ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ জুন ২০২৫, ১১ আষাঢ় ১৪৩২

রোমানের শূন্যতা পূরণের চ্যালেঞ্জ আলিফের

জাহিদুল আলম জয়

প্রকাশিত: ০০:৪৫, ২৫ জুন ২০২৫

রোমানের শূন্যতা পূরণের চ্যালেঞ্জ আলিফের

বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্যের আশা আলিফের

জনজোয়ারের বিচারে বাংলাদেশে বর্তমানে এক নম্বর খেলা ক্রিকেট। এর পরই অবস্থান ফুটবল, হকিসহ অন্যান্য খেলার। কিন্তু প্রধান খেলাগুলো বাংলাদেশকে বলার মতো সাফল্য এনে দিতে পারেনি এখন পর্যন্ত। এর বাইরে অন্যান্য কয়েকটি খেলায় দারুণ সম্ভাবনা দেখা গেছে। এর মধ্যে শীর্ষ নাম আরচারি। তীর-ধনুকের এই খেলাটার নামও জানতেন না দেশের অনেক মানুষ। অথচ এই খেলাটাই বিগত কয়েক বছর ধারাবাহিকভাবে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষ করে বলতে হয় আরচার রোমান সানার কথা। দেশসেরা এই আরচার ধারাবাহিক চোখ ধাঁধানো সাফল্যের কারণে জাতীয় বীরে পরিণত হন। 
কিন্তু সবার নয়নের মণি হওয়া রোমান ধীরে ধীরে পাদপ্রদীপের আলো থেকে সরে যাচ্ছিলেন। কিছু দিন ধরে চোট আর অফফর্মের কারণে হতাশও ছিলেন। যে কারণে জাতীয় দল থেকেও বাদ পড়েছিলেন। এর আগে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। মাঝখানে মেয়েদের আরচারির বড় তারকা দিয়া সিদ্দিকীকে বিয়ে করেছেন। সব মিলিয়ে আরচারিতে মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন। যে প্রমাণ তিনি দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় আরচারি দল থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে।

২০২৪ সালের মার্চ মাসে রোমান অবসর গ্রহণ করেন। এরপর আরও অবাক করে উন্নত জীবনের আশায় স্ত্রী দিয়াসহ তিনি পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। রোমানের পারফরম্যান্সের অবনতি ঘটলে আশা জাগিয়েছিলেন হাকিম আহমেদ রুবেল। এরপর আশা জাগিয়েছেন বিকেএসপির দুই যুবক সাগর ইসলাম ও আবদুর রহমান আলিফ। রোমান-দিয়ার শূন্যতা পূরণের চেষ্টা তারা করে যাচ্ছেন। 
গত ২০ জুন বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা পতপত করে উড়েছে আরও একবার। আরও একবার বিনোদনের নির্মল মাধ্যম ক্রীড়াঙ্গন থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে গৌরবময় সাফল্য। দেশবাসীকে এ সাফল্য উপহার দিয়েছেন তরুণ আরচার আবদুর রহমান আলিফ। তিনি সিঙ্গাপুরে চলমান এশিয়া কাপ আরচারির রিকার্ভ পুরুষ এককে স্বর্র্ণপদক জয় করেন। ১৯ বছর বয়সী আলিফের অসাধারণ অর্জনে সিঙ্গাপুরে উড়েছে লাল-সবুজের পতাকা। বিদেশের মাটিতে বেজে উঠে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’

রিকার্ভ পুরুষ এককের ফাইনালে আলিফ ৬-৪ সেট পয়েন্টে জাপানের  মিয়াতা গাকুতোকে হারিয়ে অনন্য সাফল্যে ভাস্বর হন। হাড্ডিহাড্ডি লড়াইয়ে প্রথম দুই সেটে দারুণভাবে এগিয়ে থাকেন আলিফ। প্রথম সেটে আলিফের স্কোর ছিল ২৮, আর গাকুতোর ২৭। পরের সেটে আলিফ ২৯ করেন। আর গাকুতো ২৮ পয়েন্ট স্কোর করেন। এর পরই ঘুরে দাঁড়ান জাপানি আরচার। পরের দুই সেট আবারও জিতে খেলায় সমতা আনেন তিনি। তৃতীয় সেটে গাকুতো স্কোর করেন ২৮। আর আলিফ করেন ২৭। চতুর্থ সেটেও এগিয়ে যান গাকুতো। তিনি তীর ছুঁড়েন ২৭ পয়েন্টের জন্য। অন্যদিকে আলিফ ২৬ স্কোর করে পিছিয়ে পড়েন।
এরপর পঞ্চম সেটে গড়ায় খেলা। রুদ্ধশ্বাস শেষ শটে আলিফ স্কোর করেন ২৯ পয়েন্ট। আর গাকুতো করেন ২৬। তাতেই উল্লাসে আলিফ মেতে ওঠেন সিঙ্গাপুরের সবুজ আঙিনায়। সবার সেরা হয়ে তিনি জড়িয়ে ধরেন কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখকে। এরপর নিজের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে আলিফ লিখেন, ‘আসসালামু আলাইকুম। আল্লাহর অশেষ রহমতে, নিজের চেষ্টায়, আর কোচের সহযোগিতায় এককভাবে গোল্ড পেয়েছি। দেশের পতাকা বাইরের দেশে উড়াতে পেরেছি। দোয়া করবেন আমার জন্য যেন দেশের জন্য আরও সম্মান নিয়ে আসতে পারি ইনশাআল্লাহ।’

বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) থেকে উঠে আসা আলিফ এর আগে গত বছর ৩০ সেপ্টেম্বর এশিয়ান যুব আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে রিকার্ভ এককের ফাইনালে হেরেছিলেন চীনা তাইপের প্রতিযোগীর কাছে। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এর আগে অনেকবারই খেলেছেন আলিফ। বিশ্বকাপ, এশিয়ান আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপ, এশিয়ান আরচারি গ্রাঁ প্রিঁর মতো আসরে অংশ নিলেও কখনো কোনো পদক জিততে পারেননি একক ইভেন্টে। 
এবার অবশ্য রৌপ্যপদক নিশ্চিত করেছিলেন ফাইনালে উঠেই। অপেক্ষায় ছিলেন রং বদলে সেটা সোনায় পরিণত করা। শেষ পর্যন্ত সত্যিই সেটা পেরেছেন আলিফ। এবার আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় পুড়তে হয়নি আলিফকে। এক সময় বাংলাদেশের আরচারির পুরুষ বিভাগের রিকার্ভ এককে রাজত্ব ছিল রোমান সানার। এরপর রোমানের পারফরম্যান্সের অবনতি ঘটলে আশা জাগিয়েছিলেন হাকিম আহমেদ রুবেল। কিন্তু আরচারি ছেড়ে উন্নত জীবনের আশায় দুজনই পাড়ি জমিয়েছেন মার্কিন মুল্লুকে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রে।

এরপর এই ইভেন্টের হাল ধরেছেন বিকেএসপির দুই যুবক সাগর ইসলাম ও আলিফ। প্যারিস অলিম্পিকে নিজের যোগ্যতায় সুযোগ পাওয়া সাগর অবশ্য সিঙ্গাপুরে নামের পাশে সুবিচার করতে পারেননি। তিনি হেরে যান প্রথম রাউন্ডেই। তবে সাগর ব্যর্থ হলেও মান বাঁচিয়েছেন পাবনার বেড়া থেকে উঠে আসা আরচার আলিফ। আলিফ এশিয়া কাপে অংশগ্রহণের পূর্বে জাতীয় দলের ক্যাম্প ছাড়াও বিকেএসপিতে দক্ষিণ কোরিয়ন কোচ লি ইয়ং হো ও বিকেএসপির কোচদের অধীনে দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

দেশের এ উদীয়মান আরচার ২০১৮ সালে  বিকেএসপিতে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি হয়। বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পূর্বে আলিফ কখনো আরচারি না খেললেও বিকেএসপির কোচদের নিবিড় প্রশিক্ষণ ও দিক নির্দেশনা ও  নিজের কঠোর পরিশ্রমের ফসল আজকের এই অর্জন। 
আলিফ এবারের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। এশিয়া কাপ আরচারিতে সোনা জয়ের আনন্দের রেশ আলিফ টেনে নিতে চান আরও বড় আসরে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অলিম্পিকের এখনো অনেক সময় বাকি। আমি আগে নিজেকে তৈরি করতে চাই। সামনে অনেকগুলো প্রতিযোগিতা আছে। যদি বাংলাদেশ সেগুলোতে অংশ নেয়, আর আমিও সুযোগ পাই; তাহলে চেষ্টা করব ভালো করার। এখন এশিয়া কাপে সোনা জিতেছি। এরপর বিশ্বকাপ, ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ আছে। এরপর চিন্তা করব অলিম্পিক নিয়ে। আলিফের বাড়ি পাবনা জেলায়। পরিবার তথা তার বংশের কেউ খেলাধুলার সঙ্গে নেই।

এ কারণে তার বাবা সব সময় চাইতেন, ছেলে শিক্ষিত হোক, পড়ালেখা ভালোভাবে করুক। কিন্তু আলিফের ইচ্ছে ছিল খেলাধুলায় নিজেকে রাঙানো। সেই ইচ্ছেশক্তি আর বাবা-মায়ের আকাক্সক্ষায় আজ আলিফ এগিয়ে যাওয়ার সিঁড়ি পেয়েছে। যার শুরুটা হয় বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকেএসপিতে সুযোগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে। 
এখন নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ পেয়েছেন। পড়ালেখাতেও বেশ ভালো। এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ভালো করে নিজেকে আরেক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে আলিফের। এজন্য দেশবাসীর দোয়া ও সমর্থন চেয়েছেন সম্ভাবনায় এই তীরন্দাজ।

×