ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

পরিকল্পিত বনায়ন করি, সবুজ বাংলাদেশ গড়ি

ড. জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ১০:৫৫, ২৫ জুন ২০২৫

পরিকল্পিত বনায়ন করি, সবুজ বাংলাদেশ গড়ি

ছ‌বি: সংগৃহীত

প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গাছের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বৈশ্বিক উষ্ণতা, জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমিক্ষয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও খাদ্য অনিরাপত্তা মোকাবিলায় সবুজায়নের গুরুত্ব এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি। এই বাস্তবতায়, বাংলাদেশ সরকার ২৫ জুন ২০২৫ থেকে শুরু করতে যাচ্ছে জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা, যার মূল প্রতিপাদ্য—“পরিকল্পিত বনায়ন করি, সবুজ বাংলাদেশ গড়ি”—এটি সময়োপযোগী, বিজ্ঞানসম্মত এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সঙ্গতিপূর্ণ।

বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, যেখানে মাথাপিছু বনভূমির পরিমাণ এখনও ০.১২ হেক্টর মাত্র (FAO, 2023)। অথচ টেকসই পরিবেশ রক্ষায় বিশ্বস্বীকৃত মান অনুযায়ী প্রয়োজন অন্তত ০.৫ হেক্টর বনভূমি মাথাপিছু। ১৯৮০ সালের পর থেকে দেশে বনভূমির পরিমাণ কিছুটা বাড়লেও, অপরিকল্পিত নগরায়ন, অবৈধ দখল, পাহাড় কাটাসহ নানা কারণে এখনও দেশের মোট ভূখণ্ডের ১৭–১৮% মাত্র বন আচ্ছাদিত। বনায়নের বর্তমান গড় প্রবৃদ্ধি বছরে ১.২%, যা পরিবেশগত বিপর্যয় রোধে যথেষ্ট নয়।

এই পরিস্থিতিতে পরিকল্পিত বনায়ন শুধু একটি বন বিভাগের কার্যক্রম নয়, বরং এটি একটি জাতীয় নাগরিক আন্দোলন হওয়া উচিত। কারণ বনায়ন শুধু প্রকৃতিকে রক্ষা করে না, এটি জলবায়ু সহনশীল কৃষি, নদী ও খালপাড় সংরক্ষণ, শহরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং বায়ু বিশুদ্ধিকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণা বলছে, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ বছরে প্রায় ২২ কেজি কার্বনডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে এবং দিনে ২৫০ লিটার পর্যন্ত জলীয়বাষ্প নির্গত করে, যা পরিবেশের আর্দ্রতা রক্ষায় সহায়ক।

তবে শুধু গাছ লাগালেই হবে না, প্রয়োজন পরিকল্পিত, স্থান-ভিত্তিক, বৈচিত্র্যময় ও জনসম্পৃক্ত বনায়ন। শহরে শেড-ভিত্তিক গাছ, গ্রামে ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষ, পাহাড়ে ভূমিধস প্রতিরোধকারী প্রজাতি এবং নদীভাঙনপ্রবণ এলাকায় বাঁধ সংরক্ষণকারী গাছ রোপণ করতে হবে। বিশেষ করে ইকো-সেন্সিটিভ জোন (ESZ) ও জলাবদ্ধ এলাকায় স্থানীয় প্রজাতির গাছ লাগানোর ওপর জোর দেওয়া উচিত, যাতে জীববৈচিত্র্য রক্ষা পায় এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে।

জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযানের সফলতা নির্ভর করছে এর বাস্তবায়ন কৌশলের ওপর। প্রতিবছর লাখো গাছ রোপণ করা হলেও টিকে থাকে মাত্র ৫০–৬০% (বন অধিদপ্তর, ২০২২)। এর কারণ—পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব, সেচের ব্যবস্থা না থাকা, পশু-মানুষের ক্ষতি এবং গাছের সঠিক স্থান নির্বাচনে ব্যর্থতা। তাই এ বছর মন্ত্রণালয়ের উচিত গাছ রোপণের পাশাপাশি বৃক্ষ পালন দিবস চালু করা, যাতে গাছের মৃত্যু হার হ্রাস পায়।

এই অভিযানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থানীয় সরকার, এনজিও, কৃষক ও নারী উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। স্কুল-কলেজে গাছের দায়িত্ব প্রদান, ইউনিয়ন পর্যায়ে বৃক্ষ প্রতিযোগিতা, এবং নারীদের জন্য নার্সারি প্রশিক্ষণ—এসব উদ্যোগ নিলে বনায়ন কেবল উৎসব নয়, একটি জীবনযাত্রার অংশ হয়ে উঠবে।

জাতীয়ভাবে এ উদ্যোগ টেকসই হলে তা দেশের SDG 13 (Climate Action), SDG 15 (Life on Land) ও SDG 11 (Sustainable Cities) লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হবে। একদিকে বাংলাদেশ যেমন কার্বন নিঃসরণ কমাতে পারবে, তেমনি আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল ও সবুজ অর্থায়ন প্রাপ্তির সুযোগও বাড়বে।

 “পরিকল্পিত বনায়ন করি, সবুজ বাংলাদেশ গড়ি”— এই প্রতিপাদ্যটি কেবল একটি স্লোগান নয়, এটি এক সতর্ক বার্তা এবং ভবিষ্যতের প্রতি একটি দৃষ্টিভঙ্গি। যদি আজ আমরা সুপরিকল্পিতভাবে গাছ লাগাই, তবে আগামী প্রজন্ম পাবে ছায়াময় পৃথিবী, বিশুদ্ধ বাতাস এবং জীবনের নিরাপত্তা। সুতরাং, এই কর্মসূচি শুধু সরকার নয় প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যের অংশ।

লেখক: সুন্দরবন গবেষক

এম.কে.

×