
ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে ট্রফি হাতে রংপুর বিভাগীয় ক্রীড়া কর্মকর্তা মাসুদ রানা (বাঁয়ে)
নদীর খর স্রোত ও শুকনো মরুভূমির গল্প সবারই জানা। তেমনি এই বর্ষা মৌসুমে আকাশের জোয়ারের সঙ্গে সঙ্গে দেশের ফুটবলে এক প্রকার জোয়ার বইছে। বিদেশ থেকে উড়ে এসে দেশের মাটিতে জামাল-তারেক কাজীদের পরে হামজা চৌধুরী, সোমিত সোম, ফাহমিদুলরা যখন দেশের মাঠিতে পা রেখেছে সেই থেকে ফুটবল ভক্তদের মাঝে আনন্দের বন্যা বইছে।
গত ১৯ জুন বৃহস্পতিবার অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় গোল্ডকাপ ফুটবলের বালক বিভাগে রংপুর বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। চোখ ধাঁধানো সাফল্যে দেশ জুড়ে আলোচনা ও প্রশংসায় ভাসছে দলটি। ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ফাইনাল খেলায় নির্ধারিত সময়ে ২-২ গোলে শেষ হলে ফলাফল নির্ধারণ হয় টাইব্রেকারে। রংপুর ৪ গোল করে এবং ময়মনসিংহ করে ৩ গোল। দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নেপথ্যের কারণ হিসেবে জানা যায়, রংপুর বিভাগীয় ক্রীড়া অফিসার মাসুদ রানার কাছে। তিনি তার ফেসবুকে লেখেন, নতুন অভিজ্ঞতা।
আমাদের দল (রংপুর) বিভাগ যখন এক গোলে পিছিয়ে। তখন কোচ শামীম খান মিসকিনের কাছ থেকে জায়গাটা চেয়ে নেন। তখনো খেলার ৫ মিনিট বাকি রয়েছে। স্টাইকার পরিবর্তন করে নেন। ঠিক তিন মিনিটে গোল পরিশোধ করে তার দল। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় গোলকিপার মোহাম্মদ হাসানকে নামানো হয় টাইব্রেকার মোকাবিলা করার জন্য। পর পর দুই গোল ঠেকিয়ে রংপুর বিভাগকে চ্যাম্পিয়ন করে বনে যান গোলকিপার হাসান।
ক্রীড়া অফিসার মাসুদ রানা লেখেন, ঠিক এই মুহূর্তে তার খেলোয়াড়ী জীবনের সেরা কোচ মারুফুল হকের কথা বারবার মনে পড়ছে। তিনি বলেন, মারুফ স্যার টিমি মিটিংয়ে একটি কথা বলতেন, শেষ বাঁশি বাজার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত খেলা ছেড়ে দিওনা। মাসুদ রানা দেশের পেশাদার ফুটবলে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছে। এর পরে ক্রীড়া অফিসার হিসেবে সর্বপ্রথম সিরাজগঞ্জ ও বগুড়া জেলায় কাজে যুক্ত হন। ফেনী সকার, উত্তরবাড়ীধারা ও বয়েস ক্লাব থেকে ঢাকার মাঠে যাত্রা শুরু হয় তার।
তিনি ২০১৫ সালে শেখ রাসেল ক্লাবের হয়ে পেশাদার ফুটবলের ইতি টানেন। তিনি এএফসি কাপ, কিংস কাপ, প্রেসিডেন্ট কাপও খেলেন। আরামবাগ ক্লাবের অধিনায়কের দায়িত্বও পালন করেন মাসুদ রানা। তিনি বগুড়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও ¯œাতকোত্তর শেষ করেন।
জনকণ্ঠকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ক্রীড়া অফিসার হিসেবে চাকরিতে যুক্ত হয়েছি শুধু দেশের ফুটবলসহ অন্যান্য খেলাধুলায় দেশকে এগিয়ে নিতে। আমার ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অনেকদূর এগোতে চাই। তিনি বলেন, আমি সিরাজগঞ্জে দায়িত্ব পালন করে রাজশাহী বিভাগের নারী ও পুরুষ ফুটবলারদের সমান গতিতে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রেখেছি। এর পর কিছুদিনের জন্য হলেও কিশোরগঞ্জ জেলার হয়ে জেলা দলকে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন করিয়েছি।
এখন রংপুর বিভাগকে চ্যাম্পিয়ন করে যাত্রা শুরু করলাম। তিনি আরও বলেন, দেশের ফুটবলকে এগিয়ে নিতে বয়সভিত্তিক দলের খেলোয়াড় বাছাই করার ক্ষেত্রে বয়স চুরির বিষয়ে আরও তদারকি করা উচিত। এছাড়া পড়াশোনার পাশাপাশি খেলোয়াড়দের যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার।
অনূর্ধ্ব-১৭ জাতীয় ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নেপথ্যে গোলকিপার হাসান। তিনি টাইব্রেকারে দুটি শট সেভ করেছেন। এই এরপর নিজেই আসেন উইনিং শট নেওয়ার জন্য। পেনাল্টি শূট আউটে অবশ্য তার ডান শট বাইরে যায়। এরপর তার অপর সতীর্থ উইনিং গোল করে, ম্যাচ শেষে হাসান দিলেন চমকপ্রদ এক তথ্য। ‘এই পর্যন্ত টাইব্রেকারে আমার দল কখনই হারেনি।’ তা গ্রামের ক্ষ্যাপ টুর্নামেন্ট থেকে শুরু করে জাতীয় আসর পর্যন্ত। এবারের জাতীয় ফুটবলেও তিনি দুটি করে টাইব্রেকার রুখে দিয়েছিলেন, সেমিফাইনাল ও কোয়ার্টার ফাইনালে।
বালিকা বিভাগের ফাইনালে ময়মনসিংহকে ৩-০ গোলে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে রাজশাহী বিভাগ। গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জের ছেলে হাসান মিয়া। বিসিএল অনূর্ধ্ব-১৬ লিগে তিনি খেলেছেন নোফেল স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। টাইব্রেকার তিনি খুলনার ও রাজশাহীর বিপক্ষে আগের দুই নক আউটের ম্যাচে দুটি করে সেভ করেন। এই টাইব্রেকার ঠেকানোর কৌশল হিসেবে জানান, ‘প্রতিপক্ষের ফুটবলার শট নেওয়ার সময় আমি একটি সাইড বেছে নেই। সেদিকে ডাইভ দিলে যদি বলও সেদিকে আসে তা হলে সেভ। এভাবেই আমি সাফল্য পাচ্ছি এই স্পটকিকে।’ জীবনে বহু ম্যাচে টাইব্রেকার ঠেকিয়েছেন। তার কৃতিত্বে জাতীয় ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন রংপুর।
কিন্তু হাসানের কাছে স্মরণীয় জেলা পর্যায়ের ম্যাচে গাইবান্ধাকে চ্যাম্পিয়ন করানোর মুহূর্তটি। জানান, আমার সেই ম্যাচই বেশি স্মরণীয়। তিন মাস আগে কুড়িগ্রামের বিপক্ষে জেলা পর্যায়ের ফাইনালে আমি দুটি টাইব্রেকার সেভ করেছিলাম। এতে আমার জেলা প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করে। এই স্পটকিক স্পেশালিস্ট হওয়ার মিশনে হাসানের প্রিয় আর্জেন্টিনার এমিলিয়ানোর মার্টিনেজ। জানান, ‘মার্টিনেজ আমার আদর্শ কিপার। টাইব্রেকার হলে সে শট ঠেকাবেই।
এতে আর্জেন্টিনা যেমন জিতে তেমনি আমার দলও জিতে। তাই সে আমার প্রিয়। আর আমি যে ম্যাচে খেলি সেই সেই ম্যাচেও টাইব্রেকারে গড়ালে দল হারে না।’ এসএসসি পরীক্ষা দেওয়া হাসানের লক্ষ্য বাংলাদেশ দলে খেলা। উচ্চতায় একটু খাটো হাসান। তবে এই শারীরিক গঠন নিয়েই গোলরক্ষক পজিশনের চ্যালেঞ্জে জিততে চান। জাতীয় স্টেডিয়ামে গতকালই তার প্রথম ম্যাচ। এর আগে বিসিএল অনূর্ধ্ব-১৬ লিগ এবং তৃতীয় বিভাগে উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাব ও পাইওনিয়ারে শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের হয়ে খেলেছেন।
প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে রংপুর বিভাগের অধিনায়ক রিয়াদ হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, অধিনায়ক হিসেবে আমি দলের পক্ষে সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। দল যখন ২ গোলে পিছিয়ে তখন পরিবর্তিত খেলোয়াড় যারা ছিলো তারা ভালো খেলেছে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পেছনে আমাদের দলগত প্রচেষ্টা ও দলের বন্ডিং ভালো ছিলো কোচ তা ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছেন। খেলার শেষ মুহুর্তে আমি একটি গোল করেছি। আপনারা দেখেছেন আমার পজিশন ছিলো স্টপার ব্যাগ। সেই জায়গা থেকে উপরে উঠে সবাইকে সাপোর্ট দিয়েছি।
রাইট উইং যখন বল ক্রস করছে তখন আমি স্টাইকার পজিশনে গিয়েছিলাম হেড দিতে। কিন্তু বলটি একটু নিচু পজিশনে আসায় আমি বাইসাইকেল কিক করি। এরপরেই দেখি বল নেটে চলে গেছে। রিয়াদ জানান, এইভাবে আমাদের ম্যাচ হাতে চলে আসবে ভাবতেও পারিনি। সবই আল্লাহর ইচ্ছে। সেই সঙ্গে আমাদের ক্রীড়া অফিসার মাসুদ রানা একজন পারফেক্ট মানুষ। আমরা কখনো তাকে ম্যাচ চলাকালীন সময়ে ডাগ আউটে, কখনো কোচ হিসেবে আবার একজন দক্ষ ক্রীড়া অফিসার হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। আমি বিশ্বাস করি তার দক্ষতা ও মেধার ব্যবহারে উত্তরাঞ্চলের ক্রীড়াঙ্গন অনেকদূর এগিয়ে যাবে।