
ছবি: জনকণ্ঠ
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় যে প্রশ্নটি নীরবে ঘুরপাক খাচ্ছে তা হলো—নির্বাচন যদি পিছিয়ে যায়, কে বেশি লাভবান হবে এবং কে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে? আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে, সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে জামায়াতে ইসলামী।
এই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে কোনো নির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য নেই, তবে দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা থেকে আমি এই মূল্যায়নে এসেছি।
বিদেশি শক্তির দৃষ্টিভঙ্গি: ইসলামিস্টদের নিয়ে উদ্বেগ
বাংলাদেশে সক্রিয় বিদেশি স্টেকহোল্ডাররা, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্ব, নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসবে, তত বেশি গুরুত্ব দেবে রাজনৈতিক ভারসাম্যে। তাদের অন্যতম অঘোষিত লক্ষ্য থাকবে—ইসলামপন্থী রাজনীতির উত্থান ঠেকানো। বিশেষ করে গাজায় চলমান মানবিক সংকট ও ঐ অঞ্চলে পশ্চিমা ভূমিকায় যে গ্লানির ছাপ আছে, তা থেকে একটি প্রতিক্রিয়াশীল মনোভাব গড়ে উঠেছে ইসলামিস্ট রাজনীতির প্রতি।
জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলোকে ঠেকানো হয় অনেক সময় সরাসরি নয়, বরং কৌশলগতভাবে। যেমন, বিদেশিরা রাজনৈতিক বার্তায় ইসলামপন্থীদের কথা আকারে-ইঙ্গিতে তুলে ধরেন, অথচ আওয়ামী লীগ বা বিএনপির প্রসঙ্গে সরাসরি আলোচনা হয়।
ইসলামপন্থীদের অর্গানাইজেশনাল দুর্বলতা
জামায়াতে ইসলামী এখনো তাদের রাজনৈতিক পরিচয় ও লক্ষ্য নিয়ে দ্বিধায় আছে। তারা কি কেবল একটি রাজনৈতিক দল, নাকি একটি সামাজিক আন্দোলন—এ প্রশ্নের উত্তর এখনো সুস্পষ্ট নয়। সকালবেলা তারা রাজনৈতিক দল, আর রাতবেলা হয়ে ওঠে ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠন। এর ফলে তাদের নেতার কৌশল ও কর্মীর অনলাইন ভূমিকার মধ্যে সামঞ্জস্যের ঘাটতি থাকে।
একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, জামায়াতের নেতৃত্ব ও মাঠপর্যায়ের সংগঠন এখনো পরস্পরের সঙ্গে পুরোপুরি সংহত নয়। ফলে জাতীয় রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করা তাদের জন্য জটিল হয়ে দাঁড়ায়।
নারী ভোটার ও মিডল ক্লাসের মনস্তত্ত্ব
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীর ভোট একটি নির্ধারক ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে শহুরে ও তরুণ ভোটারদের মধ্যে নারীরা অত্যন্ত সচেতন। জামায়াতে ইসলামীর কোনো মেয়ে নেতা বা নারী প্রতিনিধি দৃশ্যমান নয়, যা তাদের একটি বড় সীমাবদ্ধতা।
একজন পশ্চিমা কূটনীতিকও আমাদের এক আলোচনায় প্রশ্ন করেছিলেন, জামায়াতের সঙ্গে আলোচনায় কোনো নারী প্রতিনিধির উপস্থিতি ছিল কি না। বাস্তবতা হলো, শহরাঞ্চলে বা মধ্যবিত্তদের মধ্যে এই বিষয়টি একটি শক্ত বার্তা দেয়। বিশেষ করে জেনারেশন-জি এর নারীরা রাজনীতিতে নারী প্রতিনিধিত্বকে একটি প্রাথমিক শর্ত হিসেবে দেখে।
মিডল ক্লাসের মনস্তত্ত্ব আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই শ্রেণিটি চায় নেতৃত্ব এমন কারো হাতে থাকুক, যিনি স্বাস্থ্যবান, ইংরেজি জানা, প্রমিত বাংলায় কথা বলতে সক্ষম ও আত্মবিশ্বাসী। জামায়াতে ইসলামী এখনো এই ধরণের নেতৃবৃন্দ গড়ে তুলতে পারেনি।
জামায়াতের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ
এই নির্বাচনে জামায়াতের একটি বিশেষ সুযোগ ছিল—আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে ১৯৭১ ও যুদ্ধাপরাধের প্রসঙ্গ তুলনামূলকভাবে অনুপস্থিত। অথচ এটাই তাদের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি দুর্বল জায়গা।
তবে, জাতীয় পর্যায়ের নেতার অভাব এখনো একটি বড় সমস্যা। প্রয়াত নিজামী, গোলাম আজম বা কামারুজ্জামান সাহেবের মতো জনপ্রিয় বা পরিচিত মুখ এখন দলটিতে নেই। শফিকুর রহমান সাহেব একজন সিনিয়র নেতা হলেও, তার গ্রহণযোগ্যতা জাতীয় পর্যায়ে সীমিত।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তাদের সাংগঠনিক পুনর্গঠন, নারী ভোটারদের আস্থা, অর্জন এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির সঙ্গে কার্যকর সংযোগ স্থাপনের ওপর।
তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো—নির্বাচন পেছালে দলটি বিদেশি চাপ, অভ্যন্তরীণ দ্বিধা এবং সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমি মনে করি, জামায়াতে ইসলামী চাইলে এখনো সময় আছে—তাদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করা, তরুণ ও নারী নেতৃত্বের উত্থান ঘটানো, এবং বাস্তববাদী কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে তারা জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের ভূমিকা পুনঃনির্ধারণ করতে পারে।
আবীর