ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৩ জুন ২০২৫, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

চট্টগ্রামের উন্নয়নে জরুরি সমন্বিত প্রচেষ্টা

ড. আলা উদ্দিন

প্রকাশিত: ১৮:০৪, ১ জুন ২০২৫

চট্টগ্রামের উন্নয়নে জরুরি সমন্বিত প্রচেষ্টা

চট্টগ্রাম দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহানগরী। যদিও এটি দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত, তবে এই বন্দর শহরটির উন্নত দেশের একটি বাণিজ্যিক রাজধানীর মতো প্রধান সুবিধা ও অবকাঠামো নেই। ক্রমাগত শহরের প্রাকৃতিক উপাদানগুলো ধ্বংস হচ্ছে। ফলে তা মৃতপ্রায় হয়ে পড়ছে। সত্যি বলতে, চট্টগ্রাম শহরটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য আধুনিক সুবিধার ক্ষেত্রে ঢাকার মিরপুর বা মতিঝিলের সমতুল্যও নয়। শিক্ষার মান এবং স্বাস্থ্যসেবার সুযোগের অভাবে নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান হ্রাস পাচ্ছে। 
চট্টগ্রাম শহরের হাজার বছরের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। তবে ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। নগরীটি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও বর্তমানে নাগরিক সুবিধা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, শতাব্দী প্রাচীন গাছ, খোলা জায়গা এবং পার্কগুলো একে একে উন্নয়নের নামে অর্থলুন্ঠন ও পাচারকারী সিন্ডিকেটের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। তারা যে বিষয়টি বুঝতে পারছে না তা হলো, দ্রুত উন্নয়ন, যা সবুজ প্রকৃতি ও খোলা স্থান ধ্বংস করে, তা টেকসই নয় এবং এটি জলবায়ু সম্পর্কিত বিপর্যয় সৃষ্টি করে। এর ফলে চট্টগ্রাম শহরটি ধীরে ধীরে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারাচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বড় ক্ষতি হতে পারে।
দুর্ভাগ্যবশত, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা চট্টগ্রামের সুবিধা ও নাগরিক সেবা সম্পর্কে শিক্ষিত ও নগর বিশেষজ্ঞদের সুপারিশকে গুরুত্ব দেয় না। ফলে চট্টগ্রামে গৃহীত বেশিরভাগ উন্নয়ন প্রকল্প সাধারণ মানুষের জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। প্রকল্পগুলো কেবল অবকাঠামোগত উন্নয়নকে কেন্দ্র করে নির্মিত হলেও এর সুফল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় না। রাজনৈতিক নেতৃত্বও চট্টগ্রামের টেকসই উন্নয়নের ব্যাপারে উদাসীন। যার কারণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব দেখা দিয়েছে। 
দুই-তিন দশক পূর্বেও সারা দেশের মধ্যে চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত শহর ছিল, যেখানে পাহাড়, প্রকৃতি, নদী-সমুদ্র, বন্দর সবই ছিল একাকার। কিন্তু আজ উন্নয়ন, অপরিকল্পনা, স্বেচ্ছাচারিতা, তাৎক্ষণিক ব্যবসাকেন্দ্রিক মনোবৃত্তি ইত্যাদি কারণে সারা দেশের মানুষ চট্টগ্রামের পরিণতি দেখে বিস্মিত। যারা এক সময় চট্টগ্রাম শহরে বড় হয়েছেন তারা বেড়াতে এসে শহরের বর্তমান দুর্দশায় ভীষণ হতাশা ব্যক্ত করেন। 
অবিরাম জলাবদ্ধতা, জনসাধারণের পরিবহন সমস্যা, খারাপ স্বাস্থ্যসেবা, পানি ব্যবস্থাপনা এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাগত সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে এই বন্দর শহরটিকে মানব বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। উদাহরণস্বরূপ, চট্টগ্রাম শিশুপার্ক (এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের পাশে) শিশুদের বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু এটি গত বছর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যা শিশুদের বিনোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানকে নিষ্ঠুরভাবে নষ্ট করেছে। তাছাড়া বিপ্লব উদ্যান, যা শহরের সাধারণ মানুষের জন্য বিকেল কাটানোর একমাত্র স্থান ছিল, সেখানে কয়েক বছর আগে দোকানপাট নির্মাণ করা হয়েছিল। বর্তমানে সেগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে এবং পার্কটিকে আরও বাণিজ্যিক করার পরিকল্পনা রয়েছে। এভাবে চট্টগ্রামে নাগরিক সুবিধা ও বিনোদনের স্থানগুলো ক্রমাগত সংকুচিত হয়েছে, যা শহরের জনগণের মানসিক ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
অনেক পাহাড় ও প্রকৃতি ধ্বংস করে উন্নয়ন-ব্যবসায়ীরা যেন ক্ষান্ত নন। কয়েক মাস আগে টাইগারপাস থেকে কদমতলীমুখী দ্বিতল সড়কের পাশে শত শত গাছ কেটে ফেলার জন্য চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই প্রকল্পের আওতায় নগরীর সৌন্দর্য এবং পরিবেশের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বিধায় নগরবাসী প্রতিবাদ জানিয়েছে। ফলে এই অপতৎপরতা আপাতত বন্ধ হয়েছে। এর আগে অনেক ব্যবসা কেন্দ্র, আবাসিক সুবিধা এবং আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণের জন্য পাহাড় কেটে ফেলা হয়েছে, যা চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিয়েছে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মূল্যবান নির্মম স্মৃতিচিহ্ন বধ্যভূমিও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিয়েছে, যা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। আদালতে রিট হয়েছে, বধ্যভূমির পক্ষে রায় হয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন সুদূরপরাহত। তিন বছর পূর্বে নগরীর ফুসফুসখ্যাত সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের অপচেষ্টা ছিল। প্রায় এক বছর ধরে নাগরিক সমাজের বিরোধিতার মুখে তা বন্ধ হয়েছে। তবে আবার কখনো এমন পরিবেশবিনাশী প্রকল্প উদ্গত হয় কি না সে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।  
এভাবে চট্টগ্রামের পাহাড়, গাছ, খোলা মাঠ এবং প্রকৃতিকে দখল ও ধ্বংস করার প্রবণতা চলছে শত প্রতিবাদ সত্ত্বেও। যদি এই ধারা অব্যাহত থাকে তবে চট্টগ্রাম শীঘ্রই তার ঐতিহ্যবাহী প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সবুজ পাহাড়ি জনবসতি থেকে ইট-পাথরের জঞ্জালে পরিণত হবে। এই পরিবর্তন শুধু চট্টগ্রামবাসীর সমস্যা নয়, এটি সারা দেশের জন্য একটি গুরুতর সমস্যা। পরিবেশ ও স্থায়িত্বের বিষয়টি সামগ্রিকভাবে সমাজের ওপর প্রভাব ফেলে। এটি সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব একটি শহরের টেকসই বা সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা। অন্ততপক্ষে নাগরিকদের জন্য এর পূর্বেকার অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যাতে ভবিষ্যতের প্রজন্মও চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারে। 
নাগরিক সমাজের ভূমিকা চট্টগ্রামের উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় জনগণ তাদের এলাকার সমস্যা সমাধানের জন্য নিজেরা উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। তারা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের প্রত্যাশা ও দাবি প্রতিষ্ঠা করতে এবং সরকারের কাছে তাদের দাবি তুলে ধরতে পারে। নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে স্থানীয় জনগণ নিজেদের এবং তাদের সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রভাব ফেলতে পারে। 
পরিবর্তিত বাস্তবতায় নতুন মেয়র চট্টগ্রামকে ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি সিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে বেশ কয়েকমাস পেরিয়ে গেলেও অদ্যাবধি লক্ষণীয় তেমন কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়নি। যেহেতু চট্টগ্রাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী, সেহেতু সেহেতু এটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। এর উন্নতি হলে তা দেশের অন্যান্য শহর ও গ্রামাঞ্চলে উন্নয়নের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। চট্টগ্রামকে একটি পরিচ্ছন্ন, সবুজ ও স্বাস্থ্যকর নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যে প্রত্যয় ব্যক্ত করা  হয়েছে, তার বাস্তবায়নে সরকার, নাগরিক সমাজ এবং সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। 
একই সঙ্গে চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণে আমাদের সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। নাগরিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এবং সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা চট্টগ্রামকে উন্নতির পথে নিয়ে যেতে পারি, যা সমগ্র দেশের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে উঠবে। তাই আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে এবং সমষ্টিগতভাবে কাজ করতে হবে, যেন চট্টগ্রাম তার সঠিক পথে এগিয়ে যেতে পারে।
শুধু সরকারি উদ্যোগই নয়, জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণই একটি শহরের উন্নয়নে স্থায়িত্ব আনতে পারে। এই পরিবর্তনের জন্য নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, নাগরিক সুবিধা ও পরিষেবার গুরুত্ব উপলব্ধি করা এবং নাগরিক সমাজের সংহতি গড়ে তোলা জরুরি। নাগরিকদের নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে চট্টগ্রামের উন্নয়ন পরিকল্পনার বিষয়ে ধারণা ও চেতনা তৈরি করা যেতে পারে। 
সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, বিনোদন এবং নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাস সংরক্ষণে সচেতনতা সৃষ্টি করার পাশাপাশি কিভাবে নাগরিকরা নিজেদের উদ্যোগে এই উন্নয়নগুলো বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে পারে তা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। আমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতার মাধ্যমে চট্টগ্রামকে একটি উন্নত, সবুজ এবং স্বাস্থ্যকর নগরী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। তাই নাগরিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারি।
চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনার এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব আমাদের দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই শহরের বর্তমান পরিস্থিতি ক্রমাগত খারাপ হচ্ছে, যেখানে নাগরিক সুবিধা, পরিষেবা এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাব দিন দিন বাড়ছে। তবে বর্তমান সরকার এবং নতুন মেয়রের উদ্যোগের মাধ্যমে যদি জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তবে চট্টগ্রাম অবশ্যই একটি ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি সিটি হিসেবে গড়ে তোলার পথে অগ্রসর হবে। 
নাগরিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এক নতুন সূচনার দিকে যেতে হলে সরকারের অঙ্গীকার এবং নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো নিজেদের এলাকার উন্নয়নে এগিয়ে আসা। কারণ পরিবর্তনের জন্য তাদের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। স্থানীয় জনগণ তাদের সমস্যা সম্পর্কে জানিয়ে এবং সমাধান খোঁজার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করলে তা সরকারের কাছে গুরুত্ব পাবে। 
চট্টগ্রামের জন্য এই নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে হলে সকলের উচিত একত্রে কাজ করা, যাতে চট্টগ্রাম তার সঠিক অবস্থানে ফিরতে এবং একটি সুস্থ, সুন্দর ও সবুজ নগরীতে পরিণত হতে পারে। একটি সুস্থ ও সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম গড়ার জন্য আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যন্ত জরুরি। সেটি নিশ্চিত করার প্রধানতম দায়িত্ব নগর কর্তৃপক্ষের। 

লেখক : অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

প্যানেল

×