
সবুজ জ্বালানির বিশ্ব প্রতিযোগিতায় যখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দাপট, তখন ইউরোপের ছোট্ট একটি দেশ চুপিসারে লিখে ফেলেছে নতুন ইতিহাস। অস্ট্রিয়ার প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এক যুগান্তকারী আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছে পরিবেশ-বিনাশী ব্যাটারিও একদিন পরিচ্ছন্ন জ্বালানির উৎসে পরিণত হতে পারে। রূপকথার মতো শোনালেও এটি বিজ্ঞান, একেবারে বাস্তব। এখন ব্যাটারিকে বীজের মতো মাটিতে "রোপণ" করলেই তৈরি হবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য মিথেন, যা হবে ভবিষ্যতের টেকসই জ্বালানি।
বৈপ্লবিক এই আবিষ্কারটি কীভাবে কাজ করে?
এর পেছনে কোনো জাদু নেই,পুরোটাই বিজ্ঞানের জয়। গবেষকরা ব্যাটারির পরিত্যক্ত অংশ, বিশেষ করে নিকেল ও অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের অ্যালুমিনা সংগ্রহ করে তৈরি করেছেন এক বিশেষ ধরনের "ন্যানোক্যাটালিস্ট"। এই কৌশলটি হাইড্রোজেনের মাধ্যমে কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে রূপান্তর করে মিথেনে, যা পরিচ্ছন্ন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারযোগ্য। ফলে একসময় বিষাক্ত বর্জ্য হিসেবে বিবেচিত বস্তুটাই এখন পরিণত হচ্ছে জ্বালানি উৎপাদনের মূল অস্ত্রে আধুনিক কালের রাসায়নিক অলৌকিকতা বলা চলে।
বিষাক্ত থেকে বিকল্প শক্তির দিকে অগ্রসর অস্ট্রিয়া
ব্যাটারি যতই আধুনিক হোক, তা ক্ষয়প্রাপ্ত হলে পরিবেশের ওপর ফেলে মারাত্মক প্রভাব। প্রতি বছর লাখ লাখ ব্যাটারি জমা পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কখনও ল্যান্ডফিলে, কখনও অপেক্ষমাণ পুনর্ব্যবহার কেন্দ্রে। তবে অস্ট্রিয়ার নতুন পন্থা এই জমাকৃত বিষাক্ত বর্জ্যকে পরিণত করছে পরিবেশবান্ধব শক্তির উপাদানে। পুরোনো তিন ‘R’ এর Reduce, Reuse, Recycle আধুনিক ব্যাখ্যা যেন এই গবেষণা।
প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ ব্যবহার কী?
এই পদ্ধতি যদি ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়, তাহলে শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে পরিবহন খাতে সবখানেই এর জ্বালানি ব্যবহার সম্ভব। ফলে শুধু পুনর্ব্যবহার নয়, কার্বন নিঃসরণও ব্যাপক হারে কমানো সম্ভব হবে। এমন এক সময়ে যখন জলবায়ু পরিবর্তন মানবজাতির বড় হুমকি, তখন এই উদ্ভাবন হতে পারে টেকসই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।
বর্তমানে ব্যবহৃত ব্যাটারির পরিণতি কী হয়?
বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত ব্যাটারির অধিকাংশই এখন তিনটি পথে যায় আংশিক রিসাইক্লিং, জমা রেখে দেওয়া বা সরাসরি ডাম্পিং। প্রথম ক্ষেত্রে মূল্যবান উপাদান (যেমন নিকেল, কোবাল্ট) পুনরুদ্ধার করা হয়, কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটি ব্যয়বহুল এবং জটিল। দ্বিতীয় পথ হলো সংরক্ষণযেখানে কোনো সদুত্তর না থাকায় ব্যাটারিগুলো বছরের পর বছর পড়ে থাকে। আর তৃতীয় ও সবচেয়ে ক্ষতিকর উপায়টি হলো ল্যান্ডফিলে ফেলা বা উন্নয়নশীল দেশে রপ্তানি করা। এসব দেশে যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে বিষাক্ত যৌগ ছড়িয়ে পড়ে মাটি ও পানিতে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।
অস্ট্রিয়ার পদ্ধতি কতটা পরিবেশবান্ধব?
এই পদ্ধতিতে CO₂-কে কাজে লাগিয়ে মিথেনে রূপান্তরিত করা হচ্ছে, যা একদিকে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্যাসটির প্রভাব কমায়, অন্যদিকে তা পরিণত হয় কার্যকর জ্বালানিতে। এটি শুধু পুনর্ব্যবহার নয়, বরং এক ধরনের পুনঃসমন্বিত শক্তিচক্র তৈরি করছে, যা তেল, গ্যাস বা ধোঁয়াবিলাসী বিকল্পগুলোর চেয়ে অনেক গুণ পরিচ্ছন্ন ও টেকসই।
চীন ও সিলিকন ভ্যালির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অস্ট্রিয়ার জবাব
যখন সিলিকন ভ্যালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকে আর চীন একচেটিয়া উৎপাদনে ব্যস্ত, তখন অস্ট্রিয়া যা কিছু আগে থেকেই আছে, তা নতুনভাবে ব্যবহার করে বাস্তব সমস্যার বাস্তব সমাধান দিচ্ছে। এটি শুধু পরিবেশরক্ষা নয়, বরং প্রযুক্তিকে মানবকল্যাণে ব্যবহারের এক মাইলফলক উদাহরণ।
অস্ট্রিয়ার এই উদ্যোগ প্রমাণ করে যে, ছোট দেশগুলোও বড় পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে যদি থাকে সৃজনশীল চিন্তা ও বিজ্ঞাননির্ভর পদক্ষেপ। বিষাক্ত বর্জ্য থেকে পরিচ্ছন্ন শক্তি উৎপাদনের এই পদ্ধতি যদি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য এক টেকসই গ্রহ উপহার দেওয়া আর স্বপ্ন থাকবে না বাস্তব হবে।
সূত্র:https://tinyurl.com/sfk46a95
আফরোজা