
.
স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম রোধ এবং পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে একটি কলেজের পরীক্ষার্থীরা অন্য কলেজের কেন্দ্রে পরীক্ষা দেয়। এটি শিক্ষাবোর্ডগুলোর পরীক্ষা সংক্রান্ত বিধি-বিধান। চলমান এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ঢাকার কলেজগুলোতে এর ব্যত্যয় ঘটছে। কলেজ শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার কেন্দ্র পরিবর্তন হলেও নিজ কলেজের শিক্ষকরাই দায়িত্বে থাকছেন। এ নিয়ে পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বৃহস্পতিবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রথম দিন মীরপুর গার্লস আইডিয়াল কলেজে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পরীক্ষায় বিশেষ সুবিধা দিতে বিভিন্ন কলেজ কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষক অভিভাবকদের একটি সিন্ডিকেট বিভিন্ন কলেজে গড়ে উঠেছে বলেও অভিযোগ দীর্ঘদিনের। যে কারণে এবার সারাদেশের একাধিক কেন্দ্র বাতিল করেছে বোর্ড। তবে শিক্ষা বোর্ডের কিছু কর্মকর্তার বক্তব্য হলো- শিক্ষক সংকট তীব্র থাকায় একই কলেজের পরীক্ষার্থী ও পরীক্ষককে একটি কেন্দ্রে পাওয়া যাচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পরীক্ষক সংকট অজুহাতে অনেক কলেজ এই পন্থা অনুসরণ করছে। বিশেষ করে নামি বেসরকারি কলেজ ও স্বনামধন্য কলেজের এই প্রবণতা বেশি।
তথ্য-উপাত্ত ঘেটে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রথম দিন মীরপুর গার্লস আইডিয়াল কলেজ পরীক্ষা কেন্দ্রে শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজ, কমার্স কলেজ, গ্লোরি কলেজ, সরকারি সংগীত কলেজ, এমডিসি মডেল ইনস্টিটিউট, কল্যাণপুর গার্লস কলেজ, প্রাইম সিটি ইন্টারন্যাশনাল কলেজের পরীক্ষার্থীরা অংশ নিয়েছে। আবার কেন্দ্রের হল রুম পাহারা দিয়েছেন কল্যাণপুর গার্লস কলেজ, শহীদ স্মৃতি কলেজের শিক্ষকরা। যা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড। তবে এই অভিযোগের বিষয়ে মীরপুর গার্লস আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ ও কেন্দ্রসচিব মোস্তারী আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, জানি এমন নিয়ম নেই। কিন্তু ক্রাইসিস কাটাতেই যথাযথ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এসব কলেজ থেকে শিক্ষক নিয়ে আসা হয়েছে। যাথাযথ কর্তৃপক্ষ বলতে তিনি পরিচালনা পর্ষদ ও শিক্ষা বোর্ডের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা তা স্বীকার করেননি। উল্টো তদন্ত করে কেন্দ্র ও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।
এই পরীক্ষা কেন্দ্রের আসন বিন্যাস ও কক্ষ নির্দেশিকা ঘেটে দেখা যায়, কলেজ ভবনের দ্বিতীয় তলায় ২০১ নম্বর কক্ষে শহীদ স্মৃতি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের বালক শাখার পরীক্ষার্থীরা অংশ নেয়। ২০২, ২০৩, ২০৪ নম্বর কক্ষেও এই কলেজের পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসেছে। তৃতীয় তলার ৩০১, ৩০৩ নম্বর কক্ষেও একই কলেজের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসে। চতুর্থ তলার অনার্স ১১ কক্ষেও শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিয়েছে। অথচ এই কেন্দ্রের বিভিন্ন কক্ষে শহীদ স্মৃতি কলেজের অন্তত ১৩ শিক্ষক পরীক্ষক হিসেবে হলে ডিউটি করেছেন। এমনকি যেই কক্ষে নিজ কলেজের পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিয়েছেন, তার আশপাশের কক্ষেই তাদের ডিউটি দেওয়া হয়েছে। শহীদ পুলিশ স্মৃতি কলেজের হলের ডিউটি করা কয়েকজন শিক্ষকের নাম জানা গেছে। তারা হলেন, মো. আব্দুর রউফ, মো. শামিমুর রহমান, কাজী এমদাদুল হক, মেহেদী আল মাসুম, মো. রাইসুল ইসলাম, মো. শাইখুল ইসলাম প্রমুখ।
শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতেই কলেজ পরিবর্তন করে অন্যত্র পরীক্ষা দেয় পরীক্ষার্থীরা। এর ফলে প্রশ্নফাঁস, অসদুপায় অবলম্বন বা স্বজনপ্রীতির মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা কমে। এ ছাড়াও পরীক্ষায় নিরপেক্ষতা বজায় থাকে। তারা জানান, একই কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে এক ধরনের চেনাজানা বা সম্পর্ক থাকে, যা পরীক্ষার সময় অনৈতিক সুবিধা পাওয়ার কারণ হতে পারে। বাইরের কেন্দ্রে পরীক্ষা হলে এই সুযোগ কমে যায়। কিন্তু ওই কেন্দ্রে নিজ কলেজের শিক্ষকের আনাগোনা ও পরীক্ষক হিসেবে দায়িত্বপালন স্বচ্ছতার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ করে।
যশোর শিক্ষা বোর্ডে এবার এইচএসসিতে নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ বাদ দিয়েছে। নিজ প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অনিয়ম ও নকলের মহোৎসবে মেতে ওঠার অভিযোগ ছিল। এদিকে কেন্দ্র ভেন্যু বাতিল করায় যশোর শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও করেছে বিশেষ সুযোগসন্ধানী শিক্ষার্থী। কিন্তু বোর্ড কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দেয়, অনিয়ম ও নকলের মহোৎসব বন্ধে নিজ প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রে পরীক্ষার সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা নিজ প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দিতে পারবে না। এটি সুষ্ঠু পরীক্ষা নিশ্চিত করার জন্য একটি মৌলিক নিয়ম।
জানা যায়, শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা পরিচালনা বিধিমালায় পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন, কেন্দ্র কমিটি গঠন, শিক্ষক নিয়োগ, ডিউটি বণ্টন, প্রশ্নপত্র বিতরণ, উত্তরপত্র সংগ্রহ এবং সার্বিক পরীক্ষা ব্যবস্থাপনার সার্বিক বিষয় রয়েছে। কেন্দ্র প্রধান বা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে এবং তাদের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো, কীভাবে পরীক্ষা পরিদর্শকদের (শিক্ষক) ডিউটি বণ্টন করা হবে, যাতে কোনো অনিয়মের সুযোগ না থাকে। এরমধ্যে পরীক্ষকদের জন্য নিজ কলেজের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে ডিউটি না করার নিয়ম রয়েছে। শিক্ষা বোর্ডের নীতিমালায় পরীক্ষা কেন্দ্রে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পরীক্ষার্থীরা তাদের নিজ প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা দিতে পারে না এবং একইভাবে নিজ কলেজের শিক্ষকরাও তাদের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে ডিউটি করতে পারেন না। এতে অনিয়মের সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে, যা পরীক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের পরিপন্থি বলে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এস এম কামাল উদ্দিন হায়দার জনকণ্ঠকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষা কেন্দ্রে যে কলেজের পরীক্ষার্থীদের আসন থাকে সেখানে সেই কলেজের শিক্ষকরা দায়িত্বপালন করতে পারেন না। এই অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এটি যদি হয় তবে না বিধি পরিপন্থি। অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্যানেল