
ছবি: সংগৃহীত
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন অনেক ভিডিও ভাইরাল হচ্ছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে দুর্ঘটনায় ঝলসে যাওয়া বা মারাত্মক আহত শিশুদের ভিডিও কেউ একজন ধারণ করছে। কখনও দেখা যায় হাসপাতালের বিছানায় কাতরানো শিশুকে ভিডিও করা হচ্ছে, কখনও আবার আগুনে পোড়া মুখে কান্না করা ছোট্ট শিশুটিকে সামনে রেখে ক্যামেরার ফ্রেম ঠিক করা হচ্ছে। অনেক সময় এমন ভিডিওতে কান্নার শব্দ, সংবেদনশীল সাউন্ড ইফেক্ট কিংবা নাটকীয় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও যুক্ত করা হয়। প্রশ্ন হলো, এই ভিডিওগুলো কি সহানুভূতির জায়গা থেকে তৈরি করা হচ্ছে, নাকি এটি কেবল জনপ্রিয়তা, ভিউ আর লাইক পাওয়ার মানসিক বিকৃত প্রয়াস?
মানুষ যখন কারও কষ্টকে ব্যবহার করে নিজের লাভের জন্য উপস্থাপন করে, তখন তা এক ধরনের বিকৃতি। বিশেষ করে যদি সেই কষ্ট হয় একজন শিশু কিংবা নির্যাতিত কোনো মানুষের, তাহলে সেটা আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। শিশুরা খুব সংবেদনশীল, তারা কষ্টে থাকলে আমাদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত তাকে সাহায্য করা, তার পাশে দাঁড়ানো। অথচ এখন অনেক কনটেন্ট ক্রিয়েটর এই মানবিক কর্তব্যের আগে ক্যামেরা অন করেন। তারা চায় সেই শিশুটির মুখের কষ্ট, চোখের জল, শরীরের পোড়া অংশ যেন ভিডিওতে স্পষ্ট ফুটে ওঠে। যেন ভিউয়ারদের মন কেঁদে উঠে, আর তারা শেয়ার বা রিয়্যাক্ট করে। এটা এক ধরনের অমানবিক ব্যবহার।
অনেকে যুক্তি দেন, এসব ভিডিও প্রকাশের ফলে অনেকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সাহায্য যদি দয়াকেন্দ্রিক বা লাইক-কমেন্ট নির্ভর হয়, তাহলে তা কতটা টেকসই? আর সাহায্যের জন্য ভিডিও করা হলে তা কি এমনভাবে করা যায় না, যাতে শিশুটির ব্যক্তিগত কষ্টকে এমন নগ্নভাবে তুলে না ধরা হয়? একটি শিশুর পোড়া মুখ সারাজীবনের জন্য তার পরিচয়ের অংশ হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র কিছু মানুষের ক্যামেরার লোভের কারণে। তার সম্মতির তো প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি তার পরিবারও অনেক সময় জানে না ভিডিওটি কে করছে, কোথায় পোস্ট করছে।
এই প্রবণতা শুধু অসুস্থ মানসিকতারই প্রমাণ নয়, এটি আমাদের সমাজের এক ভয়ঙ্কর দিকও প্রকাশ করে। আমরা সহানুভূতি প্রকাশের বদলে ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে ‘মোবাইল জুম’ করি। আমরা সাহায্য করতে পারি, পাশে দাঁড়াতে পারি, কিন্তু তার বদলে ‘কন্টেন্ট বানানো’কে বেশি গুরুত্ব দিই। এটি এক ধরনের বিকারগ্রস্ত মানসিকতা। এমন লোকদের অনেকেই হয়তো মনে করেন তারা ‘সচেতনতা’ তৈরি করছেন। কিন্তু সত্যি যদি সচেতনতা তৈরি করতেই চান, তাহলে সেটা কি এতটা নির্মম আর অনাধিকার চর্চার মাধ্যমে হওয়া উচিত?
এইসব কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের কার্যক্রম শিশু অধিকার লঙ্ঘনের শামিল। শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য, তাদের নিরাপত্তা, তাদের সম্মান—এসব বিষয় আজ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। একটা শিশু তার পোড়া মুখ নিয়ে যখন বড় হবে, তখন হয়তো সেই ভিডিওগুলো সার্চ দিলে বেরিয়ে আসবে তার সেই দুর্দিনের স্মৃতি। এটি কতটা নির্মম এবং চরম অপমানের বিষয় ভাবুন।
অন্যদিকে, প্ল্যাটফর্মগুলোও এই ধরনের কনটেন্ট ছড়িয়ে পড়তে দিচ্ছে। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক—সব জায়গাতেই দেখা যায় এমন কনটেন্ট লাখ লাখ ভিউ পাচ্ছে। যারা এইসব ভিডিও বানায়, তাদের মধ্যে কেউ কেউ কৌশলে ভিডিওর শেষে বিকাশ নম্বর বা সাহায্যের জন্য অ্যাকাউন্ট নম্বরও দিয়ে দেন। কে জানে, সেই টাকাও হয়তো সেই শিশুটির কাজে আসছে না, বরং যাচ্ছে ওই ভিডিওধারীর ব্যক্তিগত কাজে।
সমাজকে এখনই এই ব্যাপারে সোচ্চার হতে হবে। আইনপ্রণেতাদের উচিত শিশুদের ওপর এই ধরনের অনধিকার ভিডিওগ্রাফি বা কনটেন্ট তৈরি নিষিদ্ধ করা। এমন কর্মকাণ্ডকে কঠোরভাবে দমন না করলে ভবিষ্যতে আরো শিশুর জীবন শুধু দুর্ঘটনায় নয়, সামাজিক মিডিয়ার বাজারে বিক্রির মতো হয়ে উঠবে।
এই ধরনের ভিডিও যারা তৈরি করে, তারা কেবল কনটেন্ট ক্রিয়েটর না, বরং মানবিক অনুভূতিহীন এক শ্রেণির মানুষ, যাদের মানবতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এটি নিছক কনটেন্ট নয়, এটি এক ধরনের মানসিক বিকৃতি— যা সমাজকে ভেতর থেকে পঁচিয়ে দিচ্ছে। এই প্রবণতার অবসান না ঘটলে, আগামী প্রজন্ম আর নিরাপদ থাকবে না কোনো দুর্ঘটনার পর, এমনকি ক্যামেরার সামনেও।
লেখক:
সাব-এডিটর, দৈনিক জনকণ্ঠ
এম.কে.