ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

দেশে প্রথম লবণ সহিষ্ণু গম উদ্ভাবন, কৃষিতে যুগান্তকারী সংযোজন

স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর

প্রকাশিত: ১৯:৫১, ২ জুলাই ২০২৫

দেশে প্রথম লবণ সহিষ্ণু গম উদ্ভাবন, কৃষিতে যুগান্তকারী সংযোজন

ছবি: জনকন্ঠ

দেশে উচ্চ লবণাক্ততা সহনশীলতার দিক থেকে প্রথম একটি নতুন গমের জাত ‘জিএইউ গম ১’ উদ্ভাবন করেছে গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (গাকৃবি)। ব্যতিক্রমী সংযোজন হিসেবে পরিগণিত প্রিমিয়াম কোয়ালিটির উচ্চ লবণাক্ততা (১২ ডিএম/এস) সহনশীল এই নতুন জাতটি উচ্চফলনশীল ও অধিক প্রোটিন সমৃদ্ধ। বুধবার জনসংযোগ শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ আব্বাস উদ্দিন এ তথ্য জানিয়েছেন।

তিনি জানান, গাকৃবির কৃষিতত্ত্ব বিভাগের কৃষি বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এম. ময়নুল হক এবং প্রফেসর ড. মোঃ মসিউল ইসলামের নেতৃত্বে সফল গবেষণার মাধ্যমে সম্প্রতি নতুন গমের জাত ‘জিএইউ গম ১’ উদ্ভাবিত হয়েছে। এ জাতটি উচ্চ লবণাক্ততা (১২ ডিএম/এস) সহনশীলতার দিক থেকে দেশে এটিই প্রথম উদ্ভাবন যা ব্যতিক্রমী সংযোজন হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জন্য অধিক কার্যকরী প্রিমিয়াম কোয়ালিটির এই নতুন জাতটি লবণাক্ততা সহনশীল, উচ্চফলনশীল ও অধিক প্রোটিন সমৃদ্ধ। অপার সম্ভাবনাময় এ জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে গাকৃবির মোট উদ্ভাবিত জাতের সংখ্যা ৯১টি তে পৌঁছালো, যা বাংলাদেশের কৃষিতে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করলো।

কৃষিতত্ত্ব বিভাগের ওই দুই কৃষি বিজ্ঞানী জানান, গাকৃবির গবেষণা মাঠে দীর্ঘদিন গবেষণা ও ফলন পরীক্ষার পর ২০২১ থেকে ২০২৩ সালে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কৃষকের মাঠে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে লবণাক্ততা সহিষ্ণু ও উচ্চ ফলনশীল হিসেবে প্রমাণিত হয়। পরবর্তীতে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে দেশের ৬টি স্থানে মাঠ মূল্যায়নে প্রস্তাবিত ফলন পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফলাফলের সুপারিশের প্রেক্ষিতে জাতীয় বীজ বোর্ড গত ১৭ জুন এই জিএইউ গম ১ এর ছাড়পত্র দেয়। এ গমে বিদ্যমান অধিক প্রোটিন শরীর গঠন ও মেরামত, শক্তি সরবরাহ, ইমিউন সিস্টেমের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে রোগ প্রতিরোধে অধিক সহায়তা করে থাকে। অন্যদিকে পর্যাপ্ত পরিমাণ গ্লুটেনিন থাকায় এটি উচ্চ প্রোটিন ও লো ফ্যাট হওয়ায় সহজে শরীরে শোষিত হতে পারে। ডিইউএস এর ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সম্বলিত ল্যাব টেস্টে প্রমাণিত হয় যে এটি সাধারণ গম থেকে ভিন্ন গুণসম্পন্ন।

তারা আরো জানান, জিএইউ গম ১ এর দানা তামাটে, চকচকে এবং তুলনামূলক কম সময়ের মধ্যে পরিপক্ব হয়। আমন মৌসুমে ধান কাটার পর বীজ বপন করলে ৯৫ থেকে ১০০ দিনে উৎপাদন পাওয়া যায়। ফলে অল্প সময়ে অধিক ফলন পেয়ে কৃষকরা লাভবান হতে পারেন। অন্যদিকে এ গমের গাছের আকার বড়, কাণ্ড মোটা ও গুটির সংখ্যা বেশি হওয়ায় এটি থেকে অধিক পরিমাণ খড় পাওয়া যায়, ফলে গবাদি পশুর খাদ্য চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। উৎকৃষ্টমানের এ জাতের ফলন হেক্টর প্রতি স্বাভাবিক মাটিতে ৪.৫ টন এবং লবণাক্ত মাটিতে ৩.৭৫ টন ফলন পাওয়া সম্ভব, যা একে অন্যান্য জাতের গম থেকে বিশেষ স্থানে নিয়ে গিয়েছে। উন্নত এ ইনব্রেড জাতটি বিভিন্ন রোগ যেমন- ব্লাস্ট, রস্ট ইত্যাদির রোগ প্রতিরোধক সম্পন্ন হওয়ার কারণে সাধারণ জাতের তুলনায় এটি গড়ে ১০-১৫% বেশি ফলন দিতে সক্ষম যা বাংলাদেশের মতো কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে এর উপযোগিতা অনেক। আবার এটি লবণ সহনশীল হওয়ায় মানব শরীরে সোডিয়াম ক্লোরাইডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে কার্যকরভাবে পানি ও পুষ্টি শোষণ করতে পারে। এছাড়া জলবায়ু সহনশীলতা ও রোগ-পোকা প্রতিরোধ ক্ষমতা থাকায় এটি দেশের বৈচিত্র্যময় পরিবেশে চাষের জন্য উপযোগী ও লাভজনক একটি জাত।

সার্বিক বিষয়ে এ জাতের অন্যতম উদ্ভাবক প্রফেসর ড. মোঃ মসিউল ইসলাম বলেন, "জিএইউ গম ১’ উদ্ভাবন আমাদের দীর্ঘদিনের গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতার ফল। দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও লবণাক্ত এলাকায় ফসল উৎপাদনের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যেই আমরা এই গমের জাতটি উদ্ভাবনে কাজ শুরু করি। এই জাতটি লবণাক্ত পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে এবং তুলনামূলকভাবে অধিক ফলন দেয় যা কৃষকের জন্য যেমন লাভজনক, তেমনি দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।"

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা আশা করি, ‘জিএইউ গম ১’ দ্রুত মাঠ পর্যায়ে বিস্তার লাভ করবে এবং দেশের বিভিন্ন লবণাক্ত অঞ্চলে গম চাষে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। আমরা এ অর্জনকে কৃষকের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে দেখছি।’’

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. জিকেএম মোস্তাফিজুর রহমান এ অসামান্য অর্জনে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, "নতুন জিএইউ গমের এ জাতের উদ্ভাবন এটি শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের কৃষি খাতের জন্য একটি বড় অর্জন। আমাদের দেশের উপকূলীয় অঞ্চল ও লবণাক্ত মাটিযুক্ত এলাকায় কৃষি উৎপাদন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে থাকে। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের গবেষকরা নিরলস পরিশ্রম করে এমন একটি জাত উদ্ভাবন করেছেন, যা লবণাক্ত পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে এবং অধিক ফলন দিতে সক্ষম।"

নতুন এ জাতটিকে দেশের টেকসই কৃষির প্রতীক উল্লেখ করে উপাচার্য আরো বলেন, "এর মাধ্যমে কৃষকেরা আগের চেয়ে অধিক লাভবান হবেন এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথে আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে যাবো।"

এ সময় তিনি এই উদ্ভাবনের পেছনে শ্রম দেয়া গবেষণা দল, ল্যাব এবং মাঠপর্যায়ের বিজ্ঞানীদের  আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।

Mily

×