পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। পাকিস্তানের জন্মের পর তিনি মাত্র এক বছর জীবিত ছিলেন। জানা যায় জিন্নাহ পাকিস্তানের জন্মের পূর্বেই যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন যা সে সময় ছিল একটি জটিল রোগ। জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহ এবং সরোজিনী নাইডু এই দুজনই শুধু তার রোগের কথা জানতেন। কারন জিন্নাহর এই রোগের কথা অনেকটাই গোপন রাখা হয়েছিল। জিন্নাহর মৃত্যু নিয়ে অনেক কানাঘুষা ও গুজব চালু আছে। বিশেষ করে যে অবস্থায় তিনি মারা যান তা অনেক প্রশ্নেরই জন্ম দেয়। কোন কোন বইয়ে এর উপর কিছু লেখা হলেও এ বিষয়ের উপর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় লে: কর্নেল ইলাহী বখ্শের লেখা ডরঃয ঃযব ছঁধরফ-র-অুধস : ফঁৎরহম যরং ষধংঃ ফধুং শীর্ষক বই-এ। তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল কোরের ডাক্তার। জীবনের শেষ দুই মাস তিনি জিন্নাহর চিকিৎসক ছিলেন। তিনি আল্লামা ইকবালেরও ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। ডাক্তার হিসেবে তার প্রচুর সুখ্যাতি ছিল। পাকিস্তানে চিকিৎসা শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি অত্যন্ত সম্মানের পাত্র ছিলেন। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত তার লেখা২৩৩৫ পৃষ্ঠার বিশাল আকৃতির বইটি শুধু পাকিস্তানেই নয় সারা বিশে^ই চিকিৎসা শাস্ত্রে রেফারেন্স বই হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অনেকে তাকে পাকিস্তানে চিকিৎসা শিক্ষা প্রচলনের জনকও বলে থাকেন।
পাকিস্তানের জন্মের পর প্রচুর পরিশ্রমের কারণে জিন্নাহর শরীর আরও ভেঙ্গে পড়ে। লে. কর্নেল ইলাহী বখ্শ জীবনের শেষ দুই মাসের কিছু কম সময়, পঞ্চাশ দিন জিন্নাহর চিকিৎসক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি লাহোরের কিং এ্যাডওয়ার্ড মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসের ২১ তারিখ তিনি করাচী থেকে পাকিস্তান সরকারের চীফ সেক্রেটারির কাছ থেকে একটি ফোন কল পান। তিনি ডাঃ ইলাহীকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর চিকিৎসার দায়িত্ব নেয়ার জন্য অবিলম্বে বিমানে যিয়ারত যেতে অনুরোধ করেন। জিন্নাহ তখন যিয়ারতে অবস্থান করছিলেন। চীফ সেক্রেটারি ডাঃ ইলাহী বখ্শকে তার যিয়ারত গমনের বিষয়টি গোপন রাখারও পরামর্শ দেন। পরদিন শুক্রবার দুপুর ২:৩০ মিনিটে ডাঃ এলাহী বিমানে কোয়েটায় যান। সেখান থেকে তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল আকবর খান তাঁকে তার গাড়িতে যিয়ারত নিয়ে যান। জিওসি-র সঙ্গে কর্নেলকে জিলানী নামে আর একজন সামরিক কর্মকর্তাও ছিলেন। জিওসি তাকে যিয়ারতে প্রথম তার নিজস্ব বাংলোতে নিয়ে যান। সেখানে জিন্নাহর সহকারী একান্ত সচিব ফররুখ আমীন প্রথম তাকে জানান যে জিন্নাহ কয়েকদিন ধরে গুরুতর অসুস্থ। জনাব আমীন মিস ফাতেমা জিন্নাহকে ডাঃ ইলাহী বখ্্শের আগমনের কথা জানান। ডাঃ ইলাহী জিন্নাহকে দেখার জন্য উদগ্রিব থাকলেও জিন্নাহ তাকে পরদিন সকাল ৮:০০ টায় তাকে দেখতে যেতে বলেন। জিন্নাহ বরাবরই তার নিজের অসুস্থতা ও চিকিৎসার ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। তিনি কি ধরনের অসুস্থ সে বিষয়ে ডাঃ ইলাহীকে পূর্বে কোন ধারণা দেয়া হয়নি। ফলে তিনি লাহোর থেকে কোনপ্রকার মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি নিয়ে যাননি। আর যিয়ারত এমন একটি এলাকা যেখানে কোন প্যাথলজিকাল ল্যাবরেটরিও ছিল না।
পরদিন সকালে ডাঃ ইলাহী বখ্শ তার জন্য নির্ধারিত বাংলো থেকে জিন্নাহর বাসস্থানে যান। সেখানে মিস ফাতেমা জিন্নাহ তাকে দোতলায় জিন্নাহর শয়নকক্ষে নিয়ে যান। জিন্নাহ অত্যন্ত দুর্বল শরীরে মৃদু হাসি দিয়ে তার সঙ্গে করমর্দন করেন। ডাঃ ইলাহী জিন্নাহর শরীরের অবস্থা দেখে অত্যন্ত বিচলিত হন। কিন্তু জিন্নাহ তাকে বলেন, ‘ঞযবৎব রং হড়ঃযরহম সঁপয ৎিড়হম রিঃয সব, বীপবঢ়ঃ ঃযধঃ ও যধাব মড়ঃ ংঃড়সধপয ঃৎড়ঁনষব ধহফ বীযধঁংঃরড়হ ফঁব ঃড় ড়াবৎড়িৎশ ধহফ ড়িৎৎু.’ (পৃষ্ঠা-৪ )। কথা বলতে জিন্নাহ হাপিয়ে উঠছিলেন এবং তার গলা ও ঠোঁট শুকিয়ে যাচ্ছিল। তার কণ্ঠস্বরও ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। তার উপর ছিল কিছুক্ষণ পর পর কাশি। জিন্নাহ ছিলেন বরাবর স্বল্পভাষী এবং আবেগহীন। জিন্নাহ আরও জানান যে তিন সপ্তাহ পূর্বে জ্বর হলে কোয়েটার সিভিল সার্জন তাকে পেনিসিলিন দেন যা খেয়ে জ্বর ভাল হলেও তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। জিন্নাহর ধারণা তার ফুসফুসে কোন রোগ নেই, যা আছে তা হচ্ছে হজমের সমস্যা। পাকস্থলীর চিকিৎসা করাতে পারলে তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন বলে তার বিশ^াস। ডাঃ ইলাহী জিন্নাহর জন্য প্রতিদিনের একটি খাবারের চার্ট তৈরি করে ফাতেমা জিন্নাহর কাছে দেন। এরপর তিনি কোয়েটা থেকে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ সিভিল সার্জন ও একজন প্যাথলোজিস্টকে যিয়ারতে নিয়ে আসেন। তাদের মাধ্যমে জিন্নাহর রক্ত ও কফ পরীক্ষা করে ডাঃ ইলাহীর আশংকা সত্য প্রমাণিত হয়। আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডাঃ ইলাহী লাহোর থেকে এক্সরে মেশিনসহ ডাঃ রিয়াজ আলী শাহ, ডাঃ আলম ও ডাঃ গোলাম মোহাম্মদ এই তিনজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে যিয়ারত নিয়ে আসেন।
এক্সরে রিপোর্ট দেখে ডাঃ ইলাহী চমকে উঠেন। প্রকৃতপক্ষে জিন্নাহর ফুসফুসে সংক্রমন বেশ মারাত্মক এবং তা অন্তত দুই বছর পুরনো বলে ইলাহী মত প্রকাশ করেন। মিস ফাতেমা জিন্নাহর পরামর্শ সত্ত্বেও ডাঃ ইলাহী জিন্নাহর কাছে তার অসুখের কথা গোপন করেননি। এটা তার সঠিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তাছাড়া জিন্নাহর প্রবল ব্যক্তিত্বের কারণেও ডাক্তারের প্রতিটি পদক্ষেপই তার কাছে ব্যাখ্যা করতে হত। ডাঃ ইলাহী উল্লেখ করেছেন, ‘During my short stay at Ziarat I had come to realize how hard it was to satisfy a shrewd lawyer like him with half-truths.’ (পৃষ্ঠা-১৭ )।জিন্নাহ শুধু জানতে চেয়েছিলেন যে তার অসুখটি নিরাময়যোগ্য কিনা এবং কতদিন তাকে চিকিৎসা নিতে হবে। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ওষুধ দেয়ার পর তার শরীরের কিছুটা উন্নতি হলেও আগস্টের ৯ তারিখ আবার তিনি বেশ দুর্বল হয়ে পড়েন এবং তার পা দুটো বেশ ফুলে যায়। কিডনির অসুখের কারণে এটি হয়েছে বলে ডাক্তার ধারণা করেন। যিয়ারত ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উপরে। তাই ডাক্তার তাকে তৎক্ষণাৎ কোয়েটায় স্থানান্তর করার পরামর্শ দেন। অন্যথায় এর কারণে তার হার্টও আক্রান্ত হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন। ১৩ আগস্ট বিকেলে জিন্নাহকে নিয়ে তারা যিয়ারত থেকে কোয়েটায় পৌঁছান। পথিমধ্যে লোকজন গবর্নর জেনারেলের গাড়ি দেখে আশ্চর্য হয়। কারণ পরদিন ছিল ১৪ আগস্ট, পাকিস্তানের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
কোয়েটায় আসার পর ওষুধপত্রের কারণে জিন্নাহর কিছুটা শারীরিক উন্নতি দেখা যায় যদিও তা ছিল সাময়িক। তার ওজন কমে দাঁড়িয়ে ছিল মাত্র ৮০ পাউন্ড যা পাঁচ ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চি উচ্চতার একজন মানুষের জন্য ছিল নিতান্তই কম। এর মধ্যে একদিন জিন্নাহর ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে সুজির হালুয়া ও পুরি খেতে দেয়া হয়। এ সময় তাঁকে সকালে এবং বিকেলে সামান্য হাঁটানোর চেষ্টা করা হয় এবং তিনি অতি কষ্টে কয়েক পা করে হাটতে পেরেছিলেন। দর্শনার্থীদের দেখা দেয়ার ক্ষেত্রে বারণ থাকলেও কোয়েটায় যারা জিন্নাহকে অল্প সময়ের জন্য দেখতে এসেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন ইস্পাহানী লিয়াকত আলী খান, মোহাম্মদ আলী, গজনফর আলী, গোলাম মোহাম্মদ প্রমুখ।
২৬ আগস্ট ডাঃ ইলাহী জিন্নাহকে করাচী নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করলে তিনি অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। পরিবর্তে তিনি সিবি যাওয়ার কথা বলেন। সিবি বেলুচিন্তানের একটি শহর। সেখানকার উচ্চ তাপমাত্রার কথা জানালে জিন্নাহ মালির যাওয়ার প্রস্তাব করেন। মালির ছিল করাচীর পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি ছোট শহর। কিন্তু সেখানে জিন্নাহর থাকার মত কোন সুবিধাজনক বাসা না পাওয়ায় ডাঃ ইলাহী পুনরায় করাচীতে যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। জিন্নাহ উত্তরে বলেন, ‘Don’t take me to karachi on Crutches. I want to go there when I can walk from the car to my room. You know from the porch you have to pass the ADC’s room and then the Military Secretary’s before you reach mine. I dislike being carried on a stretcher from the car to my room’ (পৃষ্ঠা-৩৪)। কথাগুলো জিন্নাহ অত্যন্ত করুণভাবে বলছিলেন যা ডাঃ ইলাহীকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। মৃত্যুর মুখোমুখি হলে কঠিন মানুষও কত অসহায়হয়ে পড়ে। ২৯ আগস্ট স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর ডাঃ ইলাহী জিন্নাহকে বলেন যে তিনি এখন অনেকটা ভাল আছেন এবং পাকিস্তানকে তিনি ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত দেখে যেতে পারবেন। জিন্নাহ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘You know, when you first came to Ziarat, I wanted to live. Now, however, it does not matter whether I live or die’ (পৃষ্ঠা-৩৯ )। এ কথা বলার সময় জিন্নাহর চোখ জলে ভরে যায় যা ছিল তার মত একজন আবেগহীন মানুষের জন্য বিরল দৃশ্য। তিনিত ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে তার সময় শেষ হয়ে আসছে। তিনি যাদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান আন্দোলন করেছিলেন তার প্রতি তাদের উপেক্ষাই কি তাকে এভাবে আবেগতাড়িত করেছিল? জিন্নাহর মুখে এ কথা শুনে ডাঃ ইলাহী কতটা বিচলিত ও ভেঙ্গে পড়েছিলেন তা বুঝা যায় তার উক্তিতে। তিনি লিখেছেন, ‘ও knew from experience that when a patient gave up the fight, no treatment, however perfect, could achieve much, and was therefore, greatly distressed to find that the man of iron will had given up the fight. ’ (পৃষ্ঠা-৪০) ।
সেপ্টেম্বরের ৩ তারিখ থেকে জিন্নাহর শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা বৃদ্ধি পায়। এর দুদিন পর কফ ও রক্ত পরীক্ষা করে দেখা যায় জিন্নাহ নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়েছেন। এর পরই শুরু হয় তার শ^াসকষ্ট। ডাঃ ইলাহী আরও দুজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। মিস ফাতেমা জিন্নাহকে এ কথা জানানোর পর তিনি ইস্পাহানীর মাধ্যমে আমেরিকা থেকে একজন ডাক্তার আনার উদ্যোগ নেন। কিন্তু আমেরিকা থেকে ডাক্তার আনা ছিল সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং ১০ সেপ্টেম্বরের পূর্বে কোনক্রমেই আমেরিকা থেকে কোন ডাক্তারের পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। ইতোমধ্যে জিন্নাহর শরীরের তাপমাত্রা আরও বাড়তে থাকে। ৯ সেপ্টেম্বর করাচী থেকে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ মিস্ত্রীকে কোয়েটায় আনা হয়। ডাঃ মিস্ত্রি সমস্ত কিছু পরীক্ষা করার পর মত প্রকাশ করেন যে, জিন্নাহকে যে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে আমেরিকার ডাক্তারের পক্ষেও এর চেয়ে বেশি কিছু করা সম্ভব নয়। ডাঃ ইলাহী এবং ডাঃ মিস্ত্রি দুজন একত্রে মিস জিন্নাহকে একথা জানান। শরীরের এই নাজুক অবস্থার মধেও জিন্নাহ বিড় বিড় করে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে তার উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেন।
এ সময় একদিন জিন্নাহর সহকারী একান্ত সচিব আমিন জিন্নাহর সঙ্গে একজন দর্শনার্থীকে দেখা করানোর অনুরোধ নিয়ে ডাঃ ইলাহীর কাছে হাজির হন। জিন্নাহর শরীরের নাজুক অবস্থার উল্লেখ করে ডাঃ ইলাহী অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। কিন্তু আমিন এক ঘণ্টা পর আবার একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনার কথা বলে ডাঃ ইলাহীকে অনুরোধ জানাতে আসেন যদিও আমিন তার নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। ডাঃ ইলাহী আগের মতোই অপরাগতা প্রকাশ করেন। এই দর্শনার্থীর কোন পরিচয় উল্লেখ না করে ডাঃ ইলাহী তার বইয়ে খুবই কৌতুহলোদ্দীপক একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘Later, in Karachi, after the Quaid-i-Azam’s death, I found the identity of the visitor, and was glad that the interview had not been allowed to take place: it would certainly have upset the Quad-i-Azam, and might have hastened his end. What effect the meeting would have had on the course of political events, it is not possible to guess, for no one could surmise what advice he would have given to the visitor.’ (পৃষ্ঠা-৪৯)।
চিকিৎসকগণ জিন্নাহর জীবনের আশা যখন সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছিলেন তখন কোয়েটায় তার মৃত্যু হলে সম্ভাব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা করে তারা তাঁকে করাচীতে নিয়ে যাওয়া সমীচীন মনে করেন। জিন্নাহকে জানালে জিন্নাহ কোনরূপ দ্বিধা না করে করাচীতে যেতে সম্মত হন। তখন করাচী থেকে জিন্নাহকে বহনের জন্য একটি বিমান এবং মালামাল ও অন্যদের জন্য আরও দুটি ছোট ডাকোটা বিমান আনিয়ে নেয়া হয়। ১১ সেপ্টেম্বর অত্যন্ত দ্রুত গতিতে সকলের লাগেজ গুছিয়ে বেলা ২:৩০ মিনিটের মধ্যে সকলে কোয়েটার বিমানে আরোহন করেন। অক্সিজেন ও প্রয়োজনীয় জরুরী চিকিৎসা সরঞ্জামসহ জিন্নাহর সঙ্গে বিমানে আরোহন করেন ডাঃ ইলাহী বখ্শ ও মিস ফাতেমা জিন্নাহ। বিমানে থাকা অবস্থায়ও কয়েকবার জিন্নাহ্র শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা দেয়। সকলের উদ্বেগাকুল মনের মধ্যে দুই ঘণ্টা পর বেলা ৪:১৫ মিনিটে বিমান করাচীতে অবতরণ করে। বিমানবন্দরে জিন্নাহ্কে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন তার সামরিক সচিব। এরপর শুরু হয় আরেক বিড়ম্বনা যার শ্বাসরুদ্ধকর বর্ণনা আছে ডাঃ ইলাহীর বই-এ। বিমানবন্দর থেকে গবর্নর নজেনারেলের বাসভবন ছিল প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরত্বে। জিন্নাহ্কে একটি এ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়। সঙ্গত কারণেই এ্যাম্বলেন্সটি একটু ধীরগতিতে চলছিল। প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর এ্যাম্বুলেন্স পথিমধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। ড্রাইভার অনেক চেষ্টা করেও গাড়িটি চালু করতে ব্যর্থহয়। এদিকে প্রচ- গরমে জিন্নাহ ঘর্মাক্ত ও হাপিয়ে উঠছিলেন। ডাঃ ইলাহী বার বার জিন্নাহ্র হৃদস্পন্দন পরীক্ষা করছিলেন যা বিপজ্জনকভাবে ওঠানামা করছিল। যে জায়গায় এ্যা¤ু^লেন্সটি নষ্ট হয় সেটি ছিল প্রায় জনমানবশূন্য বিরাণ এলাকা। রাস্তায় অন্যান্য গাড়ি চলাচল করলেও কোন এ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যাচ্ছিল না। জিন্নাহর মত একজন মুমূর্ষু রোগীকে যে কোন গাড়িতে নেয়াও সম্ভব ছিল না। একেকটি নিঃশ্বাস সকলের কাছে বিষাক্ত ঠেকছিল এবং অসহায়ভাবে তারা শুধু সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছিলেন। অবশেষে অনেকক্ষণ চেষ্টার পর আরেকটি এ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায়। সেখানে জিন্নাহ্কে স্থানান্তর করে আবার যাত্রা শুরু করা হয়। ডাঃ ইলাহী তার বইয়ে লিখেছেন, ‘The ambulance did not fly the Governor General’s flag, so nobody knew that the Quaid-i-Azam was being taken in a critical condition through the streets of Karachi’ (পৃ: ৫৮)। মাত্র এক বছর আগে যার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান আজ তার কি অবহেলিত করুন যাত্রা। বিমান বন্দর থেকে মাত্র আধা ঘণ্টার পথ দুই ঘণ্টায় অতিক্রম করে জিন্নাহ্কে নিয়ে সন্ধ্যায় গবর্নর জেনারেলের বাসভবনে পৌঁছান সকলে। এরপর ছিল শুধু সময় গণনার পালা। শেষ চেষ্টা হিসেবে রাত দশটার দিকে জিন্নাহকে একটা ইনজেকশন দেয়া হয়। ডাঃ ইলাহী নিজেই ইনজেকশনটা দেন এবং জিন্নাহ্কে মিথ্যা সান্ত¦না দিয়ে বলেন, ‘Sir, we have given an injection to strengthen you, and it will soon have effect. God willing, you are going to live’ (পৃষ্ঠা-৬১ )। জিন্নাহ্ মাথা নেড়ে মৃদুস্বরে জনাব দেন ‘No, I am not’ এই ছিল তার শেষ কথা। রাত্র ১০:২০ মিনিটের সময় ডাঃ ইলাহী জিন্নাহ্র হৃস্পন্দন পরীক্ষা করে দেখেন সব শেষ। অন্তিম সময়ে জিন্নাহ্র শয্যাপাশের্^উপস্থিত ছিলেন তার সারাজীবনের সঙ্গী বোন ফাতেমা জিন্নাহ এবং ডাঃ ইলাহী বখ্শ, ডাঃ মিস্ত্রি ও ডাঃ এম. এইচ শাহ এই তিনজন ডাক্তার। ডাঃ ইলাহীর বর্ণনায়, ‘I looked at Miss Jinnah to indicate that it was all over.’ (পৃষ্ঠা-৬২) । জিন্নাহ্র নেতৃত্বে তাঁর বিপুলসংখ্যক সহকর্মী এবং উপমহাদেশের কোটি কোটি মুসলমান ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনি তুলে যে রাষ্ট্র কায়েম করেছিল সেই দেশে মাত্র এক বছরের মাথায় চরম উপেক্ষায়, অবহেলায় আর প্রায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। নিয়তির পরিহাস কত নিষ্ঠুর!
এবারে মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বে যে নেতা জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে ব্যর্থহন সে বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক। ডাঃ ইলাহী তার বইয়ের কোথাও তার নাম উল্লেখ করেননি। কিন্তু আমার কাছে ডাঃ ইলাহী বখ্শ এর লেখা ‘With the Quaid-i-Azam : during his last days’ শীর্ষক যে বইটি আছে সেটি ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ। জানা যায় ডাঃ ইলাহী জিন্নাহর মৃত্যুর পর পরই এই বইটি লিখেন ১৯৪৯ সালে। সরকারী চাকরিতে নিয়োজিত থাকার কারণে তিনি বইটি প্রথমে সরকারের কাছে জমা দেন ছাপানোর অনুমতি চেয়ে। কিন্তু তাকে অনুমতি দেয়া হয়নি এবং বইটির জমা দেয়া কপিটিও বাজেয়াপ্ত করা হয়। পরবর্তীতে বেশ কয়েক পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে ১৯৭৮ সালে বইটি ছাপানোর অনুমতি দেয়া হয়। রাজনৈতিক স্পর্শকাতর বিষয় অন্তর্ভুক্তির অজুহাতে ওই পৃষ্ঠাগুলো সরকার ছাপানোর অনুপযুক্ত ঘোষণা করে। তবে কি মূল কপিতে উল্লিখিত নেতার বা আরও কারও কারও নাম ছিল? কে সেই নেতা? তিনি কি লিয়াকত আলী খান?
প্রথম জীবনে জিন্নাহ ছিলেন একজন উদার ও অসাম্প্রদায়িক মানুষ। মুসলমানদের নিয়ে রাজনীতি করলেও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তার কোন আগ্রহ ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কোন ধর্মীয় আচার আচরণ পালন করতেন না। এমনকি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই তিনি লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও লেডী মাউন্টব্যাটেন এর সম্মানে একটি রাষ্ট্রীয় মধ্যাহ্ন ভোজসভা আয়োজনের নির্দেশ দেন। তখন ছিল পবিত্র রমজান মাস। সামরিক সচিব তাকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিলে জিন্নাহ বলেন যে তিনি এবং মাউন্টব্যাটেন কেউই রোজা থাকেন না, সুতরাং মধ্যাহ্নভোজসভা অনুষ্ঠানে কোন অসুবিধা নাই। সামরিক সচিব জিন্নাহকে বিশেষভাবে মনে করিয়ে দেন যে মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতি কাজে লাগিয়েই পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে। তখন জিন্নাহ বেশ বিরক্তির সঙ্গে ঐদিনই মধ্যাহ্নভোজের পরিবর্তে নৈশভোজ আয়োজনে রাজি হন। বিভিন্ন তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে পরবর্তীতে তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বের মত সাম্প্রদায়িক মতাদর্শকে গ্রহণ করেন ও মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির দাবি তোলেন। জিন্নাহ্র এই মত পরিবর্তনের জন্য নেহরু ও কিছু হিন্দু নেতৃবৃন্দের দায়ও কম ছিল না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস ত্যাগ করার পর গান্ধীও সম্পূর্ণভাবে ওই সকল প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু নেতাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মুহূর্তে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও কোটি কোটি উদ্বাস্তুর দুঃখ দুর্দশা দেখে জিন্নাহ তার ভুল বুঝতে পেরেছিলেন বলে অনেকে মতপ্রকাশ করেছেন। ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে জিন্নাহ বলেন, ‘You are free; you are free to go to your temples, you are free to go to your mosques or to any other place or worship in this state of Pakistan. You may belong to any religion or caste or creed – that has nothing to do with the business of the State.’ একই বক্তৃতায় তিনি আরও বলেন, ‘In course of time Hindus would cease to be Hindus and Muslims would cease to be Muslims, not in the religious sense, because that is the personal faith of each individual, but in the political sense as citizens of the state.’ স্পষ্টতই জিন্নাহর এই বক্তৃতা ছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের সম্পূর্ণ বিরোধী। কিন্তু মুসলিম লীগে জিন্নাহর যারা অনুসারী তাদের অধিকাংশই ছিলেন সম্পূর্ণভাবে প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মান্ধ রাজনীতির অনুসারী। জিন্নাহর বক্তব্যে তারা খুশি হননি। তারা বুঝতে পারেন যে জিন্নাহ তাদের কাছ থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছেন। তাদের কাছে জিন্নাহর প্রয়োজন তখন ফুরিয়ে গিয়েছে যা তাদের আচরণেই প্রকাশ পেতে থাকে। না হলে ১৯৪৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মৃত্যুপথযাত্রী জিন্নাহ যখন যিয়ারত থেকে করাচী আসেন তখন বিমান বন্দরে একমাত্র উপস্থিত ছিলেন তার সামরিক সচিব কর্নেল নওল্স। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য ইব্রাহীম ইসমাইল চুন্দ্রীগর, সরদার আবদুর রব নিশতার, রাজা গজনফর আলী, গোলাম মোহাম্মদ, ফজলুর রহমান, যোগেন্দ্রনাথ ম-ল, মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ্ খান, আবদুস সাত্তার পীরজাদা প্রমুখ কেউই বিমান বন্দরে উপস্থিত থাকার সৌজন্যটুকুও দেখাননি। তাদের এ আচরণ শুধু সৌজন্যহীন নয়, সম্পূর্ণ মানবিকতা বিবর্জিত। জিন্নাহর জন্য যে এ্যাম্বুলেন্সটি প্রেরণ করা হয় সেটিও ছিল অত্যন্ত পুরাতন, প্রায় অকেজো, পথিমধ্যেই যা নষ্ট হয়ে যায়। এতে পর্যাপ্ত জ্বালানিও ছিল না।
‘Quaid-i-Azam Muhammad Ali Jinnah – The Man Behind the Curtain’ নামে জিন্নাহর জীবনীভিত্তিক একটি উপন্যাস লিখেছেন দিনকার যোশী। তিনি একজন বিখ্যাত গুজরাটি লেখক। গুজরাটি ভাষায়ই তিনি লিখতেন। জিন্নাহ ছাড়াও তিনি গৌতম বুদ্ধ, রবীন্দ্রনাথ, টলস্টয় এবং সরদার প্যাটেলের জীবনী নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। ‘Mahatma vs Gandhi’ শীর্ষক লেখা তার বিখ্যাত উপন্যাস নিয়ে সিনেমা নির্মিত হয়েছে যা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। জিন্নাহকে নিয়ে লেখকের বইয়ে উল্লেখ আছে যে লিয়াকত আলী খান একবার যিয়ারতে জিন্নাহকে দেখতে গেলে জিন্নাহ অত্যন্ত রাগান্বিতভাবে বলেন, ‘The manner in which you are working surrounded by Mullahs and Maulvis, the Pakistan of my dreams cannot be created. MyPakistan can only be modern, not medieval. I have made you the Prime Minister for making Pakistan a modern nation. Ifeel, my decision was wrong.’ ডাক্তার জিন্নাহকে উত্তেজিত হতে বারণ করলেও তিনি বলতে থাকেন, ‘I demanded Pakistan in the interest of Hindus and Muslims– living for centuries in this subcontinent. But the events of the past one year will lead to permanent suffering of both these communities. You are taking Pakistan towards the medieval age to be ruled by the Mullahs and Maulvis. This is not acceptable to me.’ ব্রিটিশ লেখক ও গবেষক এ্যালেক্স ভন টুনজেলম্যান তার ‘Indian Summer’ লেখা বইয়েও উল্লেখ করেছেন যে লিয়াকত আলী খান জিন্নাহর সঙ্গে দেখা করতে গেলে জিন্নাহ বলেন, ‘Pakistan was the biggest blunder of my life. If I get an opportunity I will go to Delhi and tell Jawaharlal Nehru to forget about the follies of the past and become friends again’
পাকিস্তানের পরবর্তী অবস্থা প্রমাণ করে জিন্নাহর আশঙ্কা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়েছিল। কিন্তু যা দুঃজনক তা হল পাকিস্তানকে ওই অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার সম্পূর্ণদায় দায়িত্ব জিন্নাহ নিজেই নিজ স্কন্ধে নিয়েছিলেন সেই দিন, যেদিন তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বকে গ্রহণ করেছিলেন তার রাজনৈতিক আদর্শহিসেবে। লিয়াকত আলী খান পরে আরও একবার চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে নিয়ে জিন্নাহকে দেখতে এসেছিলেন। জানা যায় জিন্নাহ তার বোন মিস ফাতেমা জিন্নাহর কাছে মন্তব্য করেছিলেন যে তারা এসেছিলেন দেখতে যে তার মারা যেতে আর কতদিন বাকি আছে। রোগ শয্যায় জিন্নাহর সঙ্গে লিয়াকত আলীর এসব কথোপকথনের সময় একমাত্র উপস্থিত ছিলেন জিন্নাহর চিকিৎসক ডাঃ কর্নেল ইলাহী বখ্শ। এগুলোর সত্যতা জানা যেত ইলাহী বখ্শের লেখা বইটির মূল সংস্করণ উদ্ধার করতে পারলে। সে সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। ডাক্তার ইলাহী বখ্শ ইন্তেকাল করেছেন ১৯৬০ সালে। কেন বইটি ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে বেআইনী রাখা হয়েছিল,কি ছিল সেই কয়েক পৃষ্ঠায় যা বাদ দিয়ে বইটি প্রকাশ করতে দেয়া হয়, এ প্রশ্নগুলো আজও অমীমাংসিত।