামাদি দিয়েই কাজ করতে হচ্ছে গোটা দেশের মাদকনিয়ন্ত্রণের। এই সেট-আপ দিয়ে মাদকসেবী, মাদক ব্যবসায়ী ও পৃষ্ঠপোষকদের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু করা সম্ভব তা জানতে চাইলে মহাপরিচাক মোঃ জামাল উদ্দীন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সঙ্কট থাকলেও অতীতের তুলনায় দিন দিনই জোরদার হচ্ছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণের কাজ। অপারেশন চলছে দেশব্যাপী। ৫০ গডফাদারকে আটকের জন্য মাঠে রয়েছে টাস্কফোর্স। এরই মধ্যে ধরা পড়েছে ৭ জন। এখন সাভারের একজন দুর্ধর্ষ গডফাদারকে ধরার জন্য অভিযান চলছে।
জানা গেছে, আজকের ২৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নতুন এক গুচ্ছ সুখবর দিবেন মহাপরিচালক মোঃ জামাল উদ্দীন আহমেদ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- নতুন জনবল কাঠামো, নতুন আইন, নতুন নিয়োগ বিধি, তিনটি বিধিমালা, সবার জন্য প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সংযোজন, নতুন ভবনে প্রধান অফিস, প্রত্যেক জেলার জন্য ন্যূনতম একটি গাড়ি, ন্যাশান ওয়াইড ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক, বিভাগীয় শহরগুলোতে পঞ্চাশ শয্যার নিরাময় কেন্দ্র, চার বিভাগে চারটি কেমিক্যাল ল্যাব, নতুন ডিটেকটিং মেশিন সংগ্রহ, ৩৭টি সেবা অনলাইনে প্রদান, ডিজি থেকে সিপাহী সবার জন্য পোষাক, আটটি বিভাগীয় শহরে ডিজিটাল প্রচারণা, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের নির্মাণ শুরু, নিজস্ব গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, পঞ্চাশজন গডফাদারকে গ্রেফতার।
মাদক বিভাগ জানিয়েছে, বর্তমানে ৭৩ লাখ মাদকাসক্তের বিপরীতে সরকারীভাবে ৪টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। বেসরকারীভাবে রয়েছে ১২৮টি । আগামী ১৪ জানুয়ারি তেজগাঁয়ের ৫০ শয্যাবিশিষ্ট নিরাময় হাসপাতালকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হবে। এছাড়া ঢাকার বাইরে বিশেষ সচেতন কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা রয়েছে।
এ সম্পর্কে মাদকসেবীর মা গতকাল জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার মুখে মুখে মাদক নিয়ন্ত্রণের কথা বললেও বাস্তব চিত্র খুবই হতাশার। শুধু ঢাকা শহরেই তো ১০ লক্ষাধিক মাদকসেবী রয়েছে। এদের চিকিৎসা সেবার জন্য কি আছে ? মাদক নিয়ন্ত্রণ খুবই কঠিন ও জটিল কাজ। এর জন্য বিশেষ কর্মসূচী হাতে নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা জাতীয় দুর্যোগের চেয়েও ভয়াবহের দিকে যাচ্ছে। এটি এখন জাতীয় দুর্যোগ হিসেবেই মোকাবেলা করতে হবে। এজন্য মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরকে শক্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। এছাড়া উপায় নেই।