
রওশন এরশাদ ও জি. এম. কাদের
জাতীয় পার্টির পাহাড় প্রমাণ বরফ গলতে শুরু করেছে। দেবর-ভাবির দূরত্ব অনেকটা কমে এসেছে। সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন দলটির চেয়ারম্যান ও বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে তাদের সাক্ষাৎ হয়।
তারা এসময় নিজেদের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝি দূরে সরিয়ে এক টেবিলে নাস্তা করেন। সবার প্রশ্ন, এবার কি জাপা ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে? জাতীয় পার্টির ভেতরের এই দূরত্ব কমাতে তৃতীয় পক্ষ কাজ করছে বলে জানা গেছে। এদিকে ‘জিএম কাদেরের জাতীয় পার্টি চালাতে বাধা নেই’ বলে আদেশ প্রদান করেছেন হাইকোর্ট।
এদিকে জাতীয় পার্টির দুর্গ বলে পরিচিত রংপুরের সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছেন রওশন এরশাদ। এর ফলে জিএম কাদের গ্রুপের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। গত সোমবার আসন্ন রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী হিসেবে মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার নাম ঘোষণা করেন রওশন এরশাদ। রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি এই ঘোষণা দেন।
মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১০টায় রাজধনীর ওয়েস্টিন হোটেলে দুই নেতার মধ্যে প্রায় এক ঘণ্টার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জানা গেছে, এই দুই নেতার সাক্ষাতের সময় জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু, রওশন এরশাদের ছেলে সাদ এরশাদ ও তার স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু বলেন, অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে তাদের দুজনের সাক্ষাৎ হয়েছে। তারা এক টেবিলে বসে নাস্তা করেছেন।
সেখানে শুধু তাদের পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। মা-ছেলে যেভাবে থাকে, তারাও সেভাবে আছেন। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি দলের অভ্যন্তরেই ঝামেলা থাকে। তবে রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের মধ্যে কোনো দূরত্ব ছিল না। তারা সব সময় এক সঙ্গেই ছিলেন। আসলে জিএম কাদের দলকে একটা ভালো জায়গায় নিয়ে গেছেন।
গত রবিবার দুপুরে প্রায় ৫ মাস পর থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে আসেন রওশন এরশাদ। এখন রাজধানীর একটি হোটেলে অবস্থান করছেন তিনি। অবশ্য এর আগে সোমবার রওশন এরশাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন জিএম কাদের। বৈঠকে রওশন এরশাদকে উদ্দেশ করে জিএম কাদের বলেন, ‘আমরা মিলেমিশে কাজ করি। আপনার নামে বিভিন্ন জেলা কমিটি হচ্ছে। এতে করে জনগণের মাঝে ভুল মেসেজ যাচ্ছে। এর চেয়ে আমরা সমন্বয় করে দলটিকে এগিয়ে নিয়ে যাই।’
তবে জিএম কাদেরের এ প্রস্তাবে সাড়া দেননি রওশন এরশাদ। তিনি অবশ্য জিএম কাদেরের পারিবারিক খোঁজখবর নিয়েছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। এ বিষয় রওশন এরশাদের মুখপাত্র কাজী মামুন জানান, রওশন এরশাদের সঙ্গে জিএম কাদের সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন। এর আগে, গত রবিবার দুপুরে থাইল্যান্ডের বামরুনগ্রাদ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরেছেন রওশন এরশাদ।
ব্যাঙ্ককে চিকিৎসাধীন রওশন হঠাৎ ৩০ আগস্ট দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলন আহ্বান করে সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠান। বিজ্ঞপ্তি পাঠানোর পরদিনই জাপার সংসদীয় দলের সদস্যরা বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে রওশনকে সরিয়ে এই পদে জিএম কাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। দলের ২৬ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে রওশন এরশাদ ও তার ছেলে সাদ এরশাদ ছাড়া বাকি ২৪ জনই এই সিদ্ধান্তে একমত হন। এরপরই রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের সমর্থকদের মধ্যে বিরোধ বাড়তে থাকে।
রওশন এরশাদ দেশে ফেরার পর দুই গ্রুপই অনেকটা নমনীয় হয়েছে বলে জানা গেছে। তিনি দেশে ফেরায় তার অনুসারীরা অনেকটাই চাঙা হয়েছে। তেমনি চেয়ারম্যান জিএম কাদেরপন্থি প্রভাবশালী কয়েকজন নেতাও অবস্থান পরিবর্তন করে ভিড়েছেন রওশন এরশাদের দিকে। সব কিছু আঁচ করতে পেরে চেয়ারম্যান জিএম কাদের অনেকটা নমনীয় হয়েছেন।
অনুসারীদের হঠাৎ বাঁক বদলে জাতীয় পার্টিতে জিএম কাদেরের অবস্থান কিছুটা হলেও দুর্বল হয়েছে বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতা। তবে হাইকোর্টের আদেশের ফলে আবার জিএম কাদেরের সমর্থকরা অনেকটা চাঙাভাব দেখা যাচ্ছে।
সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা বলেন, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে আমরা দলের ঐক্য ধরে রাখব। এটা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরও চান। আমাদের দলের ঐক্য আগেও ছিল। কিছু লোক সেখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। আমি মনে করি, রওশন এরশাদ এবং জিএম কাদের একই সুতায় গাঁথা। এখানে কোনো বিভেদ নেই। দলের মধ্যে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল তা কেটে যাবে।
জিএম কাদেরের জাতীয় পার্টি চালাতে বাধা নেই ॥ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় পার্টির বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরের বিরুদ্ধে বিচারিক আদালতের আদেশ স্থগিত করেছে হাইকোর্ট। একই সঙ্গে রুল জারি করেছে আদালত। এ আদেশের ফলে চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন তার আইনজীবী। মঙ্গলবার বিচারপতি শেখ আবদুল আউয়ালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। আদালতে জিএম কাদেরের পক্ষে শুনানি করেন শেখ মুহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম।
গত ৪ অক্টোবর জাপা থেকে বহিষ্কৃত নেতা দলটির সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরের দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মামলা করেন। বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩১ অক্টোবর ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ আদালত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের দলীয় যাবতীয় কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞার অস্থায়ী আদেশ দেয়।
মোস্তফাকে রংপুর সিটি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী ঘোষণা ॥ আসন্ন রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী হিসেবে মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফার নাম ঘোষণা করেছেন বেগম রওশন এরশাদ। সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে আনুষ্ঠানিকভাবে তার নাম ঘোষণা দেন তিনি। দলের এবং বিরোধী দলীয় নেতার মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশীদ সংবাদ মাধ্যমকে এ তথ্য জানান।
জাতীয় পার্টি ৩শ’ আসনেই প্রার্থী দেবে- চুন্নু ॥ আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতার জন্য সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেন, দুটি দল সন্ত্রাসের পথে যাওয়ায় দেশের মানুষ এখন আতঙ্কে আছে। তারা মুক্তির জন্য জাপার দিকে তাকিয়ে আছে। মঙ্গলবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় ছাত্রসমাজের জাতীয় সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
আওয়ামী লীগ আর বিএনপি- দুই দলই দুর্নীতি, লুটপাট ও সন্ত্রাস করেছে মন্তব্য করে চুন্নু বলেন, দেশের মানুষ আজ তাদের ওপর বিরক্ত। মানুষ চায় না বিএনপি বা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় দেখতে। তারা তৃতীয় একটি দল চায়। সেই দল হচ্ছে জাতীয় পার্টি। মানুষ চায় জাপার জি এম কাদেরের নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাক। বাংলাদেশে পাঁচ কোটি মানুষ বেকার এমন তথ্য তুলে ধরে ছাত্রদের এই আয়োজনে তিনি বলেন, বেকারদের নিয়ে দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের কোনো চিন্তা নেই। তাদের চিন্তা ক্ষমতায় থাকা নিয়ে।
জাতীয় পার্টি কখনো ছাত্রসমাজকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি বানাবে না এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, হরতালের নামে ছাত্রসমাজকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে না জাপা। জাতীয় পার্টি কোনো জোটে নেই জানিয়ে চুন্নু বলেন, আমরা ৩০০ আসনেই নির্বাচন করতে প্রস্তুতি নিচ্ছি।