
জুলাই অভ্যুত্থানের পর বদলে যাওয়া বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ঘোষণা করল অন্তর্বর্তী সরকার। জীবনে প্রথমবারের মতো বাজেট পেশ করলেন অর্থপদেষ্টা ড. সালাহউদ্দিন আহমেদ। পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি ছিল একটি ‘দৃষ্টি-কেন্দ্রিক’ বাজেট। কারণ, নির্বাচিত সরকার না থাকায় জাতীয় সংসদে নয়—বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থপদেষ্টা।
সোমবার ঘোষিত এই বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। ঘোষণা মুহূর্তেই শুরু হয়ে গেছে বিশ্লেষণ, আলোচনা এবং সমালোচনা—এই বাজেট কতটা প্রভাব ফেলবে সাধারণ মানুষের জীবনে, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের ওপর।
রাজস্ব ও ব্যয়ের কাঠামো
প্রস্তাবিত বাজেটে আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৯ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আসবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা, এনবিআর বহির্ভূত খাত থেকে ১৯ হাজার কোটি টাকা এবং গড় বহির্ভূত রাজস্ব আদায় ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০০ কোটি টাকা। বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এই ঘাটতি মেটাতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
দামের হ্রাস: স্বস্তির তালিকা কাদের জন্য?
নতুন বাজেটে কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক হ্রাস এবং ভ্যাট অব্যাহতির ফলে দাম কমতে পারে যেসব পণ্যের, সেগুলো হলো:
- চিনি
- স্যানিটারি ন্যাপকিন
- প্যাকেটজাত তরল দুধ
- বাটার
- বল পয়েন্ট কলম
- বিদেশি মাছ ও মাংস
- আইসক্রিম
- ৩০ ইঞ্চি পর্যন্ত কম্পিউটার মনিটর
- বিদেশি প্লাস্টিক ও তেজসপত্র
- বিদেশি পোশাক, জুতা ও স্যান্ডেল
তবে অর্থনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষের মতে, এইসব পণ্যের বেশিরভাগই মধ্য ও নিম্নবিত্তের প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় তালিকায় পড়ে না। বিশেষ করে বিদেশি মাছ, মাংস, পোশাক, জুতা, তেজসপত্র—এসব পণ্যের দাম কমলেও তা নিম্নবিত্ত বা গড় মধ্যবিত্তদের জীবনে তেমন প্রভাব ফেলবে না। তাই মূল্যছাড়ের এই তালিকা দেখে সন্তুষ্ট নন অনেকেই।
দামের ঊর্ধ্বগতি: দুশ্চিন্তার কালো মেঘ
একই সঙ্গে বাজেটে বেশ কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে, যার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় ও দৈনন্দিন ব্যবহারের অনেক পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- মোবাইল ফোন
- রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার
- এয়ার কন্ডিশনার ও কমপ্রেসর
- ওয়াশিং মেশিন
- ব্লেন্ডার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন
- আয়রন, রাইস কুকার, প্রেসার কুকার
- থালাবাসন, প্লাস্টিকের তৈজসপত্র
- সাবান, শ্যাম্পু
- গৃহস্থালী সামগ্রী, ব্লেড
- এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার
- প্রসাধনী (লিপস্টিক, লিপ লাইনার, আইলাইনার, ফেস ওয়াশ, মেকআপ সরঞ্জাম)
- বিদেশি চকলেট
এছাড়া গৃহনির্মাণে ব্যবহৃত রডের দাম টনপ্রতি ৪০০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, যা নতুন বাড়ি নির্মাণে উদ্যত মধ্যবিত্তদের জন্য বড় ধাক্কা। বাড়বে মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশের দামও। দেশীয় টেক্সটাইল মিল থেকে উৎপাদিত সুতার ওপর ভ্যাট বাড়ানোর ফলে গামছা, লুঙ্গি ও অন্যান্য স্থানীয় পোশাকের দাম বাড়বে, যা সরাসরি প্রভাব ফেলবে মধ্য ও নিম্নবিত্তদের উপরে।
ধূমপান নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জন্য বাজেটে দুঃসংবাদ—সিগারেটের দাম বাড়বে, যা মধ্য ও নিম্নবৃত্তদের খরচে বাড়তি চাপ দেবে।
মধ্যবিত্তের জন্য বাজেট কতটা সহায়ক?
সব মিলিয়ে এবারের বাজেটকে অনেকে বলছেন ‘গড় পার্টার বাজেট’। অর্থাৎ, খুব বেশি ঝুঁকি নেয়নি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখাই ছিল মূল উদ্দেশ্য, যা বাজেট কাঠামোতেও প্রতিফলিত হয়েছে।
তবে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য নিয়ে শঙ্কিত। একদিকে কিছু অপরিচিত বা বিলাসী পণ্যে দাম কমলেও, অপরদিকে জীবনের প্রয়োজনীয় ও প্রতিদিন ব্যবহৃত বহু পণ্যের দাম বাড়ছে। তাই স্বস্তির চেয়ে দুশ্চিন্তাই বেশি এই বাজেট নিয়ে।
এই বাজেট বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় কোনো রূপান্তরের ইঙ্গিত দেয়নি। বরং সংকটকালে একটি ‘সেফ বাজেট’ হিসেবে সেটি উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—এই বাজেটে সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে কতটা সফল হবে অন্তর্বর্তী সরকার?
ফরিদ