ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫, ৬ আষাঢ় ১৪৩২

ইতিহাসের তলোয়ারে আগুন: ইজরায়েল-ইরান যুদ্ধ কি তৃতীয় মহাযুদ্ধের ইশারা

জাহেদুল ইসলাম আল রাইয়ান

প্রকাশিত: ০৯:০৩, ২০ জুন ২০২৫

ইতিহাসের তলোয়ারে আগুন: ইজরায়েল-ইরান যুদ্ধ কি তৃতীয় মহাযুদ্ধের ইশারা

সংগৃহীত প্রতীকী ছবি

আকাশ আজ আগ্নেয়গিরির মতো বর্ণহীন, সময়ের হৃদপিণ্ডে বাজছে যুদ্ধের দামামা। একপাশে দাঁড়িয়ে পারস্যের গর্ব, অন্যপাশে জেরুজালেমের অস্তিত্ব-আতঙ্ক। ইতিহাস আবার শ্বাস নিচ্ছে ঘন বারুদের নিচে, আর মধ্যপ্রাচ্যের বুকে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন বেদনা—যার উৎস পুরনো, কিন্তু যার বিস্ফোরণ অভূতপূর্ব।

ইরান ও ইজরায়েল—দু'টি রাষ্ট্র নয়, যেন দুটি রণপিশাচ। একে অপরের অস্তিত্বকে মেনে নিতে পারে না। ধর্ম, জাতি, ভূ-রাজনীতি, সামরিক আধিপত্য—সব একে একে গিলে নিয়েছে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের সম্ভাবনা। এখন তারা শুধু পরস্পরের শ্বাসের শব্দে মৃত্যুর পূর্বাভাস খোঁজে।

এই দ্বন্দ্বের সূচনা ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবে। শাহের পতনে ইরান যখন আমেরিকার মিত্রতা ছিন্ন করে ধর্মীয় কর্তৃত্বের পথে হাঁটল, তখন থেকেই ইজরায়েলকে সে চিহ্নিত করল 'শয়তানের রাষ্ট্র' হিসেবে। এবং ঠিক তখন থেকেই শুরু হয় ছায়াযুদ্ধের এক দীর্ঘ অধ্যায়—যেখানে প্রতিটি গুপ্তচর একটি গল্প, প্রতিটি ড্রোন একেকটি অধ্যায়ের অঘোষিত ঘোষণা।

ইজরায়েল, যার জন্মই হয়েছে অস্তিত্বের আতঙ্কে, নিজের নিরাপত্তাকে কেবল আত্মরক্ষায় সীমাবদ্ধ রাখেনি—বরং প্রতিপক্ষের শ্বাস পর্যন্ত আটকে দেওয়ার কৌশল রপ্ত করেছে। আর ইরান? সে তো এক দীর্ঘস্থায়ী অবরোধের ভিতর থেকেও হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো গোষ্ঠীর মাধ্যমে বারবার প্রমাণ করেছে—তাদের হাত লম্বা, এবং তাদের ঘৃণা বিস্মরণবিহীন।

আর সেই ঘৃণার বিস্ফোরণ ঘটল ২০২৫-এর বসন্তে। ইজরায়েলের অতর্কিত স্ট্রাইকে ধ্বংস হয় ইরানের ‘ইস্পাহান’ পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রের গোপন শাখা। এ হামলা শুধু পরমাণু কর্মসূচির ওপর নয়—এ ছিল এক দেশজাতির অহংকারের বুকে ছুরি চালানো। এবং ইরান, কখনোই যে সরাসরি প্রতিশোধে গা ভাসাত না, এবার চালাল প্রতিপক্ষের আকাশসীমায় শত শত ড্রোন আর ক্ষেপণাস্ত্র—বিশ্ব বুঝল, যুদ্ধের রণসন্ধ্যা শুরু হয়েছে।

এই মুহূর্তে যুদ্ধের মঞ্চে কেবল ইজরায়েল ও ইরান নেই—আছে বহু শতকের অভিমান, বহু পরাশক্তির স্বার্থ। যুক্তরাষ্ট্র, যার চোখে ইজরায়েল একমাত্র 'অবিচল মিত্র'। রাশিয়া, যার হিসাব সবসময় বৈরিতা দিয়ে গোনা হয়। চীন, যাকে মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলার টানে, তবে পশ্চিমা আধিপত্য ভাঙাই যার চূড়ান্ত নীতি। আর ভারত, তুরস্ক, কাতার, সৌদি আরব—সবাই মঞ্চে না থেকেও নিজেদের চাওয়া অনুযায়ী ছায়া ফেলছে শত্রু-মিত্রের বিভক্ত পর্দায়।

এই যুদ্ধ ধর্মের ছদ্মবেশে শুরু হলেও আসলে এটি কূটনৈতিক বাণিজ্যের এক চরম রূপ। পেছনে লুকিয়ে আছে 'ডিপ স্টেট'-এর অদৃশ্য খেলোয়াড়রা। অস্ত্র ব্যবসায়ী, তেল কোম্পানি, সাইবার যুদ্ধের বরপুত্র, এবং সর্বোপরি পরাশক্তির ছায়া-সম্রাজ্য। এই যুদ্ধ যত না সীমান্তে, তার চেয়ে অনেক বেশি চলে ডেটাসেন্টার, গোয়েন্দা দপ্তর, কূটনৈতিক লবিতে।

তবে যে প্রশ্ন সবচেয়ে নির্মম—এই আগুন থামবে কোথায়?

এই প্রশ্নের জবাবে ইতিহাস নিরব। কারণ, ইতিহাস জানে—যে আগুন ধর্ম, তেল ও প্রতিশোধকে একত্র করে, তা নেভে না সভার প্রস্তাবে। তা থামে না শান্তির আহ্বানে। তা থামে শুধুই সর্বনাশে। এ যুদ্ধের ইতি এক নতুন সীমান্ত, নতুন শত্রু আর পুরোনো মৃত্যুর সংখ্যায় লেখা হবে। এবং তখন কেউ বলবে না 'কে ঠিক', সবাই বলবে, 'কে টিকে গেল'।

বিশ্ব কি তবে এক নতুন বিশ্বযুদ্ধের দিকে হাঁটছে?

হয়তো সে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে—শুধু কাগজে তার নাম এখনও লেখা হয়নি। গাজায় শিশুর কান্না, তেহরানে মায়ের আহাজারি, হাইফায় বেজে ওঠা অ্যালার্ম—সব মিলিয়ে যুদ্ধের গান এখন আর ব্যারাকে নয়, বাজছে বিশ্বমানবতার অন্তরে।

ইতিহাস আবার কলম তুলে নিয়েছে। প্রশ্ন একটাই—এইবার রক্তে লেখা হবে, না বিবেকে?

লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর

সাব্বির

×