ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

‘তোমার সাফল্য আমার হিংসা!’ – তরুণ সমাজে বাড়তে থাকা হিংসা ও মানসিক বিষণ্ণতা

সৈয়দ আমিনুল ইসলাম, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, ঢাকা

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ২৭ জুন ২০২৫; আপডেট: ২০:৫০, ২৭ জুন ২০২৫

‘তোমার সাফল্য আমার হিংসা!’ – তরুণ সমাজে বাড়তে থাকা হিংসা ও মানসিক বিষণ্ণতা

ছবিঃ সংগৃহীত

“বন্ধুটার নতুন আইফোন হলো, আর আমি এখনো সেই পুরনো সেটেই চালাচ্ছি।” “ওর জিপিএ-৫, আর আমার ৪.৩৩। আমার মা কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেল।” “ও ইউরোপে স্কলারশিপ পেল, আমি না বুঝেই ফেসবুকে লাভ রিয়্যাক্ট দিলাম।”

এগুলো নিছক কিছু বাক্য নয়, বরং তরুণদের ভেতরে জন্ম নিতে থাকা অদৃশ্য এক বিষ—ঈর্ষা ও নিজেকে অবমূল্যায়নের ব্যথা। আজকের সোশ্যাল মিডিয়া-নির্ভর সমাজে অন্যের সাফল্য যেন নিজের ব্যর্থতার আয়নায় রূপ নেয়। এ যেন এক নীরব মানসিক মহামারি।

সফলতার সংজ্ঞা কীভাবে পাল্টে গেল?

আগে যেখানে সফলতা মানে ছিল সততা, ধৈর্য আর পরিশ্রমের ফসল, এখন তা প্রায়শই নির্ধারিত হয় কতগুলো ছবি ভাইরাল হয়েছে, কার কজন ফলোয়ার আছে, কে কোথায় ভ্রমণে গেছে বা কার কী ব্র্যান্ডেড প্রোডাক্ট আছে—এসব দিয়ে।

আজকাল “সফল” মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় ইনস্টাগ্রামের স্টোরিতে, ইউটিউবের শর্ট ভিডিওতে কিংবা ফেসবুক পোস্টে। কিন্তু সেটার পেছনের লড়াই, হতাশা কিংবা অভ্যন্তরীণ ক্লান্তি আমাদের চোখে পড়ে না।

কেন বাড়ছে হিংসা ও বিষণ্ণতা?

তরুণদের মাঝে ঈর্ষা ও হতাশা বেড়ে যাওয়ার পিছনে রয়েছে কয়েকটি প্রধান কারণ:

(১) অতিরিক্ত তুলনা :
“সে কতদূর এগিয়েছে” – এই ভাবনা মানুষকে নিজের গন্তব্য ভুলিয়ে দেয়।

(২) দেখনদারি সংস্কৃতি :
অনেকেই জীবনের বাস্তব কষ্ট ঢেকে রাখে সাজানো সুখের পোস্টে।
অন্যরা ভাবে, “ওর জীবন নিখুঁত, আমারটা কেন নয়?” এর ফলে অন্যের হতাশার পরিমাণ বেড়ে যায়।

(৩) পরিবার ও সমাজের চাপ :
আত্মীয়দের মধ্যে অনেকেই বলে যেমন “তোমার বন্ধু তো ভালো বেতনে চাকরী করছে, তোমার কি অবস্থা?” এসব কথায় একজন তরুণ আরও ভেঙে পড়ে। 

(৪) নিজের লক্ষ্য না থাকা :
অনেকেই নিজে কী চায়, সেটা না ভেবে অন্যের সাফল্যকে লক্ষ্য বানিয়ে ফেলে। কেউ একজন ভালো কিছু করছে দেখে সেও মনে করে আমিও এটা করে সাফল্য অর্জন করব। এতে করে দেখা যায় নিজের পথ হারিয়ে ফেলে। 

পরিণতি কী?

হিংসার ফলে একজন ব্যক্তি তার নিজের লক্ষ্য হারিয়ে ফেলে। এছাড়াও

(১) আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা দেয়।
(২) বন্ধুত্বে ফাটল তৈরী হয়।
(৩) মানসিক চাপে সৃষ্টি হয়।
(৪) ডিপ্রেশন এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও তৈরী হয়।

সাইকোলজিস্ট কী বলছেন?

কথা হয় পাইনেল মেন্টাল হেলথ কেয়ার সেন্টারের কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট মো: আসাদুজ্জামান রাজু আকন এর সাথে। তিনি বলেন মূলত ১৮ থেকে ৩৫ বছর সময়টাকে তরুণ সময় বলা হয়। এই সময়টাতে বিভিন্ন রকম স্থানান্তর হয়। একটা ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করেছে। এখন নতুন চাকরি করতে হবে এই সময়টাতে তাদের একটা বিষন্নতা কাজ করে। অনেকের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা থাকে যেমন পরিবারের দায়িত্ব নিতে হবে এটা একটা বিষন্নতা তৈরী করে। আবার অনেকে মনে করে আমি কি পারব কিনা? অনেকের মধ্যে একটা হিংসা হয়। সহপাঠীদের মধ্যে অনেকে এগিয়ে আছে। এই হিংসাটা অনেকে জেদ হিসেবে নেয়। 

আসাদুজ্জামান রাজু আরও জানান, যারা আত্নহত্যা করে তাদের ৯২ থেকে ৯৫ শতাংশ জীবনে কোনো না কোনো সময় বিষন্নতায় ছিল। অতীতের অভিজ্ঞতাগুলো যেগুলো তাকে সবসময় খারাপ রাখে, সেগুলো যখন চিন্তা করে তখন দেখা যায় তার ভিতরে একটা বিষন্নতা কাজ করে এবং এই বিষন্নতার পরিমাণ যদি অনেক বেশি থাকে তখন তার শরীর এবং মন ভালো থাকে না। তখন তার কাছে মনে হয় সে সাহায্যহীন, তাকে সাহায্য করার জন্য কেউ নেই। মানসিক বিষন্নতা বয়স অনুযায়ী আলাদা হয়। কৈশোর এবং তরুণ বয়সীদের বিষন্নতার ধরণ সম্পূর্ণ আলাদা। তরুণদের ক্ষেত্রে, যখন জীবনের পরিবর্তনগুলো আসে তখনই তাদের বিষন্নতা তৈরী হয়। 

হিংসা ও মানসিক বিষণ্ণতা থেকে বাঁচার উপায় কী?

আমরা ঈর্ষা না করে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিতে পারি। 

(১) প্রথমত নিজের গন্তব্য নির্ধারণ করুন। অন্যের জীবন নয়, নিজের লক্ষ্যই গুরুত্বপূর্ণ। 

(২) কিছুদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম  থেকে দূরে থাকুন। এতে করে বিষন্নতা কিছুটা কমবে।

(৩) সফল মানুষদের গল্প জানুন, তুলনা নয়। কারণ তুলনা করলে তখন হতাশা বেড়ে যাবে। তারা কীভাবে পরিশ্রম করেছে, কিভাবে প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছে সেটা জানার চেষ্টা করুন।


এই সমাজ আমাদের ভালো থাকার প্রতিযোগিতায় ফেলেছে, কিন্তু শেখায়নি ভালোভাবে বাঁচার কৌশল। অন্যের সাফল্য আমাদের অনুপ্রেরণা হতে পারে, যদি আমরা তুলনা না করে শ্রদ্ধা করতে শিখি। সফলতা কখনোই নির্দিষ্ট কারো জন্য বরাদ্দ নয়। আজ যার সাফল্যে আপনি হিংসা করছেন, কাল আপনি নিজেই কারো অনুপ্রেরণা হয়ে উঠতে পারেন।

আলীম

×