
ছবি: প্রতীকী
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষায় ইন্টার্নশিপ এখন এক অপরিহার্য অধ্যায় হয়ে উঠেছে। ডিপ্লোমা, অনার্স, প্রকৌশল, নার্সিং, পর্যটন ও বিজনেসসহ প্রায় সব শিক্ষাক্রমেই এটি বাধ্যতামূলক। ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থীদের বাস্তব কর্মপরিবেশের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং হাতে-কলমে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেয়। এটি শিক্ষার মান বৃদ্ধি করে এবং কর্মজীবনে সফলতার জন্য প্রস্তুতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
তবে বাস্তবতা হলো, যেখানে ইন্টার্নশিপ শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক, সেখানে অনেক প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি ইন্টার্ন নেওয়ার গুরুত্ব দেয় না এবং অনাগ্রহ প্রকাশ করে। শিক্ষার্থীরা যদিও তাত্ত্বিক জ্ঞানকে বাস্তবে প্রয়োগের সুযোগ পায়, যোগাযোগ দক্ষতা, সময় ব্যবস্থাপনা ও টিমওয়ার্কের মতো সফট স্কিল আয়ত্ত করে, অনেক সময় মানসম্মত ইন্টার্নশিপের অভাবে হতাশ হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে সময় ও শ্রমের অপচয় করে; কেউ কেউ ভুয়া সনদ সংগ্রহের পথ বেছে নেয়, যা ভবিষ্যতে তাদের ক্যারিয়ারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইন্টার্নশিপকে শুধু আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই দেখে। যথাযথ কারিগরি সহায়তা, কর্পোরেট সংযোগ বা কার্যকর প্লেসমেন্ট ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই নেই। কিছু পলিটেকনিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলেও, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের জব/ইন্টার্নশিপ প্লেসমেন্ট সেল যথাযথভাবে কার্যকর নয়। ফলে শিক্ষার্থীদের নিজ উদ্যোগে ঝুঁকি নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক ও মানহীন ইন্টার্নশিপ খুঁজতে হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সচেতনতা ও প্রস্তুতির অভাব লক্ষ্য করা যায়। ভালো ইন্টার্নশিপ কীভাবে বাছাই করতে হয় কিংবা এর মাধ্যমে কীভাবে দক্ষতা অর্জন সম্ভব, সে বিষয়ে অনেকের অজানা থেকে যায়।
বাংলাদেশে ইন্টার্নশিপের গুরুত্ব বাড়লেও, শক্তিশালী আইন বা বাধ্যতামূলক নীতিমালার অভাব প্রতিষ্ঠানগুলোর অনাগ্রহের প্রধান কারণ। শ্রম আইন বা বিদ্যমান নীতিমালায় ইন্টার্ন নিয়োগে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, তাই প্রতিষ্ঠানগুলো ইন্টার্নশিপকে বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে দেখে। প্রশিক্ষণ দিতে সময়, জনবল ও সম্পদের প্রয়োজন হলেও সরকারি কোনো প্রণোদনা, কর-ছাড় বা সিএসআর সুবিধা নেই। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান জানে না যে, ইন্টার্নশিপ ভবিষ্যতের দক্ষ কর্মী তৈরি এবং নতুন উদ্যম ও ধারণা আনার সুযোগ দেয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ সরকার একটি জাতীয় ইন্টার্নশিপ নীতিমালা প্রণয়ন করলেও, তা এখনও যথাযথভাবে প্রচার বা বাস্তবায়িত হয়নি। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইন্টার্ন নিয়োগে বাধ্য করা হয়নি বা আর্থিক/নীতিগত উৎসাহ দেওয়া হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়লেও, মানসম্মত ইন্টার্নশিপের সুযোগ সীমিত থেকে যাচ্ছে।
উন্নত দেশগুলো যেমন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে ইন্টার্নশিপ সরকার ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে সুসংগঠিত ও ফলপ্রসূ। সেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কর ছাড়, প্রশিক্ষণ ভাতা ও সিএসআর পয়েন্টসহ নানা প্রণোদনা দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা সম্মানজনক মজুরি পায় এবং পরিকল্পিত প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে চাকরির জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হয়। বাংলাদেশে এই কাঠামো এখনও গড়ে ওঠেনি।
বাংলাদেশে ইন্টার্নশিপ ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে একটি সমন্বিত ও বাধ্যতামূলক আইনগত উদ্যোগ নিতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানিগুলোর দায়িত্ব স্পষ্ট থাকবে। কোম্পানিগুলোকে ন্যূনতম ইন্টার্ন কোট নির্ধারণ, কর ছাড়, প্রশিক্ষণ সহায়তা ও সিএসআর সূচকে পয়েন্ট ও সরকারি স্বীকৃতি দিয়ে উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক জব/ইন্টার্নশিপ সেল গঠন করে ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সংযোগ ও প্লেসমেন্ট নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC) ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর (BTEB) এর তদারকি করবে।
সরকার শিক্ষা, শ্রম ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ‘ইন্টার্নশিপ মনিটরিং ইউনিট’ গড়ে তুলবে, যা জাতীয় ডেটাবেস রক্ষণাবেক্ষণ ও মান পর্যালোচনা করবে। শিক্ষার্থীদের সুরক্ষায় আচরণবিধি, অভিযোগ ব্যবস্থাপনা ও ন্যূনতম ভাতা নিশ্চিত করা হবে এবং ভুয়া সনদ প্রতিরোধে জাতীয় ইন্টার্নশিপ ভেরিফিকেশন সিস্টেম চালু করা হবে। মিডিয়া, ক্যাম্পাস ক্যাম্পেইন ও ক্যারিয়ার ফেয়ারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হবে।
সরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পখাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এই পরিবর্তন সম্ভব নয়। সবাই মিলে ইন্টার্নশিপ ব্যবস্থাকে কাঠামোবদ্ধ, মানসম্মত ও ফলপ্রসূ করে তুলতে হবে, যাতে বাংলাদেশ দক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক মানবসম্পদে পরিণত হতে পারে। এভাবেই শিক্ষার মান উন্নয়ন হবে এবং শিক্ষার্থীরা কর্মজীবনে সাফল্য অর্জনে সক্ষম হবে।
লেখক: এডটেক উদ্যোক্তা
এম.কে.