
নতুন অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার হ্রাসের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত জনগণের জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই শ্রেণির মানুষের মধ্যে অনেকেরই পেনশন বা স্থায়ী কোনো আয়ের উৎস নেই, তাদের নিরাপদ বিনিয়োগের অন্যতম ভরসা ছিল সঞ্চয়পত্র। এখানে সুদ কমে যাওয়া মানেই তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, স্বাস্থ্যসেবা ও দৈনন্দিন খরচ মেটানোর সক্ষমতায় বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমানো হয়েছে আগামী ছয় মাসের জন্য। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন সুদহার হবে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদহারও কমানো হলো। এতে সামগ্রিকভাবে নতুন অর্থবছরের শুরু থেকেই চাপ বাড়বে মধ্যবিত্তের ওপর। বিশেষ করে যাদের পারিবারিক খরচের বড় একটি অংশ সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে আসে।
দেশে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের অধীন যত ধরনের সঞ্চয়পত্র রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিবার সঞ্চয়পত্র। এ সঞ্চয়পত্রে এত দিন সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ, এখন তা কমিয়ে করা হয়েছে ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ ইতোমধ্যেই হিমশিম খাচ্ছে। এখন ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হলো সঞ্চয়পত্রের মুনাফা হ্রাস! ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়া এ সিদ্ধান্তে রয়েছে পাঁচটি স্কিম। সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমানোর ফলে সুবিধাভোগীরা সঞ্চয়পত্রে টাকা বিনিয়োগ না করে ব্যাংকমুখী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে সরকার এ খাত থেকে ঋণ পাবে কম।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের বিপরীতে যেসব শর্ত রয়েছে, তার মধ্যে একটি সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ কমানো। সংস্থাটির শর্ত বাস্তবায়ন ছাড়াও সরকারের যুক্তি হতে পারে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমিয়ে বাজেটের ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংক ব্যবস্থায় তারল্য বাড়ানো। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই ঘাটতি মোকাবিলা বা শর্ত পূরণের দায় কেন বারবার সাধারণ জনগণের ওপর চাপানো হচ্ছে? যেখানে কর ফাঁকি, অপচয় ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধির রয়েছে নানা সুযোগ, সেখানে সঞ্চয়পত্রে হাত দেওয়া কতটা ন্যায্য? মনে রাখা প্রয়োজন, সঞ্চয়পত্র কেবল একটি আর্থিক উপকরণ নয়, এটি সাধারণ মানুষের সুরক্ষা বলয়ও। তাই এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা সময়ের দাবি। সরকারের উচিত হবে, একদিকে যেমন বাজেটের ভারসাম্য রক্ষা করা, অন্যদিকে তেমনি নাগরিকদের মৌলিক আর্থিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা। নীতিনির্ধারকদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা জনগণের আস্থা অর্জন করে এমন সিদ্ধান্ত নেবে, যা বাস্তবতা ও মানবিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
প্যানেল