ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা কেন ব্যর্থ হলো? এজন্যই কি দ্রুত যুদ্ধবিরতি

নয়ন আসাদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, গাজীপুর

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ২৫ জুন ২০২৫; আপডেট: ০৯:৩৪, ২৫ জুন ২০২৫

ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা কেন ব্যর্থ হলো? এজন্যই কি দ্রুত যুদ্ধবিরতি

ছবি: সংগৃহীত

ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বজুড়ে অন্যতম শক্তিশালী এবং অত্যাধুনিক হিসেবে পরিচিত।  আয়রন ডোম, ডেভিড'স স্লিং এবং অ্যারো সিস্টেমের মতো বহুস্তরীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকার কারণে মনে করা হত তাদের আকাশসীমা বেশ সুরক্ষিত। কিন্তু সাম্প্রতিক ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ইসরায়েলের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা সামনে চলে এসেছে। উল্লেখযোগ্য ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র নির্ভুল আঘাত হেনেছে ইসরাইলি লক্ষ্যবস্তুসমূহে। ইসরাইলের আকাশ প্রতিরক্ষার এই ব্যর্থতার কারণগুলো কি এবং এর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার কি যোগসূত্র আছে? যদিও ইসরায়েল বলে আসছে তাদের লক্ষ্য পূরণ হয়েছে কিন্তু ইসরায়েলের আছে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে নিজেদের শক্তি সঞ্চয়ের পুরনো ইতিহাস।

ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মূলত তিনটি প্রধান স্তরে কাজ করে। আয়রন ডোম স্বল্প-পাল্লার রকেট, মর্টার ও কামানের গোলা ঠেকানোর জন্য তৈরি। এর সাফল্যের হার ৮০-৯০% বলে দাবি করা হয়। ডেভিড'স স্লিং মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, অ্যারো সিস্টেম (অ্যারো-২ এবং অ্যারো-৩) দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের জন্য তৈরি করা হয়েছে।  এই ব্যবস্থাগুলোর পাশাপাশি ইসরায়েল বিমান এবং প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্রের মতো আরও কিছু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও ব্যবহার করে। ইসরায়েল তাদের এসব ব্যবস্থা হামাসের স্বল্পপাল্লার রকেট ঠেকাতে সমর্থ হলেও ইরানের হামলা পুরোপুরি ঠেকাতে কেন ব্যর্থ হলো ইসরায়েল?
এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, ইরান একযোগে অসংখ্য ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে আক্রমণ করছিল। যে কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পক্ষেই এত বিশাল সংখ্যক লক্ষ্যবস্তুকে একই সময়ে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা অত্যন্ত কঠিন। প্রতিটি টার্গেট ধ্বংস করতে একাধিক ইন্টারসেপ্টর ব্যবহারের প্রয়োজন হয়, কিন্তু ইসরায়েলের কাছেও এসব ইন্টারসেপ্টরের মজুদ সম্ভবত খুব বেশি নয়। যার কারণে প্রথমদিকে যতটুকু তারা ঠেকাতে পারছিল শেষের দিকে তা আর পারছিল না।  
দ্বিতীয়ত, ইরানের কাছে 'ফাত্তাহ' এবং 'ফাত্তাহ-২' এর মতো হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যা শব্দের চেয়ে ১৩ গুণ বেশি গতিতে উড়তে পারে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কেবল দ্রুতই নয়, দিক পরিবর্তনও করতে পারে, যা রাডার শনাক্ত করতে পারলেও সেগুলোকে প্রতিহত করা প্রায় অসম্ভব করে তোলে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া জানানোর আগেই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।

তৃতীয়ত, ইরানের হোভেইজেহ-এর মতো ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কম উচ্চতায় এবং তুলনামূলক ধীরগতিতে উড়ে আসে। এ ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রগুলো রাডারে সহজে ধরা পড়ে না এবং বিদ্যমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে পারে। এগুলো অনেকটা চালকবিহীন বিমানের মতো কাজ করে, যা সনাক্তকরণ ও প্রতিরোধকে জটিল করে তোলে।
চতুর্থত, ইরান সম্ভবত ভুয়া লক্ষ্যবস্তু নিক্ষেপ করে ইসরায়েলের ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে বিভ্রান্ত করার কৌশল ব্যবহার করেছে। এর ফলে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভুল লক্ষ্যবস্তুর পেছনে নিজেদের মূল্যবান ক্ষেপণাস্ত্র নষ্ট করেছে। কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে, ইরানের ডেটা কারেকশন চেইন প্রতিরক্ষা সিস্টেমকে ভুল পথে পরিচালিত করেছিল, যার ফলে ইসরায়েলের নিজস্ব কিছু স্যাম (সার্ফেস টু এয়ার মিসাইল) নিজেদেরই ভূমিতে আঘাত করেছিল বলে খবর প্রকাশিত হয়।

পঞ্চমত, ইসরায়েল তাদের কাছে মজুদ ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরোধী ইন্টারসেপ্টরের সংখ্যা কত তা গোপণ রাখলেও তা অসীম নয়। ধারণা করা হয় এই ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্রের সংখ্যা বেশ সীমিত। ব্যাপক হামলায় এই মজুত দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়ার বিষয়টিও ইসরায়েলের ব্যর্থতার কারণ বলে মনে করেন অনেকে। 

এছাড়া, আয়রন ডোম বা অ্যারো সিস্টেমের মতো ব্যবস্থার রিলোড টাইম তুলনামূলকভাবে বেশি, যা দ্রুতগতির হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করতে পারে, কারণ রিলোড সময়ের তুলনায় সেগুলো  আরও দ্রুত আঘাত হানতে সক্ষম। এছাড়াও ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রসমূহের আধুনিক বৈশিষ্ট্য ইসরাইলকে নাস্তানাবুদ করতে সক্ষম হয়।
এসব নানাবিধ কারণে, কিছু বিশ্লেষকের মতে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সাফল্যের হার ৮০-৯০% থেকে কমে ১০-১৫% এ নেমে এসেছিল।

ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার পেছনে তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা একটি বড় সম্ভাব্য কারণ। তাদের আকাশ প্রতিরক্ষার অহংকার চূর্ণ হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদী সংঘাত এড়াতে যুদ্ধবিরতিতে দ্রুতই সম্মত হয়। ইরানও যদিও বেশ বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কিন্তু তারপরেও  এই যুদ্ধ তারা শুরু করেনি তাই প্রতিউত্তর না দিয়ে তাদের অন্য উপায়ও ছিল না। 

সম্ভবত নিকট ভবিষ্যতে ইসরায়েল তার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করবে। এবং ইরানও তাদের নিরাপত্তার দিকে মনোযোগ দিবে কারণ অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক দুভাবেই ইরান এবার বেশ ক্ষতির মুখে পড়েছে এবং তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ও বিমানবাহিনীর দুর্বলতা বেশ প্রকটভাবেই সামনে এসেছে। ইরান-ইসরায়েল সম্পর্ক সামনের দিনগুলোও বেশ অনিশ্চয়তায়ই কাটবে কারণ ইতিহাসে দেখা যায় ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি ততক্ষণই মানে যতক্ষণ তার প্রয়োজন।

সাব্বির

×