
রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান
শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলে ভয়ংকর জুলুমের শিকার হয়েছিল। জুলুম করে আমাদের বুক থেকে এক এক করে ১১ জন শীর্ষ দায়িত্বশীল নেতাকে মিথ্যা, সাজানো ও পাতানো মামলায় এবং মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানের মাধ্যমে কার্যত জুডিসিয়াল কিলিং করা হয়েছে। জাতির এই সংকট মুহূর্তে আমাদের মাথার তাজ এসব নেতৃবৃন্দ যদি বেঁচে থাকতেন, তারা তাদের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা-অভিজ্ঞতা দিয়ে এই জাতিকে পথ দেখাতে পারতেন। মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকার কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের মুক্তিযোদ্ধা হলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের খালাসের পর এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
জামায়াত আমির বলেন, দীর্ঘদিন আমরা এমন একটি সুবিচারপূর্ণ রায়ের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। সেই রায় দিয়ে আজ আল্লাহ তাআলা আমাদের আরও বেশি কৃতজ্ঞ করেছেন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বিগত শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনামলে ভয়ংকর জুলুমের শিকার হয়েছিল। যে জায়গায় বসে আজকে আমি কথা বলছি, সেখানে আগে আপনারা দীর্ঘদিন যাদের বসতে দেখেছেন, যাদের মুখের কথা শুনেছেন কার্যত তাদেরই একজন ছাড়া দুনিয়া থেকে সবাইকে নির্মমভাবে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। আমি সেই সমস্ত পরম শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দ এবং তাদের যে সমস্ত সহকর্মীদের নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে মহান রবের দরবারের কাতর কণ্ঠে তাদের জন্য আমি শাহাদাতের সর্বোচ্চ দরজা কামনা করছি।
তিনি বলেন, স্বৈরশাসনের আমলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন, বিডিআর সদস্যরা এবং সাধারণ প্রতিবাদী জনগণ যাদেরকে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে বিশেষ করে চব্বিশের বিপ্লবের সময় যাদের হত্যা করা হয়েছে আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করি তিনি তাদের শহীদ হিসেবে কবুল করুন।
এ সকল শহীদ পরিবারের সকল সদস্যের প্রতি আমাদের সীমাহীন শ্রদ্ধা, ভালোবাস রইল। তাদের জন্যও মহান রবের দরবারে দোয়া করি তিনি যেন এর বদলা দুনিয়া এবং আখিরাতের উত্তম জাযাহ দান করেন এবং শহীদদের সঙ্গে তাদেরও যেন পরম জান্নাতের ঠিকানা দান করেন। আমরা যারা তাদের দায়িত্ব নিয়েছি আমাদের সীমাহীন ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও এগিয়ে চলার চেষ্টা করছি। আল্লাহ তায়ালা তার কুদরতি হাত দিয়ে এই জাতি এবং দ্বীনের জন্য আমাদের কবুল করুন।
জামায়াত আমির বলেন, আজকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ আমাদের রিভিউ আবেদন শুনানির পর রায় ঘোষণা করেছেন। এই রায়ে আমাদের সম্মানিত মজলুম নেতা এবং আমাদের প্রিয় ভাই এটিএম আজহারুল ইসলামকে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে। জাতির এই সংকট মুহূর্তে আমাদের মাথার তাজ এসব নেতা যদি বেঁচে থাকতেন, তারা তাদের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা-অভিজ্ঞতা দিয়ে এই জাতিকে পথ দেখাতে পারতেন। ক্যাঙারু কোর্ট এভাবে এক একজন করে তাদের হত্যা করেছে। দুনিয়ার কেউ তাদের আর আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
কিন্তু তাদের স্মৃতি এবং কর্ম ও তাদের অবদান আল্লাহর দ্বীনের জন্য অম্লান থাকবে এবং বারবার ফিরে আসবে।
ডা. শফিক বলেন, মামলাগুলো পরিচালনা করতে গিয়ে সীমাহীন জাল-জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। কীভাবে মিথ্যার আশ্রয় নেয়া হয়েছিল, সাবেক বিচারপতি এসকে সিনহা তার লেখা নিজের বইয়ে স্বীকার করেছেন।
কিভাবে পরিকল্পনা মাফিক, ঠান্ডা মাথায় এসব নেতৃবৃন্দকে খুন করতে হবে তার ছক তৎকালীন বিচার বিভাগ এবং সরকার মিলে তৈরি করেছিলেন। আপনারা দেখেছেন এক একটা রায় হয়েছে, বাস্তবায়ন হয়েছে। যাকে খুন করা হয়েছে বিচারিক আদালতের মাধ্যমে তিনি তো আল্লাহর দরবারে চলে গেলেন। কিন্তু পাশাপাশি একই সময় পরিবারের সদস্যদের ওপর নির্মম কশাঘাত এবং অত্যাচার করা হয়েছে।
স্কাইপ কেলেঙ্কারির ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই ঘটনায় গোটা বিশ্ববাসীর নিকট নিন্দিত হয়েছে, তিরস্কৃত হয়েছে। গোটা বিচার প্রক্রিয়ার সময় দু’টি টর্চার সেল গঠন করা হয়েছিল। একটার নাম দেওয়া হয়েছিল সেইফ হোম, আরেকটার নাম দেওয়া হয়েছিল সেফ হাউজ। সেফ হোমে ভিকটিম নেতৃবৃন্দকে নিয়ে নাজেহাল করা হতো। সেখানে উচ্চ আদালতের ডিরেকশনে সেফ হোমে রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন তাদের ওপর অত্যাচার চালানো হয়েছে। আমরা তখন নিরবে সহ্য করেছি। আমরা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছি। চোখের পানি ফেলে আল্লাহর কাছে বলেছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা এই দেশকে ভালোবাসি। আমাদের প্রিয় নেতৃবৃন্দও এই দেশকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসার জায়গা থেকে তারা চেষ্টা করেছেন দেশের মানুষের জন্য ভালো কিছু করার। তাদের সবটুকু যোগ্যতা উজার করে দিয়ে তারা বাংলাদেশে সুস্থ ধারার রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন। শুধু রাজপথে নয়, সরকারের একটি অংশ হওয়ার পরও তারা সরকারি ব্যবস্থাপনাগুলোকে ভালো করার চেষ্টা করেছেন।
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর কথা উল্লেখ করে জামায়াত আমির বলেন, তিনি শুধু জামায়াতে ইসলামীর সম্পদ ছিলেন না বা তিনি শুধু বাংলাদেশের মানুষের সম্পদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বের বিশ্বাসী মানুষের সম্পদ। তার সঙ্গে কী আচরণ করেছে আপনারা দেখেছেন। তার এই মামলার ব্যাপারে সঠিক কথাটা বলতে সুখরঞ্জনবালি এসেছিলেন। কিন্তু আইনজীবীর গাড়ির দরজা খুলে তাকে তুলে নেয়া হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশের আদালতে এরকম ঘটনা ঘটেনি।
তিনি বলেন, এপিলেট ডিভিশনে হিয়ারিং এর সময় প্রধান বিচারপতি সরকার পক্ষের কৌসুলীকে বলছেন, যা কিছু বললেন, তাতে মতিউর রহমান নিজামীকে একদিনের জন্য বা এক মিনিটের জন্যও শাস্তি দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা আশা করেছিলাম, সত্য কথাটা খোলা কোর্টে বলার পরে অন্তত তার কথার মর্যাদা রাখবেন। কিন্তু না ওই যে আগের চক্রটা বিদেশ থেকে সাপ্লাই দেয়া রায়ের ভিত্তিতে তাকেও শাস্তি দেয়া হলো।
জামায়াত আমির বলেন, এই মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে ইন্টারন্যাশনাল কাস্টমারি যে ল আছে তা ফলো করা হয়নি আবার ডোমেস্টিক যে ল আছে তাও ফলো করা হয়নি। আমাদের দেশে যে এভিডেন্স ল আছে এটা মোটেই ফলো করা হয়নি। সেদিন সংবিধান কোনো বিষয় ছিল না, আইন কোনো বিষয় ছিল না। যাদের ইশারায় কোর্ট পরিচালনা করা হতো, তাদের ইচ্ছাই ছিল আইন; সেটা বৈধ হোক কিংবা অবৈধ হোক। এইভাবে তা-ব চালানো হয়েছে আমাদের ওপর।
বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ মামলার বিষয়ে ব্রিটেনের উচ্চ আদালত তাদের রায়ে বলেছে এই মামলাগুলো বিচারের নামে প্রহসন; জাস্ট জেনোসাইড অব দ্যা জাস্টিস। বিচারকে গণহত্যা করা হয়েছে। তারা কিলিং অব দ্যা জাস্টিস বলে নাই। কারণ সিঙ্গেল কেস হলে বলত কিলিং কিন্তু এখানে ছিল একাধিক কেস। একারণেই তারা বলেছে ইট ওয়াজ এ জেনোসাইড টু জাস্টিস। ব্রিটিশ আদালত এটাকে জেনোসাইড বললেও বাংলাদেশের তৎকালীন কোর্ট তা বলে নাই। তবে বাংলাদেশের কোর্ট আজ সেটাই বলেছে তাদের রায়ের মাধ্যমে। আজকে আমাদের আদালত বলেছে আপিল বিভাগ মিসক্যারেজ অব দ্যা জাস্টিস। ন্যায়ভ্রষ্ট রায়, অন্যায় রায়।
শত কষ্ট আমাদের বুকে থাকা সত্ত্বেও আমরা দেশকে ভালোবাসি। আমরা প্রতিশোধ নেইনি আপনারা দেখেছেন কিন্তু আমরা ন্যায়বিচার চাই। এ রায়ের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে এই রায় ছিল ইচ্ছাকৃত; গণহত্যার মাধ্যমে নেতৃত্ব শূন্য করা। একটা দেশ ও দলের নেতৃত্ব শূন্য করার মানেই হচ্ছে জনগণকে অন্ধকারের মাঝে ঠেলে দেয়া।
এ রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে সত্যকে চেপে রাখা যায় না। সত্য মেঘের আড়াল ভেদ করে আলোর ঝলক নিয়ে আসে, সে সত্যটাই আজ প্রমাণিত হল। আমরা জাতির কাছে কথা দিচ্ছি মহান আল্লাহর একান্ত ইচ্ছায় প্রিয় দেশবাসীর সমর্থন সহযোগিতায় যদি এই দেশের সেবা করার সুযোগ আমাদের কাছে আসে, তাহলে আমরা ইনশাআল্লাহ প্রতিশোধের রাজনীতির অবসান ঘটাব।
তিনি আরও বলেন, আমরা শত বিপদাপদের মধ্যেও দেশবাসীর পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। এমনকি গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের শহিদ, আহত ও পঙ্গু ভাই বোনদের পাশে থাকার। আমরা বিশ্বাস করি আমরা আমাদের সবটুকু দিয়ে আমাদের পুরো কর্তব্য আদায় করতে পারিনি আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে। এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। আপনারা আমাদের ক্ষমা করবেন আমাদের কোনো আচরণে এবং কোনো কথা ও কাজের মাধ্যমে কষ্ট পেয়ে থাকলে যখন যেভাবে হোক। কেউই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়, দল হিসেবেও আমরা দাবি করিনা আমরা ভুলের ঊর্ধ্বে। এ সংগঠনের কোনো নেতাকর্মী বা সহকর্মীদের দ্বারা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন, সবার কাছে বিনা শর্তে ক্ষমা চাই। আপনারা আমাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন।
কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমানের সঞ্চালনায় সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নায়েবে আমির সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, সাবেক এমপি ড. হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম, মাওলানা মোয়াজ্জম হোসাইন হেলাল, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের প্রমুখ।