ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

শান্তি ভঙ্গুর, যুদ্ধ কি অনিবার্য?

রমজান গাজী

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ২৭ জুন ২০২৫

শান্তি ভঙ্গুর, যুদ্ধ কি অনিবার্য?

ছবি: সংগৃহীত

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির পরও মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার পারদ কমছে না। বিশেষ করে, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংসের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মুখোমুখি অবস্থান বিশ্বব্যাপী নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

গত ১৩ জুন ইসরায়েলের এক আকস্মিক হামলার জবাবে যুক্তরাষ্ট্র ২২ জুনের মধ্যে চালায় “অপারেশন মিডনাইট হ্যামার”। এরপরই ট্রাম্প ‘পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি’ ঘোষণা করেন এবং এনবিসি নিউজকে জানান, এই যুদ্ধবিরতি ‘চিরকাল স্থায়ী হবে’ বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
এই ১২ দিনের সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র অত্যাধুনিক বি-২ বোমারু বিমান ও বাঙ্কার-বাস্টার বোমার সাহায্যে ইরানের তিনটি পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালায়। মার্কিন বাহিনীর দাবি অনুযায়ী, এই হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস হয়েছে।

এই হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে পাল্টা হামলা চালায়। তবে পরবর্তীতে ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ইউরেনিয়াম সরিয়ে নেওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। একই কথা বলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রীও। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও জানিয়েছে, তেজস্ক্রিয়তার কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্পষ্টভাবে জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে কোনো চুক্তি হয়নি এবং কোনো প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়নি। মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামলায় ইরানের কর্মসূচিতে সাময়িক বিলম্ব হলেও এটি তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে থামাতে সক্ষম নয়।

ইরান তার পরমাণু কর্মসূচিকে সার্বভৌম অধিকার মনে করে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মাঝেও তারা সামরিক সক্ষমতা বাড়িয়েছে। ২০২০ সালের পর তারা সফলভাবে সিজ্জিল ও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে, যা তাদের আঞ্চলিক ক্ষমতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

সম্প্রতি ইরানের পার্লামেন্ট এক খসড়া বিল অনুমোদন করেছে, যেখানে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (IAEA) সঙ্গে সব সহযোগিতা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যদি না সংস্থাটি নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করে।

২৬ জুন এক টেলিভিশন ভাষণে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেন, "আমরা আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখি, এবং প্রয়োজনে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।" তার বক্তব্য ইরানের কৌশলগত শক্তির প্রকাশ।

যুদ্ধ শেষে ইরান অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিশেষ করে মোসাদ, সিআইএ এবং এমআই-৬ এর মতো সংস্থার কার্যক্রমের ওপর নজর দিচ্ছে। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় দুর্বলতা প্রকাশ পাওয়ায়, ইরান এখন রাশিয়ার কাছ থেকে উন্নত প্রযুক্তির এসইউ-৩৫ যুদ্ধবিমান সংগ্রহে আগ্রহী।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ইরানকে এনপিটি থেকে বেরিয়ে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সেটি হবে "সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি"। যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে আলোচনায় আনতে ৩০ বিলিয়ন ডলার ও নিষেধাজ্ঞা শিথিলের প্রস্তাব দিলেও ইরান তা প্রত্যাখ্যান করে, কারণ তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে আপোস করতে নারাজ।

বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, ইরানের কাছে থাকা ৪০০ কেজি ইউরেনিয়াম দিয়ে প্রায় ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি সম্ভব। যদি ইরান তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে, ইসরায়েলের জন্য এটি বড় হুমকি হয়ে উঠবে।

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শুধুই অস্ত্রের যুদ্ধ নয়, এটি আদর্শিক, ভূরাজনৈতিক এবং কৌশলগত দ্বন্দ্বেরও প্রকাশ। সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন ও গাজায় চলমান প্রক্সি যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

বিশ্ব আজ এক কঠিন প্রশ্নের সামনে—এই সংঘাত কি সরাসরি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেবে, নাকি কোনো কূটনৈতিক সমাধান বাস্তবায়িত হবে?

যুদ্ধ কখনোই স্থায়ী শান্তি আনে না, বরং ধ্বংস, শোক ও দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা ডেকে আনে। মধ্যপ্রাচ্য আজ দাঁড়িয়ে আছে সেই অনিশ্চয়তা ও দ্বন্দ্বের মোহনায়। আলোচনার পথ বন্ধ হলে, বোমার শব্দই কি হবে একমাত্র উত্তর?

রমজান গাজী
শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

 

ফারুক

×