ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

১০ ডিসেম্বর ॥ তবে নাশকতা বা নৈরাজ্য করলে প্রতিরোধ

বিএনপিকে কৌশলে সামলাবে আওয়ামী লীগ

উত্তম চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:৩০, ১৭ নভেম্বর ২০২২

বিএনপিকে কৌশলে সামলাবে আওয়ামী লীগ

১০ ডিসেম্বর ঘিরে রাজনীতির উত্তেজনার পারদ এখন তুঙ্গে।

১০ ডিসেম্বর ঘিরে রাজনীতির উত্তেজনার পারদ এখন তুঙ্গে। ‘১০ ডিসেম্বরের দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার কথায়’, ‘সমাবেশে খালেদা জিয়া যাবেন’, ‘দেশে আসছেন তারেক রহমান’ বিএনপি নেতাদের মুখে এমন উস্কানিমূলক বক্তব্যের পর নড়েচড়ে বসেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে ঘিরে বিএনপির দুরভিসন্ধি রয়েছে- এমনটা ধরে নিয়েই ওইদিন পুরো মহানগরীতেই সতর্ক প্রহরা বলয় গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে দলটি। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ, মোড় এবং প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় নেতাকর্মীরা সতর্ক অবস্থানে থেকে ১০ ডিসেম্বর বিএনপিকে কৌশলে মোকাবিলার পরিকল্পনার ছক কষছে ক্ষমতাসীন দলটি।
পাল্টা কোনো কর্মসূচি না দিলেও কর্মসূচিকে ঘিরে অতীতের মতো নাশকতা কিংবা ধ্বংসাত্মক কোনো কর্মকা- দেখলে রাজপথেই পাল্টা প্রতিরোধের প্রস্তুতি চলছে ক্ষমতাসীন দলটিতে। ১০ ডিসেম্বর বিএনপি যেন রাজধানীতে খালি মাঠে গোল দিতে না পারে সেজন্য ওইদিন গোটা মহানগরীতেই দলের নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণ সতর্ক অবস্থান নিয়ে নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলতে চায়। বিএনপির কোনো উস্কানির ফাঁদে পা না দিয়ে বরং শান্তিপূর্ণ অবস্থানের মাধ্যমে ১০ ডিসেম্বর রাজপথে থেকেই বিএনপিকে মোকাবিলার প্রস্ততি চলছে দলটিতে। পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও ওইদিন কঠোর অবস্থানে থাকবে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, কর্মসূচিকে ঘিরে বিএনপি যাতে খালি মাঠে গোল দিতে না পারে, সেদিক লক্ষ্য রেখেই ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে জনসমাবেশ ছাড়াও ওইদিন মহানগরীতে আলাদা সমাবেশের চিন্তা-ভাবনা রয়েছে দলটিতে। পাশাপাশি ঢাকা মহানগরীর প্রতিটি থানা-ওয়ার্ডের মোড়ে মোড়ে নেতাকর্মীদের নিয়ে শান্তিপূর্ণ সতর্কাবস্থানে থাকতে বলা হচ্ছে দল ও সহযোগী-ভাতৃপ্রতিম সংগঠনকে। ঢাকা মহানগর ও সহযোগী-ভাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতারা বলছেন- বিএনপি শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করলে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তাদের কোনো উস্কানিতেও পা দেবে না আওয়ামী লীগ। তবে সমাবেশের নামে নাশকতা, আগুন-সন্ত্রাস বা দেশকে অস্থিতিশীল করার কোনো চেষ্টা করা হলে তা প্রতিহত করা হবে।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন, বিএনপিকে আর আগুন নিয়ে খেলতে দেয়া হবে না। বিএনপি আবার আগুন নিয়ে খেলতে চাইলে তা জনগণ প্রতিহত করবে। ডিসেম্বর মাসজুড়ে আমাদের মাঠে থাকতে হবে। ডিসেম্বর মাসজুড়ে ভোট চোর, দুর্নীতিবাজ এবং জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে খেলা হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে খেলা হবে।

বিএনপির ফাঁকা বুলিতে আওয়ামী লীগ ভয় পায় না। আমরা জানি, এর পরই বিএনপি এ ব্যর্থতা ঘুচাতে তাদের স্বভাবজাত সন্ত্রাসের পথে ফিরে যাবে। তবে আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, যে কোনো পরিস্থিতিতে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ১০ ডিসেম্বরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপির মধ্যম সারির কয়েক নেতার উস্কানিমূলক বক্তব্যে উত্তেজনায় পারদ চড়িয়েছে। গত ৮ অক্টোবর রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এক আলোচনা সভায় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক ডাকসু ভিপি আমানউল্লাহ আমান বলেন, আগামী ১০ ডিসেম্বরের পরে দেশ চলবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের কথায়।

এর একদিন পর দলটির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি লক্ষ্মীপুরের দলীয় কর্মসূচিতে বলেন, শীঘ্রই তারেক রহমান দেশে আসবেন। তার পরদিন দলের চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ হবে ‘আটলান্টিক মহাসাগরের’ মতো। এই সমাবেশে খালেদা জিয়া যাবেন।
এসব উস্কানিমূলক বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশের পর ১০ ডিসেম্বর মহাসমাবেশকে ঘিরে বিএনপির স্পষ্ট দুরভিসন্ধি রয়েছে- এমনটা মনে করেই নড়েচড়ে বসেছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলটির নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে- বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কোথাও বাধা দেয়নি আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিএনপির নেতাদের বক্তব্যেই বেরিয়ে এসেছে, ১০ ডিসেম্বরের কর্মসূচিকে ঘিরে বিএনপি দেশকে অস্থিতিশীল এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নানা ধরনের নাশকতামূলক কর্মকা- চালাতে পারে।

বিএনপি মহাসচিব তাদের নেতাদের এমন বক্তব্যে প্রতিবাদ না করায় প্রমাণ করছে যে, আমান-এ্যানি-ফারুকের এসব বক্তব্যের সঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির শীর্ষ নেতাদেরও সমর্থন রয়েছে। এ কারণেই ১০ ডিসেম্বর বিএনপি যেন রাজধানীতে খালি মাঠে গোল দিতে না পারে সেজন্য ওইদিন গোটা মহানগরীতেই সতর্ক প্রহরা বলয় গড়ে তুলবে ক্ষমতাসীন দলটি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাকও বিএনপির উদ্দেশে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে বলেছেন, বিএনপি সমাবেশের নামে কোনো ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করলে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের যে পরিণতি হয়েছিল, এর চেয়েও খারাপ পরিণতি ভোগ করতে হবে। রাজনৈতিকভাবে যত হুমকি আসুক জনগণকে নিয়ে আমরা সেটা মোকাবিলা করব।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ ডিসেম্বর ঘিরে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচির ছক তৈরি করছেন। দলীয় হাইকমান্ডের সবুজ সঙ্কেত পেলেই চূড়ান্ত হবে এসব কর্মসূচি। ইতোমধ্যে ঢাকা উত্তর আওয়ামী লীগ ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। তবে এ কর্মসূচি বিএনপির কর্মসূচির আশপাশে না করে আলাদাভাবে দূরে কোথাও করার কথা ভাবছেন তারা। এ বিষয়ে এখনো কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কোনো নির্দেশনা পায়নি সংগঠনটি।
জানা গেছে, প্রাথমিক পরিকল্পনায় ১০ ডিসেম্বর সকাল থেকেই বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থান নিতে পারে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। এছাড়া ঢাকার প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী ও উত্তরাতেও জনসমাগমের কথা ভাবা হচ্ছে। আর ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উত্তর ও দক্ষিণ দুই অংশেরই প্রতিটি থানা-ওয়ার্ডগুলোর মোড়ে মোড়ে সংঘর্ষ এড়িয়ে শান্তিপূর্ণ সতর্কাবস্থানের পরিকল্পনাও রয়েছে ক্ষমতাসীন দলটির। ইতোমধ্যে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ ঢাকার মূল প্রবেশপথগুলোর একটি সাভারে বড় জনসভা করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১০ ডিসেম্বর ঘিরে তারা এখনো কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ থেকে কোনো নির্দেশনা পায়নি। তবে উত্তর ও দক্ষিণে ওইদিন শান্তিপূর্ণ দুটি সমাবেশের প্রস্তুতি তাদের রয়েছে। তবে অবশ্যই তা বিএনপির কর্মসূচি থেকে অনেক দূরে। আর বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের মাসব্যাপী কর্মসূচি রয়েছে। আর ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর প্রতিটি থানা-ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ নেতারা সতর্ক অবস্থানে থাকবেন। তবে বিএনপি যদি ওইদিন সন্ত্রাস- নৈরাজ্য করতে চায়, তাহলে জনগণকে নিয়ে তা প্রতিহত করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মূল দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগী-ভাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোও ১০ ডিসেম্বর ঘিরে নানা প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা মহানগর এবং ঢাকা আশপাশের জেলা শাখাগুলোর নেতাকর্মীরা ওই দিন সতর্কাবস্থানে থাকবেন। যুবলীগ, ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগসহ অন্যান্য সংগঠনও ১০ ডিসেম্বর প্রতিটি থানা-ওয়ার্ডে সকাল থেকেই সতর্ক অবস্থানে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
জানা গেছে, ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশ ঘিরে সব ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুরো মহানগরীতেই সতর্ক অবস্থানে থাকবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও। সমাবেশের ক’দিন আগে থেকেই বাস, লঞ্চ টার্মিনাল, রেলস্টেশনসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি ১০ ডিসেম্বরে রাজধানীতে তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনি গড়ে তুলতে প্রস্তুতি চলছে পুলিশ বাহিনীতে।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, সমাবেশস্থল ছাড়াও বিভিন্ন কেপিআই পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হবে। বাড়ানো হবে টহল ডিউটিও। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে পুলিশ প্রথমে ধৈর্য ধারণ করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে। তবে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে কঠোর অ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। রাজনৈতিক সমাবেশকে ঘিরে কেউ যাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে, সে বিষয়ে পুলিশ সদস্যরা পরিকল্পনা মাফিক কাজ করছে।

×