ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৮ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

উত্তরবঙ্গের ইতিহাসদীপ্ত নীলফামারী

ড. জাহাঙ্গীর আলম সরকার

প্রকাশিত: ২০:১৬, ২৭ জুন ২০২৫

উত্তরবঙ্গের ইতিহাসদীপ্ত নীলফামারী

নীলফামারী- একটি নাম, যার উচ্চারণেই জেগে ওঠে উত্তরবঙ্গের হৃদয়ে জমে থাকা শতাব্দীর গল্প, নিঃশব্দে বলা ইতিহাস, আর এক জনপদের আত্মজাগরণের প্রতিধ্বনি। ইতিহাসের ভারী বইয়ের পাতায় নয়, বরং ধুলোমাখা পথঘাটে, মেঠো হাওয়ায়, কৃষকের ঘামে, কারিগরের নিপুণ হাতে, আর পূজা-পার্বণের ঘ্রাণে অঙ্কিত হয়েছিল এই জনপদের দীপ্ত পরিচয়। নীলফামারী শুধু একটি ভৌগোলিক পরিসর নয়- এটি এক সজীব জনপদ, এক স্বপ্নদ্রষ্টা সমাজের প্রতিচ্ছবি, যে সমাজ তার আপন বলয়ে গড়ে তুলেছিল এক ব্যতিক্রমী আঞ্চলিক পরিচয়।
উনবিংশ শতকের শেষভাগ থেকে বিংশ শতকের সূচনায়, যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ছায়া দেশের ওপর দীর্ঘতর হচ্ছিল, তখনো নীলফামারী নিজস্ব স্বর ও ছন্দে পথ খুঁজছিল। প্রশাসনিক বিন্যাসের কাঠামোতে বাধা হলেও এ অঞ্চল কখনো নিছক শাসনাধীন জনপদ হয়ে থাকেনি। বরং কৃষিনির্ভর জীবনের সাবলীল সুর, ধর্মীয় সহনশীলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, হস্তশিল্পের জ্যোতিষ্ক আর হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এটি হয়ে উঠেছিল উত্তরবঙ্গের ইতিহাসে এক দীপ্ত অধ্যায়। এখানকার বিস্তৃত ধানক্ষেত, পাটের খেত, নদীপথ, রেললাইন, জমিদার বাড়ি কিংবা প্রাচীন দুর্গ- সবকিছু মিলিয়ে যেন এক বহুমাত্রিক ক্যানভাস, যার প্রতিটি রেখা-রং ইতিহাসের গভীরতা ও আবেগে পূর্ণ। এই ভূখণ্ডের মাটির গন্ধে মিশে আছে মানুষের সংগ্রাম, আশা, অভিমান আর আত্মপরিচয়ের টানাপড়েন। নীলফামারী তাই শুধু কোনো সাব-ডিভিশনের নাম নয়। এটি এক জীবন্ত ইতিহাস, এক অনুচ্চারিত মহাকাব্য, যা উত্তরবঙ্গের আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিঃশব্দে, অথচ গভীরভাবে। এই লেখায় আমরা ফিরে তাকাব সেই শিকড়ের দিকে- যেখানে সময় থমকে থেকেছে, কিন্তু আত্মপরিচয়ের দীপ্তি কখনো নিভে যায়নি।
রংপুর জেলার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এই ভূখণ্ডের ইতিহাস নিছক পরিসংখ্যানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর প্রতিটি ধূলিকণা, নদীপথ, জনপদ ও স্থাপত্য নিদর্শন সাক্ষ্য দেয় এক দীর্ঘ ও গৌরবময় ঐতিহ্যের, যা যুগে যুগে উত্তরবঙ্গের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, রেল যোগাযোগ, কৃষিনির্ভর অর্থনীতি, শহরের বিকাশ এবং কারিগরি শিল্পের উন্মেষ-সব মিলে নীলফামারী এক প্রতিশ্রুতিময় অঞ্চলের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। ১৮৭৫ সালে মহকুমা হিসেবে যাত্রা শুরু করে এর সদর দপ্তর প্রথমে ছিল বাগডোগরায়। পরে, ১৮৮২ সালে, তা স্থানান্তরিত হয় বর্তমানে পরিচিত নীলফামারী শহরে। এই স্থানান্তর শুধু ভৌগোলিক নয়, বরং প্রশাসনিক বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক চিহ্ন হয়ে ওঠে।
শুরুতে নীলফামারী সাব-ডিভিশন তিনটি থানায় বিভক্ত ছিল- নীলফামারী, ডিমলা ও জলঢাকা। সৈয়দপুর ও ডোমার ছিল এই থানাগুলোর অধীন আউটপোস্ট। এই কাঠামো প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে সুসংগঠিত করে তোলে। এই অঞ্চলের উর্বর ভূমি কৃষিকাজের জন্য আদর্শ ছিল। তিস্তা নদী ও তার উপ-নদীগুলোর অববাহিকায় বিস্তৃত এই ভূখণ্ডে ধান, পাট, তামাক ও আদার উৎপাদন উল্লেখযোগ্য ছিল। পাট ও তামাক আন্তর্জাতিক বাজারেও পরিচিতি পায়, যা এই অঞ্চলের কৃষির গুরুত্বকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। ডিমলা এস্টেটসহ জমিদার পরিবারগুলো স্থানীয় অর্থনীতিতে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে। তাঁদের ভূমি মালিকানা যেমন কৃষি উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনি প্রশাসনিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও তাঁরা প্রভাব বিস্তার করতেন। শিল্প ও কারিগরি দক্ষতার ক্ষেত্রেও নীলফামারী ছিল অনন্য। গোমনাতি গ্রামের কাতরি মুসলমানদের তৈরি পিতলের পাত্র, ঝুননাগাছ চা পানির মাটির তৈজসপত্র এবং এঁদি অঞ্চলের রেশম ও চাট কাপড় লোকজ শিল্পসংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করে। এসব সামগ্রী শুধু স্থানীয় ব্যবহারে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং বাজারেও ছড়িয়ে পড়ে।
অর্থনৈতিক প্রবাহে গতি আনে পূর্ববঙ্গ স্টেট রেলওয়ের সৈয়দপুর-চিলাহাটি শাখা। এই রেলপথ যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করে তোলে, পাশাপাশি নতুন ভাবনা, বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক বিনিময়ের পথও উন্মুক্ত করে।
১৮৯১ সালে নীলফামারীর জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ লাখ ৫ হাজার, যা ১৯০১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৪ লাখ ৬ হাজার। প্রতি বর্গমাইলে গড় জনসংখ্যা ছিল ৭১২ জন, যা এই অঞ্চলের জনবসতির ঘনত্ব এবং কর্মসংস্থানের আকর্ষণকে নির্দেশ করে। ধর্মীয় গঠনেও এই জনপদ ছিল উদার ও সহনশীল। মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা প্রায় সমান ছিল এবং তারা পরস্পরের ধর্মীয় উৎসবে অংশ গ্রহণ করতেন। খ্রিস্টান জনগণ সংখ্যায় কম হলেও রেলওয়ে সংস্থার মাধ্যমে তাদের উপস্থিতি একটি বৈচিত্র্যময় সমাজ গড়ে তোলে। সেবামূলক অবকাঠামোতেও নীলফামারী অগ্রসর ছিল। স্থানীয় বোর্ডের অধীনে হাসপাতাল, পশু আটক কেন্দ্র, ফেরিঘাট এবং গ্রামীণ সড়ক নির্মাণের ব্যবস্থা ছিল। এগুলো শুধু যোগাযোগ নয়, জনজীবনের মানোন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখে।
প্রাচীন ইতিহাসের দিক থেকেও নীলফামারী ছিল ঐশ্বর্যময়। জলঢাকায় অবস্থিত ধর্মপাল রাজার দুর্গের ধ্বংসাবশেষ হিন্দু যুগের এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। পাল বংশের সেই প্রতাপশালী শাসকের নির্মিত এই দুর্গ ইতিহাসের এক নীরব স্বাক্ষর। নীলফামারী সাব-ডিভিশনের ইতিহাস তাই শুধুই কৃষি কিংবা প্রশাসনের ইতিহাস নয়। এটি এক যুগান্তকারী ঐতিহ্যের কাহিনী, যেখানে প্রাচীন সভ্যতা, জনপদের আত্মবিকাশ, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এবং ধর্মীয় সহাবস্থান একসূত্রে গাঁথা।
আজকের প্রজন্ম যখন প্রযুক্তির গতি ও গ্ল্যামারে অভ্যস্ত, তখন অতীত যেন ক্রমেই হয়ে উঠছে নিঃশব্দ-আলোহীন কোনো করিডর। অথচ সেই অতীতেই লুকিয়ে আছে আমাদের শিকড়, আত্মপরিচয়ের উন্মেষ ও একটি জাতির আত্মার নির্ভরযোগ্য ছায়া। নীলফামারীর ইতিহাস নিছক কিছু প্রশাসনিক পরিসংখ্যান কিংবা ভৌগোলিক মানচিত্রের তথ্য নয়- এটি এক জীবন্ত কাহিনী; যা যুগে যুগে সংগ্রামের শিখায় দীপ্ত হয়ে উঠেছে, সম্ভাবনার দীপ্তিতে উন্মীলিত হয়েছে, আর সংস্কৃতির ঐশ্বর্যে আপন মহিমায় উজ্জ্বল হয়েছে।
এই জনপদের ইতিহাস আমাদের শিখিয়ে দেয়- কীভাবে সীমিত সম্পদ, প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা এবং বহু ধর্ম-বর্ণের বৈচিত্র্যের মাঝেও একটি জনপদ নিজের স্বতন্ত্র চেহারা গড়ে তুলতে পারে। নীলফামারী শুধু উত্তরের এক প্রান্তিক জেলা নয়, বরং তা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক বিকাশের এক অনন্য প্রতীক। এ ইতিহাসে আছে মানুষের ঘাম, কষ্ট আর স্বপ্নের বিস্তার, যা অনুপ্রেরণার এক বিশুদ্ধ উৎস। সেই কারণেই, এই ইতিহাস যেন ধুলোমাখা ফাইলের পেছনে হারিয়ে না যায়। বরং আগামী প্রজন্মের হাতে হোক এই গৌরব গাঁথা; তাদের চেতনায় জাগরিত হোক এই উত্তরাধিকার। শিকড়কে জানার মধ্যেই ভবিষ্যতের স্থিতি, সঠিক পথচলা ও দায়িত্বশীল নাগরিকত্বের বীজ রোপিত হয়।
তাই নীলফামারীর ইতিহাস শুধু স্মরণ করার নয়- তা চর্চা করার, লালন করার এবং প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দেওয়ার। কারণ যে জাতি তার শিকড়কে ভালোবাসে, ইতিহাসকে শ্রদ্ধা করে- সে জাতি কখনো নিঃস্ব হয় না, পথ হারায় না। নীলফামারীর দীপ্ত অতীত সেই আলোকবর্তিকা, যা ভবিষ্যতের প্রতিটি পদক্ষেপে পথ দেখাতে পারে-  নিভৃতে, অথচ দৃঢ়ভাবে।
লেখক : আইনজীবী ও গবেষক
[email protected]

প্যানেল

×