
এটিএম আজহারুল ইসলাম
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল করে জামায়াতে ইসলামীর নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ মঙ্গলবার সকালে এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন।
বেঞ্চের অন্য ছয়জন হলেন- বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি ইমদাদুল হক, বিচারপতি মো. আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। রায়ে আপিল বিভাগ অবিলম্বে এটিএম আজহারুল ইসলামকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদ- থেকে খালাস পাওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা হয়ে থাকবে বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী।
আজহারুল ইসলামের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির জানিয়েছেন বুধবার মুক্তি পাবেন এটিএম আজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ইনশাআল্লাহ, আশা করি আজ সকালে এটিএম আজহারুল ইসলাম মুক্তি পাবেন। রায়ের পর আদালত প্রাঙ্গণে উল্লাস প্রকাশ করেন আইনজীবীরা। রায় শোনার জন্য আদালত প্রাঙ্গণে ও এজলাস কক্ষে সাংবাদিক, আইনজীবী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ অনেকেই এসেছিলেন। রায় ঘোষণার পর জামায়াতে ইসলামীর নারায়ে তাকবির ধ্বনী দেয়। আইনজীবী শিশির মনির তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এই রায়ের মধ্য দিয়ে সত্য জয়ী হয়েছে, মিথ্যা পরাজিত হয়েছে।’ রায়ের সময় রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক। তবে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
আদালতে জামায়াত নেতা আজহারের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির, ব্যারিস্টার এহসান আবদুল্লাহ সিদ্দিক, ব্যারিস্টার ইমরান আবদুল্লাহ সিদ্দিক, ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন। রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক ও প্রসিকিউশনের পক্ষে প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম।
বিচার বিভাগের ইতিহাসে এই প্রথম ॥ বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে এই প্রথম মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি আপিল বিভাগের রায়ে খালাস পেলেন। এই রায়ের ফলে জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলামের মুক্তিতে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। আপিল বিভাগের রায়ে বিচারপতিগণ স্বাক্ষর করেছেন। এটিএম আজাহারের খালাসের রায়ের কপি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পৌঁছেছে। পরে খালাসের আদেশ ট্রাইব্যুনাল থেকে জেলখালায় পাঠানো হয়েছে।
আপিল বিভাগের চার পর্যবেক্ষণ ॥ জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলামের খালাসের রায়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। রায়ে সর্বোচ্চ আদালত চারটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন বলে সাংবাদিকদের জানান আইনজীবী শিশির মনির। এগুলো হচ্ছেÑ অতীতের রায়ে বাংলাদেশসহ এই ভারতীয় সাব কন্টিনেন্টে ক্রিমিনাল বিচার ব্যবস্থার পদ্ধতি চেঞ্জ করে দেওয়া হয়েছিল, এটা ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। আদালতের সামনে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ অ্যাসেসমেন্ট করা ছাড়াই আজহারুল ইসলাম সাহেবকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি travesty of truth অর্থাৎ বিচারের নামে অবিচার। যে সমস্ত তথ্য-প্রমাণ আদালতে হাজির করা হয়েছিল, অতীতের আপিল বিভাগ তা সঠিকভাবে বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
রায় ঘোষণার পর আইনজীবী শিশির মনির তার প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজকের এই রায়ের মাধ্যমে আমরা মনে করি সত্য জয়ী হয়েছে, মিথ্যা পরাজিত হয়েছে। ইতোপূর্বে জামায়াতের এবং বিএনপির ছয় শীর্ষস্থানীয় নেতার মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্তত পক্ষে পাঁচজন জেলে মৃত্যুবরণ করেছেন। যেটা দুনিয়ার ইতিহাসে নজিরবিহীন নির্যাতনের শামিল। তিনি আরও বলেন, ‘এটিএম আজহারুল ইসলাম সৌভাগ্যবান, তিনি ন্যায় বিচার পেয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বলে। আমরা মনে করি, এই রায়ের মাধ্যমে সিন্ডিকেটেড ইনজাস্টিজের অবসান হয়েছে।
আমরা এটাও মনে করি এই রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের আদালতের মর্যাদা সমুন্নত হয়েছে।’
মঙ্গলবার রায় ঘোষণার সময় রাষ্ট্র ও আসামি উভয় পক্ষের আইনজীবী, জামায়াতের শীর্ষ নেতা ও তাদের দলীয় আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন। সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে সাত বিচারপতি এজলাসে ওঠেন। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম আইনি বিষয় তুলে ধরেন। এরপর রায় ঘোষণা শুরু হয় ৯টা ৫৫ মিনিটে।
এর আগে, গত ২২ এপ্রিল এটিএম আজহারুলের করা আপিল পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ৬ মে দিন ধার্য করা হয়। ধার্য তারিখে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। ৬ মে আপিলকারীর পক্ষে আইনজীবী শুনানি করেন। শুনানি নিয়ে সেদিন আপিল বিভাগ ৮ মে দিন রাখেন। এর ধারাবাহিকতায় সেদিন শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগে রায়ের জন্য ২৭ মে দিন রাখেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদ- দিয়ে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আপিল করেন তিনি।
এই আপিলের ওপর শুনানি শেষে আজহারুলের মৃত্যুদ- বহাল রেখে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগ রায় দেন। ২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করেন আজহারুল ইসলাম। এই পুনর্বিবেচনার আবেদনের শুনানি শেষে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি লিভ মঞ্জুর করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। সেই সঙ্গে পাশাপাশি দুই সপ্তাহের মধ্যে আপিলের সংক্ষিপ্ত সার জমা দিতে বলা হয়। পরে আপিলের সংক্ষিপ্ত সার জমা দেওয়া হয়। এই আপিলের ওপর শুনানি শেষে মঙ্গলবার রায় ঘোষণা করা হয়।
আজহারুল ইসলামের খালাসের রায়ে আপিল বিভাগ বলেছেন, বস্তুগত প্রমাণ এবং দাখিল করা আইনি যুক্তিতর্ক পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্মূল্যায়নের পর, আপিল বিভাগ বিবেচনা করছে যে, এটিএম আজহারুল ইসলামকে দোষী সাব্যস্ত করা ছিল ছিল ফৌজদারি আইন শাস্ত্রের মৌলিক নীতিগুলোর প্রতি স্পষ্ট অবজ্ঞা, যার ফলে ন্যায়বিচারের চরম অবহেলা ঘটেছে। মঙ্গলবার বিকেলে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদসহ ৭ বিচারপতির স্বাক্ষরে তিন পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ করা হয়।
রায়ে আদালত বলেন, আগের রায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বৃহত্তর প্রেক্ষাপট এবং রাষ্ট্রপক্ষের মামলার অন্তর্নিহিত প্রমাণের দুর্বলতাগুলোর প্রতি যথাযথ বিবেচনা করা হয়নি। তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে এটিএম আজহারুল ইসলামকে দোষী সাব্যস্তকরণ এবং তার সাজা বহাল রাখা সম্ভব নয়। আদালত আরও বলেন, আপিলকারী এটিএম আজহারুল ইসলামকে সমস্ত অভিযোগ থেকে খালাস ও অবিলম্বে জেল হেফাজত থেকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো।
রায় মেনে নিয়েছে প্রসিকিউশন ॥ এটিএম আজহারের খালাসের রায় মেনে নিয়েছে প্রসিকিউশন। রায় ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়া জানান ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর মোনাওয়ার হুসাইন (এমএইচ) তামীম। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে আমরা রায় গ্রহণের জন্য আপিল বিভাগে উপস্থিত ছিলাম। একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক প্রদত্ত কোনো রায়ের ব্যাপারে মন্তব্য করাকে আমি আইনসিদ্ধ মনে করি না। তবে আমরা শুনানিতে যে প্রসঙ্গে কথা বলেছিলাম, আজকের এই রায়ে আমরা তারই প্রতিফলন দেখতে পেয়েছি।
রায় শুনতে নেতৃবৃন্দ ॥ এটিএম আজহারুল ইসলামের রায় ঘোষণার সময় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাসুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসেন, মাওলানা আব্দুল হালিম, অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান, মাসুদ সাঈদী, জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তরে আমির মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের নায়েবে আমির ড. হেলাল উদ্দিন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহকারী সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ।