ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

‘লর্ড’ শান্ত এখন কিং শান্ত!

শাকিল আহমেদ মিরাজ

প্রকাশিত: ০০:৪৯, ২৫ জুন ২০২৫

‘লর্ড’ শান্ত এখন কিং শান্ত!

যেন আকাশে উড়তে চাইছেন নাজমুল হোসেন শান্ত

‘আশা করছি, পরের দু-একটা ম্যাচে রান না করলে শান্তকে নিয়ে কথা শুরু হবে না। সব সংস্করণেই আমাদের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান সে। ওর এমন ব্যাটিংয়ে আমি বিস্মিত না, এটাই ওর আসল রূপ। এমন ব্যাটিং করার সামর্থ্য ওর আছে। আমরাই মাঝেমধ্যে ওকে চাপে ফেলে দিই। ক্রমাগত ট্রল বা সমালোচনা হলে খেলোয়াড়দের মনের ওপর চাপ পড়ে। এড়িয়ে যাওয়ার কথা বললেও এটা সহজ হয় না। আর এই প্রভাব ব্যাটিংয়ে সাম্প্রতিক সময়ে পড়ছিল। ওর ব্যাটিং দেখে আমার কাছের এটা মনে হয়েছে। তবে ভালো খবর হচ্ছে, ও ভালোভাবে ফিরে এসেছে।’ গল টেস্টে দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ইতিহাসে জায়গা করে নেওয়া শান্তকে নিয়ে বলছিলেন হাবিবুল বাশার সুমন।

সাবেক অধিনায়কের বক্তব্যে ‘ট্রল’ এবং ‘চাপ’ শব্দ দুটি বর্তমান অধিনায়কের জন্য বেশ গুরত্বপূর্ণ! লর্ড। শব্দগত অর্থ দেখলে বিশালত্বের প্রতিফলন থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটে ‘লর্ড’ শব্দটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য কিংবা চূড়ান্ত নেতিবাচক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ছোঁয়ায় দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে এই শব্দের ব্যাপক ব্যবহার। এই ‘লর্ড’ বিশেষ একজন খেলোয়াড় নন, তালিকাটা বেশ লম্বা। তবে ক্রমাগত নাজমুল হোসেন শান্তর নামের সঙ্গে ব্যবহার করে নেটিজেনরা শব্দটিকে যেন অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে! 
গল টেস্টের দুই ইনংসে দুর্দান্ত সেঞ্চুরির পর চারদিক থেকে প্রশংসা পাচ্ছেন শান্ত। প্রথম ইনিংসে দলের বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে শান্ত খেলেছেন ১৪৮ রানের ইনিংস। বাংলাদেশ অধিনায়ক দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরির পথ খুব একটা সুগম ছিল না। ৬৬ ও ৯০ রানে দুইবার জীবন পেয়েছেন তিনি। নড়বড়ে নব্বইয়ে অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া শান্ত আরও সতর্ক হয়ে এগিয়েছেন। ১৬৯ বলে তাঁর স্কোর ছিল ৯০ রান। বাকি ১০ রান করতে খেলেছেন ২১ বল। ১৯০ বলে সেঞ্চুরি করে নাম লিখিয়েছেন রেকর্ড বইয়ে। টেস্টে অধিনায়ক হিসেবে দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করা ১৬তম ক্রিকেটার শান্ত। টেস্টে বাংলাদেশের অধিনায়কদের মধ্যে প্রথম এই রেকর্ড গড়লেন তিনি।

বাংলাদেশের বেশির ভাগ ব্যাটার যেখানে ফিফটিকে সেঞ্চুরিতে রূপ দিতে পারেন না, সেখানে শান্তর চিত্রটা বিপরীত। ৬৮ ইনিংসে ৫ ফিফটির বিপরীতে করে ফেলেছেন ৭ সেঞ্চুরি। গল টেস্টের আগে সবশেষ টেস্ট সেঞ্চুরিটা শান্ত পেয়েছিলেন ২০২৩ সালের নভেম্বরে। ১৯ মাস পর গলে শান্ত যেন সেঞ্চুরির তীব্র তৃষ্ণাই মেটালেন দুই ইনিংসেই দুটি সেঞ্চুরি করে। অধিনায়ক হিসেবে শান্ত টেস্ট ক্রিকেটকে ৯৬তম জোড়া সেঞ্চুরি উপহার দিলেন। তবে ব্যাটসম্যানের সংখ্যা ৯৬ নয়, ৭৮ জন।

শান্তসহ ১৫ জন ব্যাটসম্যান একাধিকবার জোড়া সেঞ্চুরি করেছেন। তাঁদের মধ্যে তিনজনের আবার এই কীর্তি আছে তিনবার করে। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে শান্ত ছাড়া জোড়া সেঞ্চুরি আছে শুধু মুমিনুল হকের। ২০১৮ সালে চট্টগ্রামে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে জোড়া সেঞ্চুরি করেছিলেন মুমিনুল। ‘আমি জানতাম না (রেকর্ডের ব্যাপারে), তবে দলের হয়ে অবদান রাখতে পেরে ভালো লেগেছে। তিন উইকেট হারানোর পর দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছি। মুশফিক ভাই যেভাবে আমার সঙ্গে ব্যাটিং করেছে, তা দুর্দান্ত।’ বলেন শান্ত।

শ্রীলঙ্কায় যাওয়ার আগে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ ড্র করে বাংলাদেশ। তাই আত্মবিশ্বাসেও ঘাটতি ছিল, যা অস্বীকার করেননি শান্ত,‘ (জিম্বাবুয়ে সিরিজের পর) আমাদের যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ছিল না, তবে প্রস্তুতি ছিল দুর্দান্ত, এই সিরিজে অনেকবারই দৃঢ় মানসিকতা দেখিয়েছি।’ যোগ করেন তিনি। 
এই ম্যাচে দ্বিতীয় আরেকটি জোড়া সেঞ্চুরিও আছে। সেটি এসেছে জুটিতে। আর জুটির সেই জোড়া সেঞ্চুরি বাংলাদেশ প্রথম দেখেছে এবারের গল টেস্টেই। সেই প্রথমেও আছে শান্তর নাম। মুশফিকুর রহিমকে নিয়েই দুই ইনিংসেই চতুর্থ উইকেটে সেঞ্চুরি জুটি গড়েছেন। প্রথম ইনিংসে ২৬৪ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৯। আর তাতেই ইতিহাস। টেস্টে বাংলাদেশের সেঞ্চুরি জুটি আছে ১০৬টি। এক ম্যাচে সর্বোচ্চ তিনটি সেঞ্চুরি জুটিও কম দেখেনি বাংলাদেশ। এবার গল টেস্টেই তিনটি সেঞ্চুরি জুটি ছিল বাংলাদেশের।

মুশফিক-শান্তর দুটি ও প্রথম ইনিংসে মুশফিক-লিটনের। সব মিলিয়ে ছয়টি টেস্টে বাংলাদেশের তিনটি করে সেঞ্চুরি জুটি আছে। তবে মুশফিক-শান্তর মতো এক ম্যাচে আর কোনো জুটি দুবার ১০০ ছুঁতে পারেননি। টেস্টে ব্যাটসম্যানদের জোড়া সেঞ্চুরির ঘটনা ৯৬টি। তবে জুটিতে জোড়া সেঞ্চুরি এর প্রায় অর্ধেকÑ৫১টি। ১৯২৪ সালে সর্বপ্রথম যে কীর্তি গড়েছিলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা উদ্বোধনী জুটি জ্যাক হবস ও হার্বার্ট সাটক্লিফ। সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ১৫৭ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে তাঁরা ১১০ রান যোগ করেন উদ্বোধনী জুটিতে।

ইতিহাসে মাত্র দুটি জুটি দুবার জুটিতে জোড়া সেঞ্চুরি করতে পেরেছেন। প্রথম জুটিটি লেন হাটন ও সিরিল ওয়াশব্রুকের। ১৯৪৭ সালে অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি জুটি গড়ার পর ১৯৪৮ সালে হেডিংলিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই কীর্তির পুনরাবৃত্তি করেন দুজন। দ্বিতীয় জুটিটি দক্ষিণ আফ্রিকার এবি ডি ভিলিয়ার্স ও জ্যাক ক্যালিসের। ২০০৮ সালে পার্থে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ও দুই বছর পর সেন্ট কিটসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। শান্ত নিজেকে কোথায় নিয়ে যান, সেটিই দেখার।
এদিকে এই টেস্টেই উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে বিশ^ রেকর্ড গড়েছেন মুশফিকুর রহিম। দীর্ঘ দুই দশকের ক্যারিয়ারে একটি বলও (বোলিং) না করা ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৫৬১৩ রান এখন মুশফিকের। টাইগার লিটল মাস্টার ভেঙে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান গ্রেট অ্যাডাম গিলক্রিস্টের ১৫৪৬১ রানের রেকর্ড। মুশফিকের এই রেকর্ডের তৃতীয় স্থানে দক্ষিণ আফ্রিকার কুইন্টন ডি কক (১২,৬৫৪ রান), এরপরই আছেন দুই ইংলিশ উইকেটকিপার ব্যাটার যথাক্রমে জস বাটলার (১১,৮৮১ রান) ও জনি বেয়ারস্টো (১১,৫৮১ রান)। এছাড়া প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে টেস্টে ডাবল (১১ মার্চ ২০১৩, এই গলে ২০০ রান) সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখিয়েছিলেন মুশফিক। নিজেদের ২০ বছরের টেস্ট ইতিহাসে আভিজাত্যের আঙিনায় পাঁচ ডাবল সেঞ্চুরির তিনটিই তার নামের পাশে।

×