ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বিশ্ব মাতানোর অপেক্ষায় বিশ্বকাপ ফুটবল

জাহিদুল আলম জয়

প্রকাশিত: ২১:১২, ২৫ অক্টোবর ২০২২

বিশ্ব মাতানোর অপেক্ষায় বিশ্বকাপ ফুটবল

পর্দা উঠবে ২২তম বিশ্বকাপ ফুটবলের

দরজায় কড়া নাড়ছে বিশ্বকাপ ফুটবল। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের ক্ষণগণনা। বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও আকাক্সিক্ষত ক্রীড়া আসরের এবারের আয়োজক মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার। আগামী ২০ নভেম্বর জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পর্দা উঠবে ২২তম বিশ্বকাপ ফুটবলের। উত্তরাঞ্চলীয় বন্দর নগরী আল খোরের আল বায়াত স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় রাত ১০টায় উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক কাতারের মুখোমুখি হবে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডর।

এবারের আসরে আটটি গ্রুপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ৩২টি দেশ। শুধু আয়োজক কাতার বাদে বাকি ৩১টি দেশকে বাছাইপর্বের কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে বিশ্বকাপের টিকেট কাটতে হয়েছে। এবারের আসরে লিওনেল মেসির দেশ আর্জেন্টিনা ও নেইমারের ব্রাজিলকে হট ফেভারিট হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন বিশ্বব্যাপী ফুটবল বিশেষজ্ঞরা। সেই সঙ্গে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর পর্তুগাল, সার্জিও বসকুয়েটসের স্পেন ও করিম বেঞ্জামার ফ্রান্সকে রাখা হচ্ছে ফেভারিটের তালিকায়।

নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবার বিশ্বকাপ আয়োজন করছে কাতার। বিশাল এই যজ্ঞ সফল করতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি। পাশাপাশি বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফারও ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। চার বছর পর পর বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এই আসর নিয়ে সারা বিশ্ব যেমন মেতে ওঠে, তেমনি আয়োজক দেশের সামনে চ্যালেঞ্জ থাকে সবার সেরা টুর্নামেন্ট উপহার দেয়া।

তেল সমৃদ্ধ বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ কাতার বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব পাওয়ার পর থেকে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে দিয়েছিল। এখন অপেক্ষা সারা বিশ্বের সামনে নিজেদের পরিশ্রমকে সফল প্রমাণের। ইতোমধ্যেই বিশ্বকাপের জন্য প্রায় ৩ মিলিয়ন টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে।
দোহায় সংবাদ সম্মেলনে আয়োজক কাতার জানিয়েছে, আট স্টেডিয়ামে আয়োজিত ৬৪টি ম্যাচের জন্য ২.৮৯ মিলিয়ন টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। ফুটবলপাগল জাতি হিসেবে পরিচিত ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি ও স্বাগতিক কাতারের ম্যাচগুলোর টিকিটের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। আয়োজকরা আরও জানিয়েছে, বিদেশী সমর্থকদের কাতারে প্রবেশের জন্য হায়া কার্ড অনুমতি হিসেবে কার্যকরী হবে।

এই কার্ডের মাধ্যমে গণপরিবহনে বিনা টিকিটে ভ্রমণ ও স্টেডিয়ামে ম্যাচ টিকিটের পাশাপাশি প্রবেশের জন্য কার্যকর হিসেবে গণ্য হবে। জানা গেছে, বিশ্বকাপের জন্য ব্যবহৃত আটটি স্টেডিয়াম কাছাকাছি হওয়ায় দর্শকরা ইচ্ছা করলেই গ্রুপ পর্বের প্রতিটি ম্যাচ মাঠে গিয়ে দেখতে পারবেন।
কাতারের সফল আয়োজন নিয়ে ভীষণ আশাবাদী ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা। সংস্থাটির সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্টিনো বলেন, আমরা সবসময় বলেছি কাতার এ যাবতকালের সেরা বিশ্বকাপ উপহার দেবে। এই মুহূর্তে দেশটির দিকে দৃষ্টি দিলেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। স্টেডিয়ামগুলোকে ঘিরে নির্মাণযজ্ঞ, অনুশীলন মাঠ, মেট্রো, অবকাঠামো- সবমিলিয়ে সবাইকে স্বাগত জানাতে কাতার পুরোপুরি প্রস্তুত। পুরো বিশ্ব এখন মাঠের লড়াইয়ের অপেক্ষায়। কাতার প্রস্তুত, বিশ্বকাপের মঞ্চ প্রস্তুত, ফিফাও প্রস্তুত।

সবাই মিলে আমরা এখন সবাইকে সেরা বিশ্বকাপ উপহার দেওয়ার দ্বারপ্রান্তে আছি। ফিফা বিশ্বকাপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কলিন স্মিথ বলেন, বিশ্বকাপ উপলক্ষে আমরা ১৬৮টি অফিসিয়াল সাইট চালু করেছি। এর মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান করে যাচ্ছি। আটটি স্টেডিয়াম, স্বেচ্ছাসেবক, অ্যাক্রিডিটেশন সেন্টারগুলো পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। পাশাপাশি প্রধান তথ্য কেন্দ্র (মেইন মিডিয়া সেন্টার) ও আইবিসিও পর্যায়ক্রমে খুলে দেওয়া হবে। প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে কঠোর পরিশ্রমের ফল পেতে যাচ্ছে কাতার। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল স্টেক হোল্ডারদেরও অবদান আছে।
বিশ্বকাপের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আসর একদিন এগিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বকাপের পূর্ব নির্ধারিত সূচিতে পরিবর্তন এনেছে ফিফা। আগের সূচিতে বিশ্বকাপ শুরুর দিন ছিল ২১ নভেম্বর। কিন্তু ঐতিহ্য ধরে রাখতে নতুন সূচি অনুযায়ী বিশ্বকাপের পর্দা উঠবে ২০ নভেম্বর। আগের সূচি অনুযায়ী বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে ছিল না স্বাগতিক কাতার। ২০০৬ সাল থেকে চলে আসা রীতি বজায় রাখতেই একদিন এগিয়ে আনা হয়েছে বিশ্বকাপ। যে কারণে নতুন সূচিতে উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক কাতারের বিরুদ্ধে খেলবে ইকুয়েডর। তবে বিশ্বকাপের বাদবাকি সূচি অপরিবর্তিত আছে। একদিন এগিয়ে আনায় বিশ্বকাপের দৈর্ঘ্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ দিনে। ফাইনাল হবে যথারীতি ১৮ ডিসেম্বর।
এই প্রথম বিশ্বকাপের আসর হতে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে। বিশ্বকাপ সবসময় হয়ে থাকে জুন-জুলাই মাসে। কিন্তু এই সময়ে কাতারে প্রচ- গরম থাকায় আগে থেকেই শীতকালে বিশ্বকাপ আয়োজনের দাবি উঠেছিল। যে কারণে বাস্তবতা মেনে ফিফা প্রচলিত প্রথা ভেঙে শীতকালেই ২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবারের আসরে বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলো মাঠে গড়াবে বিকেল ৪টা, সন্ধ্যা ৭টা, রাত ১০টা ও রাত ১টায়। এরপর নকআউট পর্বের ম্যাচগুলো হবে রাত ৯টা ও রাত ১টায়। ৮০ হাজার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে ফাইনাল মহারণ হবে রাত ৯টায়।
এবার দীর্ঘ তিন যুগ অর্থাৎ ৩৬ বছর পর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন বুনছে কোটি কোটি সমর্থকের ভালোবাসার দল আর্জেন্টিনা। ১৯৮৬ সালে সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার কিংবদন্তি দিয়াগো ম্যারাডোনার জাদুতে সবশেষ বিশ্বকাপ জয় করেছিল আর্জেন্টিনা। এরপর আর সোনালি ট্রফি ছুঁয়ে দেখা হয়নি ফুটবলপাগল দেশটির। এবার তিন যুগ পর ফের শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরার স্বপ্নে বিভোর আর্জেন্টাইনরা। লিওনেল মেসি নামের আরেক জাদুকরের আবির্ভাবের কারণেই স্বপ্নের পরিধি বেগবান হয়েছে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই দেশের একটির। কোচ লিওনেল স্কালোনির সঙ্গে দুর্দান্ত জুটি গড়ে সবশেষ তিন বছর আর্জেন্টিনা হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য দল। অপরাজিত আছে রেকর্ড টানা ৩৫ ম্যাচ।
২০১৪ বিশ্বকাপে মেসির নৈপুণ্যের মাঝে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ১৯৮৬ বিশ্বকাপের ম্যারাডোনাকে। শেষ পর্যন্ত তীরে এসে তরী ডুবলেও এবার কাতারে সেই আক্ষেপ ঘোচানোর সুযোগ থাকছে। ৩৬ বছর আগে অনেকটা একক কৃতিত্বে দেশকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর ম্যারাডোনা। এবার মেসির পথচলাও অনেকটা অভিন্ন। স্বপ্নপূরণে অধিনায়কের চওড়া কাঁধে ভর করেই এগিয়ে যেতে চায় আর্জেন্টিনা। এ কারণে সবার মনের কোণে ঘুরপাক খাচ্ছে, তাহলে কি ১৯৮৬ ফিরে আসছে ২০২২ বিশ্বকাপে?
অন্যদিকে ছন্দময় ও শৈল্পিক ফুটবলের পূজারী বলা হয় ব্রাজিলকে। যুগে যুগে দেশটির কিংবদন্তি ফুটবলারদের নয়নজুড়ানো পারফরমেন্সে বিমোহিত হয়েছে গোটা দুনিয়া। কাতার বিশ্বকাপেও সাম্বা ছন্দ দেখাতে চায় পেলের দেশ। ২০ বছরের অপেক্ষা ঘুচিয়ে ব্রাজিল এবার ‘হেক্সা’ অর্থাৎ ষষ্ঠবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন বুনছে। এই মিশনে ব্রাজিলের প্রাণভোমরা নিঃসন্দেহে সুপারস্টার নেইমার।

তবে পিএসজি তারকা আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও সেলেসাওদের এবারের দলটাতে সব পজিশনে আছে চৌকস সব খেলোয়াড়। মরুর দেশে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার সঙ্গে হট ফেভারিট হয়ে খেলবে ব্রাজিল। বিশ্বকাপ পুনরুদ্ধারের মিশনে ‘জি’ গ্রুপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে রেকর্ড সর্বোচ্চ পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা। যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ সার্বিয়া, সুইজারল্যান্ড ও ক্যামেরুন। ২৪ নভেম্বর লুসাইলে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচ দিয়ে মসনদ ফিরে পাবার মিশন শুরু করবে ব্রাজিল।
সেলেসাওদের এবারের দলটি নেইমারের ওপর নির্ভরশীল নয়। দলটিতে সব বিভাগে আছে একাধিক তারকা ফুটবলার। গোলপোস্টে অ্যালিসন বেকার থেকে শুরু করে রক্ষণভাগে থিয়াগো সিলভা, ডানিলো, মারকুইনহোস, মাঝমাঠে ফ্যাবিনহো, কাসেমিরো, পাকুয়েটা, ফ্রেড, আক্রমণভাগে ভিনিসিয়াস জুনিয়র, রবার্তো ফিরমিনো, রিচার্লিসন, রডরিগোরা আছেন ফর্মের তুঙ্গে। ইতিহাস জানান দিচ্ছে, ব্রাজিলের শেষ চারটি বিশ্বকাপই এসেছে ইউরোপের বাইরে থেকে।

১৯৫৮ সালে তারা নিজেদের ইতিহাসে প্রথম বিশ্বকাপ জয় করে ইউরোপের দেশ সুইডেন থেকে। এরপর ১৯৬২ সালে দক্ষিণ আমেরিকার চিলি, ১৯৭০ সালে উত্তর আমেরিকার মেক্সিকো ও ১৯৯৪ সালে একই মহাদেশের যুক্তরাষ্ট্র থেকে শিরোপা জয় করে। অর্থাৎ প্রথমবার বাদে আর কোনোবারই ব্রাজিল ইউরোপ থেকে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি। পেলের দেশ সবশেষ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ২০০২ সালে এশিয়ার দেশ জাপান-কোরিয়ায়। এবার আবারও এশিয়াতে ফিরেছে বিশ্বকাপ। যে কারণে অতীত ইতিহাসের ধারা অনুযায়ী এবার ব্রাজিলের বিশ্বকাপ জয়ের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে।

×