
কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তেজনা চলার পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের মধ্যে ওয়াশিংটন ডিসিতে ৩০ এপ্রিল একটি চুক্তিতে সই হয়েছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের মূল্যবান দুর্লভ খনিজসম্পদে প্রবেশাধিকার পাবে ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে পুনর্গঠনে তহবিল জোগান দেবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউসে বৈঠকে প্রকাশ্য বিবাদে জড়ানোর পর রাষ্ট্র দুটির সম্পর্কে চরম অবনতি ঘটে। ট্রাম্প তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জুয়া খেলার অভিযোগে জেলেনস্কিকে অভিযুক্ত করেছিলেন। রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রার আগ্রাসনের মুখে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউক্রেন সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা করছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে চুক্তিটি একটি বড় পদক্ষেপ। রাশিয়া ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখলের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ে। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র একদিকে ইউক্রেনের সামরিক সহায়তা বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। বর্তমান খনিজ চুক্তি হচ্ছে তার চূড়ান্ত রূপ। রাশিয়া ইউক্রেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অঞ্চলের এক-পঞ্চমাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে এবং আগামীতে শান্তি চুক্তিতে তারা দখল করা এই অঞ্চল ফেরত না দেওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করেছে। যুদ্ধের ফলে ইউক্রেনের অর্থনীতিতে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতি হয়েছে। হাজারো অবকাঠামো হয়েছে ধ্বংস এবং প্রায় ১.৩ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাতে ট্রাম্প জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তিন বছর ধরে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাওয়ার বিনিময়ে দেশটির নিকট ট্রাম্প ৫০০ বিলিয়ন ডলার মূল্যমানের খনিজ দাবি করেছিলেন। তবে পরিমাণটি মোট সামরিক সহযোগিতার চার গুণের বেশি। এর পূর্বে ট্রাম্প ইউক্রেনকে সরাসরি নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়ার চিন্তাধারা বা দেশটির ন্যাটো জোটে যোগ দেওয়ার বিষয়গুলোকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তবে চুক্তি সইয়ের পর তিনি বলেন, ইউক্রেনের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি তাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউক্রেনের ভূগর্ভে ইউরোপীয় ইউনিয়নের তালিকাভুক্ত ৩৪টি গুরুত্বপূর্ণ খনিজের মধ্যে অন্তত ২২টির সম্ভাব্য মজুত রয়েছে। এর মধ্যে লিথিয়াম, টাইটানিয়াম, গ্রাফাইট, নিকল, কপার, জিরকোনিয়াম ও বিরল মৃত্তিকা উপাদান রয়েছে। ইউক্রেনে বিশে^র গ্রাফাইট মজুতের ২০ শতাংশ রয়েছে। ইলেকট্রিক ব্যাটারির অপরিহার্য উপাদান এটি। এগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি, প্রতিরক্ষা খাত ও আধুনিক প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য। বিশ্বের বিরল ও প্রথাগত খনিজের ৫ শতাংশ ইউক্রেনে রয়েছে। তবে দেশটির বেশির ভাগ খনিজ উত্তোলনের কোনো উদ্যোগ এখনো শুরু হয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে খনিজসমৃদ্ধ বেশ খানিকটা ভূখণ্ড চলে গেছে রাশিয়ার দখলে। পূর্ব ইউক্রেন ও দনবাস অঞ্চল ঘিরে থাকা কিছু খনিজসমৃদ্ধ এলাকা রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকায় উত্তোলনে বাধাগ্রস্ত হতে পারে। আর পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলে এখনো বিপুল পরিমাণ সম্পদ অনাবিষ্কৃত রয়েছে। ট্রাম্প বলেছেন, ‘রাশিয়া শুধু এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বিরল খনিজ প্রয়োজন। আর ইউক্রেনের নিকট এগুলোর বিশাল মজুত আছে। চুক্তিটি আমাদের সেই চাহিদা পূরণে সহযোগিতা করবে।’ ইউক্রেনের এই খনিজসম্পদ একদিকে ইউক্রেনের অর্থনীতির চালিকাশক্তি, আবার অন্যদিকে এগুলো দেশটির সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে আক্রমণের কারণও বটে। রাশিয়ার আগ্রাসী নীতি এবং পশ্চিমা দেশগুলোর জ¦ালানিনির্ভর কৌশলগত আগ্রহ উভয়ই ইউক্রেনের এই খনিজসম্পদের কারণে আরও জটিল হয়ে উঠেছে। প্রাকৃতিক সম্পদের বিনিময়ে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা প্রদানের কৌশলটি সূক্ষ্ম হলেও দেশটির ভবিষ্যতের জন্য এটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয় ছিল, যা ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে উঠছে। জেলেনস্কি এখন তাদের নিজেদের ফাঁদেই ধরা পড়েছেন।
চুক্তি অনুযায়ী আগামী দশ বছর যুক্তরাষ্ট্র যে তহবিল গঠন করবে তার পুরোটা ইউক্রেনে বিনিয়োগ হবে। তহবিলের অর্থ আসবে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ও সামরিক সহায়তা থেকে। ইউক্রেন এই তহবিলে নিজের খনিজসম্পদ আয়ের ৫০ শতাংশ প্রদান করবে। এরপর লভ্যাংশ অংশীদারদের মধ্যে ভাগ হবে। তহবিল পরিচালনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন সমানভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এবং চুক্তির আওতায় শুধু ভবিষ্যতের সামরিক সহায়তা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এর ফলে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহযোগিতা, বিদেশী বিনিয়োগ এবং কৌশলগত জোটের সুবিধা পাবে ইউক্রেন। এ চুক্তির ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের অর্থনীতি চাঙ্গা করতে একটি যৌথ তহবিল গঠিত হবে, যেখানে দুই দেশ সমান অংশীদার হবে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অংশীদারিত্ব যতটা না সমান, তার চেয়ে বেশি একমুখী মার্কিন স্বার্থের সমঝোতা। ইউক্রেনের অর্থমন্ত্রী ইউলিয়া বলেন, এটি শুধু অর্থনৈতিক চুক্তি নয়, এটি একটি কৌশলগত অংশীদারিত্ব। এই চুক্তি খনিজসম্পদ, তেল ও গ্যাস প্রকল্প এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো বা প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রকল্পের অর্থায়ন করবে। এই চুক্তির মাধ্যমে ইউক্রেনে বৈশি^ক বিনিয়োগ আকর্ষণের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন বিনিয়োগ তহবিল প্রতিষ্ঠা রাশিয়ার প্রতি একটি বার্তা যে, ট্রাম্প প্রশাসন দীর্ঘমেয়াদে এক স্বাধীন, সার্বভৌম ও সমৃদ্ধ ইউক্রেন গড়ার শান্তি প্রক্রিয়ার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের জনগণের মধ্যে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার এ ভাবনা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের, যা একটি টেকসই শান্তি ও সমৃদ্ধ ইউক্রেনের প্রতি উভয়পক্ষের প্রতিশ্রুতিই প্রতিফলিত করে। এটি ইউক্রেনের উন্নয়নে সম্পদ উন্মোচনের একটি পথ খুলে দেবে। ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শ্মাইগাল বলেন, এই চুক্তি উত্তম, সমতাপূর্ণ ও উপকারী। দুই দেশ মিলে একটি পুনর্গঠন বিনিয়োগ তহবিল করবে। সেখানে উভয়পক্ষের সমান ভোটাধিকার থাকবে এবং ইউক্রেনের হাতে সংশ্লিষ্ট ভূখণ্ড, অবকাঠামো ও প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। তিনি জানান, এই চুক্তির মাধ্যমে কিয়েভের বড় একটি উদ্বেগ দূর হয়েছে। তিনি নিশ্চিত করে বলেন, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ওয়াশিংটন যে বিপুল পরিমাণ সামরিক সহায়তা দিয়েছে তা দেনা হিসেবে বিবেচিত হবে না এবং এর জন্য কিয়েভকে কোনো অর্থ পরিশোধও করতে হবে না। ওই তহবিলের মুনাফা কেবলমাত্র ইউক্রেনেই পুনর্বিনিয়োগ করা হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে ‘রেয়ার আর্থ’ নামে পরিচিত এসব খনিজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী। তবে চুক্তিটি কার্যকর হতে ইউক্রেনের পার্লামেন্টের অনুমোদন নিতে হবে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি কিছু সুবিধা আদায় করে নিলেও চুক্তির ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থান এবং চুক্তির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ খুবই স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছে। স্কট বেসেন্ট এ প্রসঙ্গে বলেছেন, রাশিয়াকে অস্ত্র বা অর্থ দিয়ে যেসব ব্যক্তি বা রাষ্ট্র সহযোগিতা করেছে তাদের ইউক্রেনের পুনর্গঠনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না। এর অর্থ যারা রাশিয়ার বিরোধিতা করেছে যুক্তরাষ্ট্র কেবল তাদের সঙ্গেই কাজ করতে চায়। শর্তটি এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন যুক্তরাষ্ট্রই চুক্তির নীতিনির্ধারণ ও অনুমোদনের কেন্দ্রে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, বেসেন্ট তার বক্তব্যে ‘রাশিয়ার পূর্ণ মাত্রার আগ্রাসন’ বাক্যটি ব্যবহার করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা সাধারণত রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধকে ‘সংঘাত’ হিসেবে অভিহিত করেন। পাশাপাশি এই যুদ্ধ শুরু করার জন্য মস্কোর পাশাপাশি কিয়েভকেও দায়ী করে থাকেন। ইউক্রেন জানিয়েছে, দীর্ঘ দরকষাকষির পর যে চুক্তি সই হয়েছে তাতে ইউক্রেনের স্বার্থ সুরক্ষিত হয়েছে। বিরল খনিজ সম্পদের ওপর পূর্ণাঙ্গ সার্বভৌমত্বও কিয়েভের থাকছে। এই চুক্তিকে কেন্দ্র করে ইউক্রেন তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। ইউক্রেনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, এই বিনিয়োগ কেবল খনিজ নয়, তাদের প্রযুক্তি, গবেষণা ও রপ্তানি অবকাঠামোকেও নতুন করে সজ্জিত করতে সহযোগিতা করবে। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, শান্তির উদ্যোগের অন্তরালে যুক্তরাষ্ট্রের মূল উদ্দেশ্য, যা ট্রাম্প ইউক্রেনের ওপর নানা চাপ তৈরি করে পূরণ করেছেন।
চুক্তিটির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নিকট থেকে ইউক্রেন আরও কিছু সহযোগিতা পাবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ। যদিও এই চুক্তি সরাসরি নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেয় না, তবে এটি ভবিষ্যতের সামরিক সহায়তার পথ সুগম করবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ যদিও এখনো প্রকাশ হয়নি। ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা বিষয়ক শর্তাবলী নিয়েও ধোঁয়াশা রয়েছে। ইউক্রেনের রাজনৈতিক মহলে তাই কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে। কারণ এ চুক্তির মাধ্যমে বিনিয়োগ আসবে, তবে প্রতিরক্ষা নিশ্চয়তা কতটুকু মিলবে তা এখনো অজানা। চুক্তিটির ফলে ইউক্রেন যেমন অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রও ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাব হ্রাসে কৌশলগত অবস্থান মজবুত করার সুযোগ পাচ্ছে। রাশিয়াকে প্রতিরোধ করার একটি নতুন মার্কিন কৌশলের অংশ হিসেবেও চুক্তিটিকে দেখা হচ্ছে। তবে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা না থাকা এবং খনিজসম্পদের ওপর মার্কিন প্রভাব বৃদ্ধির সম্ভাবনা ভবিষ্যতে নতুন ধরনের জটিলতা তৈরি করতে পারে। তাছাড়া ইউক্রেনের খনিজ শিল্পকে ঘিরে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। কারণ দেশটির বেশিরভাগ ভূতাত্ত্বিক জরিপই সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে করা। এর ফলে প্রকৃত মজুত ও উত্তোলনযোগ্যতার নির্ভরযোগ্য মূল্যায়ন এখনো অনুপস্থিত। এছাড়া যুদ্ধোত্তর নিরাপত্তা ও অবকাঠামোগত দুর্বলতাও বিদ্যমান। তবে যুক্তরাষ্ট্র মনে করে চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের শুধু কাঁচামালের সরবরাহ শৃঙ্খলকেই বৈচিত্র্যপূর্ণ করবে না, বরং একই সঙ্গে ইউক্রেনের অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকেও শক্ত ভিত্তি দেবে। তবে এই চুক্তিতে ইউক্রেনের প্রত্যাশিত নিরাপত্তা নিশ্চয়তা রয়েছে কি না, তা কিন্তু স্পষ্ট নয়। তবে ট্রাম্প প্রশাসন মনে করে, ইউক্রেনে মার্কিন বাণিজ্যিক স্বার্থ বৃদ্ধির মাধ্যমে রাশিয়ার আগ্রাসন প্রতিরোধ সহজ হবে।
ট্রাম্প দাবি করেন, ইউক্রেন থেকে দূরে থাকবে অশুভ শক্তিরা। তিনি এটা নিশ্চিত করবেন। তবে এর অর্থ এই নয় যে, তিনি সেখানে সেনা মোতায়েন করে চলেছেন। খনিজ চুক্তির অধীনে ইউক্রেনে গিয়ে আমেরিকানরা খনিজ উত্তোলনের কাজ করবেন এবং তাদের উপস্থিতিই দেশটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তিনি আরও বলেন, ওয়াশিংটন-কিয়েভের খনিজসম্পদ চুক্তি সই ইউক্রেনের জন্য মঙ্গলজনক পদক্ষেপ এবং এর মাধ্যমেই দেশটি নিরাপদ থাকবে। বিশ্লেষকদের মতে, এ চুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক আগ্রহের পাশাপাশি কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করেছে। বিশেষত চীনের বিরুদ্ধে বিরল খনিজ সরবরাহের বিকল্প পথ তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে চীন বিশে^র ৭০ শতাংশ রেয়ার আর্থ খনিজ প্রক্রিয়াজাত করে, যার ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা শিল্প ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। চীনের একচেটিয়া বিরল খনিজ বাজার দখলের বাস্তবতায় পশ্চিমা দেশগুলো কয়েক বছর ধরেই বিকল্প উৎসের সন্ধানে ছিল। ইউক্রেন সেই ঘাটতি পূরণের একটি সম্ভাব্য উৎস হিসেবে উঠে এসেছে। কারণ ইউক্রেনের মাটিতে প্রায় ৫ লাখ টন অনুমিত লিথিয়াম মজুত রয়েছে। ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র খনিজ চুক্তির ফলে ইউক্রেনের রেয়ার আর্থ খনিজ উৎপাদনের পথ খুলবে এবং চীনের ওপর নির্ভরতা হ্রাস পাবে। তবে চুক্তিটি চীনের বিরল খনিজ বাজারে কতটা চাপ সৃষ্টি করবে তা সময়ই বলে দেবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউক্রেন সফলভাবে উত্তোলন ও রপ্তানির কাঠামো গড়ে তুলতে পারলে তবে তা বৈশি^ক খনিজ সরবরাহের বড় ধরনের সমীকরণ বদলাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের জন্য এটি একটি সাপ্লাই চেইন শিফট করার বাস্তব কৌশল হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। এই উদ্যোগ শুধু ইউক্রেনের যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন নয়, বরং চীনের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পশ্চিমা বিশে^র কৌশলও বটে।
ইউক্রেনের লক্ষ্য ছিল ট্রাম্পকে বোঝানো যে, ইউক্রেন একটি দানখানা নয়, বরং একটি খরচ সাশ্রয়ী অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক সুযোগ, যা শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে সমৃদ্ধ ও সুরক্ষিত করবে। কিন্তু জেলেনস্কির দলের এই কৌশলটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। তারা হয়তো ভাবেনি ট্রাম্প চুক্তির বিষয়ে সবসময় উঁচুতে থাকতেই পছন্দ করেন। ইউক্রেন ইস্যুতে ট্রাম্পের শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ও খনিজসম্পদ বিষয়ক চুক্তি দুটি কিন্তু ভিন্ন বিষয়। তবে এ দুটি ক্ষেত্রেই ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক কৌশল প্রতিফলিত হয়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এর আগে এই দ্বিপক্ষীয় খনিজ চুক্তিকে প্রাথমিক হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই চুক্তির মধ্য দিয়ে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা বলয়ে অন্তর্ভুক্ত হোক, যাতে রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর নতুন করে কোনো আগ্রাসন চালালে তা প্রতিহত করা যায়। কিন্তু ট্রাম্প বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র খুব বেশি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করবে না, বরং ইউক্রেনকে নিরাপত্তা দেওয়ার এ দায়িত্ব ইউরোপকে নেওয়া উচিত। তিনি ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ পাওয়ার সম্ভাবনাকেও এক প্রকার নাকচ করে দিয়েছেন, যদিও এটি পাওয়া জেলেনস্কির দীর্ঘদিনের একটি লক্ষ্য ছিল। ট্রাম্প বলেছিলেন, ইউক্রেনকে ন্যাটো সদস্যপদ পাওয়ার চিন্তা ভুলে যেতে হবে। তিনি রাশিয়ার দাবির পুনরাবৃত্তি করে বলেছিলেন, এ বিষয়টিই যুদ্ধ শুরুর অন্যতম কারণ। ইউক্রেন এই মুহূর্তে একটি জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি। বিপুল খনিজসম্পদ ইউক্রেনকে শুধু অর্থনৈতিকভাবেই নয়, ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এক কৌশলগত কেন্দ্রে রূপান্তর করেছে। যুদ্ধ চলাকালীন কৌশলগত অংশীদারিত্বের প্রলোভনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক জোট গড়ছে। এই অংশীদারিত্বের একক মূল্য পরিশোধ করছে কিন্তু ইউক্রেন, অথচ লাভের ভাগ কিংবা নিরাপত্তার বিষয়টি ততটা নিশ্চিত নয়। এই চুক্তিটি ইউক্রেনের যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূখণ্ডে একটি নতুন প্রভাববলয় নির্মাণের সূচনা করছে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্যানেল