
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্য থেকে উপমহাদেশ, লেবানন থেকে লাক্ষাদ্বীপ— বিশ্বজুড়ে এক অদৃশ্য সূতায় গাঁথা হচ্ছে মুসলিমবিরোধী এক ভয়ঙ্কর ছক। যে ছককে কেউ বলছেন 'গ্রেটার ইসরায়েল', আবার কেউ বলছেন ‘অখণ্ড ভারত’। দুই ছকের আলাদা নাম হলেও লক্ষ্য অভিন্ন—মুসলমানদের ভূখণ্ড থেকে উচ্ছেদ, ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা, রাষ্ট্রহীন করে দেওয়া।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বরাবরই ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ ধারণার পক্ষে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একে একে ধ্বংস করা হয়েছে সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়া, আফগানিস্তান। এসব দেশকে লক্ষ্য বানিয়ে কখনো সরাসরি হামলা, কখনো গৃহযুদ্ধ, কখনো ড্রোন, কখনো ভাড়াটে বাহিনী— যেকোনো কৌশলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোকে দুর্বল, বিধ্বস্ত ও বিভক্ত করে তোলা হয়েছে।
সিরিয়ায় ২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধ এখনো থামেনি। গোটা দেশ ভাগ হয়ে গেছে, কোটি মানুষ উদ্বাস্তু। ইরাকে ‘মার্কিন স্বাধীনতা’ আনার নামে চালানো যুদ্ধ এক কোটি মানুষের জীবন থেকে শান্তি কেড়ে নিয়েছে। লিবিয়ায় কর্নেল গাদ্দাফিকে সরিয়ে ‘গণতন্ত্র’ দেওয়ার নামে দেশটিকে আজো বিশৃঙ্খলার মাঝে ফেলে রাখা হয়েছে। আফগানিস্তানে ২০ বছরের মার্কিন অভিযান শেষে সেখানে এখন কেবলমাত্র রক্ত, শোক আর ধ্বংসের স্মৃতি।
ফিলিস্তিন তো এক অন্য ইতিহাস। ৭৫ বছরের অধিক সময় ধরে একটি জাতিকে তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে, প্রতিদিন হত্যা করে, শিশুদের পর্যন্ত রেহাই না দিয়ে যে নিষ্ঠুর দখল চলছে, তা ইসরায়েলকে আজকের আগ্রাসী শক্তিতে পরিণত করেছে। এবার ইসরায়েল সরাসরি আঘাত হানল ইরানেও। পারমাণবিক কেন্দ্র, সামরিক ঘাঁটি, এমনকি আবাসিক এলাকাতেও চালানো হয়েছে হামলা। শত শত মানুষ নিহত, হাজারো আহত। তেহরানের আকাশে বারুদের গন্ধ, কাঁদছে মানুষ—এটাই যেন আজকের গ্রেটার ইসরায়েলের বাস্তবতা।
এই পরিকল্পনার পরবর্তী টার্গেট হতে পারে পাকিস্তান। নানা কৌশলে পাকিস্তানকে ঘিরে ফেলা হচ্ছে। চীন ও ইসলামাবাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরানোর চেষ্টা, বেলুচিস্তানে সন্ত্রাস ছড়ানো, কাশ্মীর ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলকে নিশ্চুপ রাখা— সব মিলিয়ে পাকিস্তানকে একঘরে করে তোলার প্রচেষ্টা স্পষ্ট।
আর এসব চক্রান্তে সবচেয়ে জোরালো সমর্থন যাচ্ছে ভারত থেকে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী সরকার বরাবরই ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ। নিরাপত্তা, প্রযুক্তি, অস্ত্র ও কৌশলগত দিক থেকে দুই দেশ এখন ‘প্রকাশ্য মিত্র’। গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যাকে সন্ত্রাসদমন হিসেবে বিজেপি-সমর্থক ভারতীয় নাগরিকদের নির্লজ্জ উচ্ছ্বাস যেকোনো সুস্থ ও বিবেকবান মানুষকে অবাক করে।
ভারতে গত এক দশকে ‘অখণ্ড ভারত’ গঠনের এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলতে শোনা গেছে নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির বিভিন্ন নেতাদের মুখে। এই পরিকল্পনায় ভারতের বর্তমান ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করার স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভূটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও মায়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত এক ‘হিন্দু রাষ্ট্র’-এর।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের কোটি কোটি মুসলমান হয়ে উঠবে সেই কথিত হিন্দু রাষ্ট্রের 'অবৈধ নাগরিক'। যারা কেবলই হবে একটি রাষ্ট্র-পরিচয়হীন জনগোষ্ঠী। আপাতদৃষ্টে মনে হয়, ভারতে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে সেই প্রস্তুতি। বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) ও জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকার (NRC) মাধ্যমে আসাম, উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গসহ বহু রাজ্যে লাখ লাখ মুসলমানকে সন্দেহভাজন নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ভারতে গুজরাত দাঙ্গার স্মৃতি এখনো তাজা। ২০০২ সালে সেই রাজ্যে ঘটে যাওয়া মুসলিম গণহত্যার নেপথ্যে ছিল রাজ্য সরকার ও উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর প্রত্যক্ষ ভূমিকা। আজ সেই রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদি নিজেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তার শাসনামলে উত্তরপ্রদেশে নিরীহ মুসলিমদের নানা অজুহাতে গণপিটুনি, মসজিদ ভাঙা, কোরআন পুড়িয়ে দেওয়ার মতো বহু ঘটনা ঘটেছে— যেগুলোর অধিকাংশই থেকে গেছে বিচারবহির্ভূত।
ভারতের ‘বন্ধু রাষ্ট্র’ মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর চালানো গণহত্যার সময়েও ভারত ছিল নীরব। বরং রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার পেছনে ভারতের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে আন্তর্জাতিক মহলে।
এই মুসলিমবিরোধী চক্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রও রয়েছে ‘সক্রিয়ভাবে নিস্ক্রিয়’। তারা ইসরায়েলের প্রতিটি হামলায় অস্ত্র সরবরাহ করে, কূটনৈতিক সুরক্ষা দেয়, কিন্তু মুখে ‘শান্তির বার্তা’ দেয়। কৌশলগত সহায়তার কথা বললেও মুসলিম গণহত্যা শুরু হলে চীন, রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেখেও না দেখার ভান করে চলে। বিশ্ব মানবতা তখন হয়ে যায় নির্বাক দর্শক।
সত্য হলো, এই মুহূর্তে মুসলিম বিশ্ব একটি দিকহীন জাহাজের মতো নেতৃত্বশূন্য, বিভক্ত, আত্মকেন্দ্রিক। তাই পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট ইসরায়েলের হাতে এখন মুসলিম ভূখণ্ডগুলো একের পর এক টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।
মুসলমানদের এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করা উচিত— আর কত দেশ হারালে আমরা জাগব? আর কত শিশু মরলে আমাদের হৃদয় কাঁদবে? আর কত মসজিদ গুঁড়িয়ে দিলে আমরা এক হব?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নেতানিয়াহুর ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ আর মোদির ‘অখণ্ড ভারত’— এই দুই প্রকল্প যেন আজ একে অপরের পরিপূরক। যাদের লক্ষ্য একটাই— পৃথিবী থেকে মুসলিমদের রাষ্ট্র, পরিচয়, মর্যাদা সবকিছু মুছে ফেলা।
ফলে, প্রতিরোধ, ঐক্য ও নেতৃত্ব এই তিন অস্ত্রই এখন মুসলিম উম্মাহর একমাত্র আশ্রয়। না হলে ইতিহাস শুধু স্মরণ করবে, একটা সময় ছিল, যখন মুসলমানরা একটার পর একটা ভূখণ্ড হারাত, কিন্তু প্রতিবাদ করত না।
লেখক: সাংবাদিক
এম.কে.